ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / ব্রিটিশ উপনিবেশত্তোর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মালয় ভাষা
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবসে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভাষার মর্যাদা, প্রায়োগিকতা ও গঠন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সে হিসেবে এই দিবস উপলক্ষে মালয় ভাষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীতা রয়েছে। কারণ মালয় ভাষাবৈশ্বিক পরিমণ্ডলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। এটি মালয় জাতির জাতিসত্ত্বা ও জাতীয়তার প্রতীক। তাছাড়া এটি মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা। অধিকন্তু এটি একই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই ও সিঙ্গাপুরের দাপ্তরিক ভাষা। এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা।  খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দতে বোর্ণিও দ্বীপে এই ভাষার আদি বুলির অস্তিত্ব ছিল বলে কথিত রয়েছে। এর আদি বুলিটি আদি অবস্থান বোর্ণিও দ্বীপে হলেও, এর বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধন হয়েছে মালয় উপদ্বীপে। এই আদি ভাষাটি অনেকগুলো ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ামকের প্রক্রিয়াধীনে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই আদি বুলিটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হয়ে উঠেছে চতুর্দশ শতাব্দীতে মালয় উপদ্বীপের মালাক্কা সালতানাতের রাজনৈতিক পটভূমিতে। এই ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হয়ে ওঠার পেছনে যে ভৌগোলিক নিয়ামকটি প্রধান শর্ত হিসেবে কাজ করেছে, সেটি হলো মালাক্কা প্রণালির ভৌগোলিক অবস্থান। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রকে চীন, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও আরব অঞ্চলের মধ্যে নৌপথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মালাক্কা প্রণালির অবস্থান ছিল কেন্দ্রীয়। এই কেন্দ্রীয় অবস্থানে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের বণিকদের মধ্যে পরস্পর বাণিজ্যিক বিনিময়ের সহায়ক ভাষা হিসেবে মালয় ভাষা ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে।  ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সমস্ত অঞ্চলে এই ভাষা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে সময় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী বণিক শ্রেণি প্রাচ্যে ব্যবসা বিস্তৃত করতে থাকলে, লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে এই ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। মালয় ভাষা বিস্তৃতির এই যে প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়, সেটি না থেমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হয়ে ওঠে।    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোরকালে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়তে বাধ্য হলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অনেকগুলো প্রজাতন্ত্র গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রজাতন্ত্র গঠনে প্রয়োজন হয় ভাষার। কারণ ভাষা হলো প্রশাসন, শিক্ষা ও গণমাধ্যম পরিচালনার বাহন। কাজেই একটি এজমালি ভাষা ছাড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় আনা সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্র গঠনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা না কি স্থানীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে, সেই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন এই লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাটি আলোচনায় আসে। ইন্দোনেশিয়া ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করলে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব মালয় ভাষাকে প্রজাতন্ত্র গঠনে মালয় ভাষাকে জাতীয় ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু নাম দেয় ইন্দোনেশীয় ভাষা। এভাবে মালয় ভাষা প্রথমবারের একটি জাতির সংহতি রক্ষার নিয়ামক হিসেবে অবির্ভূত হয়।  উপনিবেশত্তোর ইন্দোনেশিয়ায় মালয় ভাষার ইন্দোনেশীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত লাভ মালয়েশিয়ায় এই ভাষার জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার পথ তৈরি করে। অতঃপর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মালয়েশিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হলে, স্বাধীন মালয়েশিয়া প্রজাতন্ত্র মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মালয় ভাষাকে প্রবর্তন করা হয়। এভাবে মালয় ভাষা তার নিজ দেশে মর্যাদার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে এই দেশে ব্যাপক হারে চীনা ও দক্ষিণ ভারতীয় তামিল, মালয়ালাম ও কানাড়াদের বসতির সুযোগ দিলে, মালয়েশিয়ার ভাষিক জনমিতিতে অপ্রীতিকর পরিবর্তন ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের কল্যাণে স্বাধীন মালয়েশিয়া একটি বিষম ভাষা-পরিস্থিতি লাভ করে। এই ভাষা-পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পর মালয়েশিয়ার সরকারকে শিক্ষা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমের ভাষা হিসেবে চীনা ও তামিল ভাষাকে গ্রহণ করতে হয়। এই অবস্থায় মালয়েশিয়ায় একটি বহুভাষী পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা ভাষিক ভূদৃশ্য সদা দৃশ্যমান রয়েছে।  এভাবে মালয় জাতির হাজার বছরের অর্জন মালয় ভাষা থাকা সত্ত্বেও, ঔপনিবেশিক অবশেষ হিসেবে প্রাপ্ত ভিনদেশীয় কয়েকটি ভাষার অবস্থিতির কারণে, একটি সমসত্ব মালয় জাতি গঠনে সমস্যা হচ্ছে। ভিন দেশীয় ভাষা জাতীয় সংহতির বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও মালয়েশিয়ায় জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, শিক্ষার ভাষা ও গণমাধ্যমের ভাষা হিসেবে মালয় ভাষার স্বীকৃতি মালয় জাতিকে সংসহত জাতি হিসেবে টিকে থাকার অনু্প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। গত দুই দশকে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশটিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদান রাখতে মনোযোগী হয়েছে। একই দেশটি মালয় জাতির গৌরব ও ঐতিহ্যকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে। এই তৎপরতার অংশ হিসেবে দেশটি বিশ্বজুড়ে মালয় ভাষার প্রচার ও প্রসারে তৎপর রয়েছে। মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে ভাষা হলো সাংস্কৃতিক কূটনীতির অন্যতম উপাদান। উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশসমূহ, যেমন- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, চীন ও কোরিয়া যথাক্রমে ব্রিটিশ কাউন্সিল, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, জাপান ফাউন্ডেশন, কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট ও কোরিয়া ফাউন্ডেশন নামক ইত্যাদি ভাষা ও সংস্কৃতি সম্প্রচার সহায়ক প্রতিষ্ঠানের গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে এসব দেশের ভাষা শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে।  মালয়েশিয়ার নেতৃত্বের মধ্যে মালয় ভাষা সম্পর্কে অনুরূপ উপলব্ধি জন্মেছে। যে কারণে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিদেশে মালয় ভাষা প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। এ রকম উদ্যোগের অংশ হিসেবে মালয়েশিয়া সরকারের এ দুটি মন্ত্রণালয় পেরাক প্রদেশস্থ সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায়কে এ কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায় এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ, উজবেকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যে মালয় ভাষা শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু করেছে। মালয়েশিয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যলায়ের বিদেশি ভাষা হিসেবে মালয় ভাষা শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াস কালক্রমে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।  এই মালয় ভাষা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের পর্যায়ে ও লৌকিক পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এভাবে বিদেশি ভাষা হিসেবে মালয় ভাষার প্রসার চালিয়ে গেলে সাংস্কৃতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়-ইন্দোনেশীয় ভাষার যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে, তাতে এই মালয় ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ মালয় ভাষাকে বিশ্বায়নের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।        ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অভ্যাগত অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / শিক্ষানৈতিক দীনতাই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধকতা
ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। এ শিক্ষানীতিতে জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার চেয়েও, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উন্নয়নকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ শিক্ষানীতিতে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালুর বিষয়টিকে ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নের নিয়ামক বলে ধরা হয়। সে অনুযায়ী ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে এ ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা ইংরেজি শিক্ষাবিদদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রণয়ন করা হয়। এই ইংরেজি শিক্ষাবিদরা হলেন মূলত ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ দেশ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদ থেকে ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত, যারা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। তারা দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউনেসকো ও ইউনিসেফ ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তায় এ বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। অর্থাৎ নিজেদের ইংরেজি শিক্ষানীতির দীনতার সঙ্গে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির চাতুর্য যুক্ত হয়ে বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে।  এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষানৈতিক দীনতাটি বুঝতে হলে, ইংরেজি শিক্ষার নির্ধারিত লক্ষ্য এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিটি উদঘাটন করতে হবে। এ পর্যায়ে আমাদের জানা দরকার ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়।  ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষক, ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষার পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সহায়ক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে বোঝায়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার উন্নয়ন, যেন একজন শিক্ষার্থী এই ইংরেজি ভাষায় অর্জিত দক্ষতাটি জ্ঞান অর্জন বা পারস্পরিক সংজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত জ্ঞান দ্বারা প্রণীত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ঈপ্সিত ইংরেজি ভাষা দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিদদের মূল গবেষণার বিষয় হলো ইংরেজি ভাষার শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নয়। যে কারণে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে বিবৃত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে বিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যয়িত জাতীয় শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্থ, যার পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, তার অধিকাংশই অপচয় হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে এ ব্যর্থতার মূল কারণ হলো ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দৈন্যদশা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা বলতে বোঝায় ইংরেজি ভাষার শব্দ সংখ্যা ও ব্যাকরণে দখল, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার শ্রবণ, বাচন, লিখন ও পঠনগত দক্ষতাকে প্রকাশ করে থাকে। এ দক্ষতার প্রারম্ভিক, প্রাথমিক, প্রাক-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর—এ ছয়টি ধাপ রয়েছে। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার এ ছয়টি ধাপকে বিবেচনায় না নিয়েই বর্তমান ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে। ভাষাগত দক্ষতার ধাপকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ হলো, তাদের বিজাতীয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং জাতীয় ভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অসক্ষমতা। অথচ ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য জানা অপরিহার্য। ইংরেজি ভাষা হলো মূলত বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম। তার বিপরীতে বাংলা ভাষা শুধু বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যম নয়। বরং সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম। তা ছাড়া এ ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতার প্রতীক। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষা হলো বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক। কিন্তু ইংরেজি ভাষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয়। শিক্ষানৈতিক আদর্শ অনুযায়ী বুনিয়াদি শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পাঠ্যক্রমে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয় বিধায় এই ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। বরং ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়ে ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমে বাংলা ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে এ ভাষায় সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম হিসেবে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা যেহেতু সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম নয়, শিক্ষাক্রমে এ ভাষায় পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ইংরেজি শিক্ষাক্রম দ্বারা ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত না হলে, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বি-সামাজিকীকরণ ও বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বস্তুত বাংলাদেশে তেমনটাই ঘটছে। যা ঘটছে তা হলো, বর্তমান প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ঈপ্সিত ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না, তার বিপরীতে শিক্ষার্থীরা বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার ঝুঁকিতে নিপতিত রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ভাষাগত দক্ষতা না থাকায় শিক্ষা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং জ্ঞান অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। অধিকন্তু ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাবে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে, তা সমাজ জীবনে বাংলিশ বিস্তৃতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত ওই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে ইংরেজি ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি, বাংলা ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ভিন্নতর হবে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা পাঠ্যক্রম ও ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি হবে যথাক্রমে কৃতিভিত্তিক ও দক্ষতাভিত্তিক। সে হিসেবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থী ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও, শুধু ইংরেজি ভাষা দক্ষতা পরীক্ষা পাস সাপেক্ষে একজন শিক্ষার্থী ছয় ধাপভিত্তিক ওপরের দক্ষতা সম্পন্ন ক্লাসে উত্তীর্ণের সুযোগ পাবে। এ দক্ষতাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী যে শ্রেণির শিক্ষার্থীই হোক না কেন, ইংরেজি ভাষার ক্লাসের তার অন্তর্ভুক্তি হবে ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতার ধাপ অনুযায়ী। সে হিসেবে একটি দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ—একজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী—এ তিনজন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা যদি উচ্চমাধ্যমিক ধাপের হয়, তাহলে তারা সবাই একই ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রস্তাবিত দক্ষতাভিত্তিক এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় ধাপভিত্তিক পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে, একটি জাতীয় ভাষাগত দক্ষতা পরিমাপক অভীক্ষা চালু করতে হবে। এই অভীক্ষা চালু করা হলে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্তযুক্ত করা যাবে। তা ছাড়া ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্ত যুক্ত করা যাবে। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজ ভাষা শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে, ভাষিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানীয় কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতামুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়ন সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।  ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো; জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / বাংলাদেশের ভাষারাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসের কতকগুলো মাইলফলক ঘটনা হলো— ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি নতুন রাষ্ট্রের সৃজন, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টব্দে বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের পরিণতি, ২৩ মার্চ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্ত পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ।  এরপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে সামরিক অভ্যুত্থান ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ এবং তৎপরবর্তীকালে ১৫ বছরব্যাপী সামরিক সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তারিখে সামরিক সরকারের পতন। উল্লেখিত এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও তৎসংশ্লিষ্ট আরও কিছু রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ বাংলাদেশের ভাষারাজনৈতিক আদর্শ রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।   ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট পূর্ববাংলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিরাজ্য পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভের সময় ৩টি ভাষারাজনৈতিক আদর্শ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। এগুলো—  ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষা, খ) মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক উর্দু ভাষা এবং  গ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির প্রতীক ইংরেজি ভাষা।  মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যুদয়কালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব সমগ্র ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক ইসলাম ধর্ম ও উর্দু ভাষার মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তান রাষ্ট্র সমাজে আত্তীকরণে প্রয়াসী ছিলো। কিন্তু উর্দু ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির এই আত্তীকরণ প্রয়াসের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটে। এই বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এবং পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে।  পরে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উর্দু ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে হাওয়া জোগায়। কিন্তু বাঙালি সমাজে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ হিসেবে প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায় ইংরজি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ।   ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের প্রণোদনায় পরবর্তীকালে যথাক্রমে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং এর পরম্পরায় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। অতঃপর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলা ভাষার অনুকূলে নিম্নরূপ ঘোষণা প্রদান করেন,  ‘...আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে। বাংলাভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা চালু করবেন, তারপরে বাংলাভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা চালু করে দিব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে’। এভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে অধিষ্ঠিত সরকার শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী ছিল। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাব্যবস্থায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে এবং ইংরেজি ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সকল বিদেশি ভাষার সমান শিক্ষার সুযোগ রেখে শিক্ষাব্যবস্থা সাজায়।   ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যা করে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর মুক্তিযু্‌দ্ধে পরাজিত নেতৃত্ব ও নীতিভ্রষ্ট বামপন্থী নেতৃত্বের সহায়তায় সামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং কখনও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ও কখনও গণতন্ত্রের আভরণে এই সামরিক সরকার ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে।  সামরিক শাসন কালপর্বের ১৫ বছর সামরিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রতি যত্নবান ছিল। এর প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ তারিখে সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ কর্তৃক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তারিখে জারিকৃত দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপনের পক্ষে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ জারিকরণের বিষয়। এই আইনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে (৩ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা) পূর্ণরূপে কার্যকর করবার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইন।  এই আইন প্রণয়নের পর থেকে জাতীয় সংসদের সকল আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি, চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে বাধ্যতা আরোপিত হয়। সে অনুযায়ী বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল বেআইনি ও অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।  বাংলাদেশের আপামর সকল জনগণকে তাদের নিজেদের ভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়নের পথে ঔপনিবেশিক ভাষিক বাধা দূরীভূতকরণে আইনটির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সুপ্রিম কোর্টে আইনটি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।  জানুয়ারি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  সামরিক সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পর গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এর পর থেকে দেশে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারকে বাদ দিলে, এ কালপর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে ৩ মেয়াদে ও ২ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এ সময়ের মধ্যে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে নতুন ধারার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। নতুন বিকশিত এই রাজনৈতিক শক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, ফলশ্রুতিতে এই শ্রেণির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপন্থি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের উন্মেষ ঘটে।  এই নতুন রাজনৈতিক শক্তি শিক্ষানীতিতে পুনঃপুনঃ পরিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাকে সর্বাত্মক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এই নব্যরাজনৈতিক শক্তি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে চালু করে এবং পরবর্তীতে যথাক্রমে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতির মাধ্যমে English version School এবং English medium বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। শিক্ষানীতিতে পুনঃপুনঃ পরিবর্তনের ফলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলো সূচিত হয় তা নিম্নরূপ  ক) ইংরেজি-বাংলা দ্বি-ভাষিক স্বাক্ষরতা বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন খ) প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্বাক্ষরতা ইংরেজি কোর্সের প্রবর্তন গ) ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড ও জিইডি ইত্যাদি বিদেশি কারিক্যুলামে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন  ঘ) শিক্ষার সকল স্তরে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন এই কালপর্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষার পক্ষে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি কেবলমাত্র একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। বাংলা ভাষার পক্ষে যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করে তা হলো— উচ্চ আদালত কর্তৃক বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেনো দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর-প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ।  ভাষারাজনৈতিক আদর্শিক বিবর্তনের নেতিবাচক ফল   বাঙ্গালী জাতি ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া বিভক্তির সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক, মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক ও ব্রিটিশ রাজের ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হিসেবে যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি— এই ৩টি ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিল। বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর আশা করা হয়েছিল, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকবে।  কিন্তু গত ৭৬ বছরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেই জাতীয়তাবাদী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। এসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি উদ্ভবের পেছনে যে ভাষারাজনৈতিক আদর্শ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তা বিস্মৃত হয়েছে। তারা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উর্দু ভাষারাজনৈতিক আদর্শের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক অবশেষ হিসেবে রেখে যাওয়া ইংরেজি ভাষিক ভাষারাজনৈতিক আদর্শ এসব রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় পুনরুজ্জীবন ঘটেছে।  এর নিদর্শন দেখা যায় যখন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা লাভের পরও, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা না করে, ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়।  ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলে দেশে এখন একটি সর্বব্যাপী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা ও যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি সাক্ষরতা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা লাভের কারণে মানুষের মধ্যে ভাষিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। অধিকন্তু যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণজনিত অনাসৃষ্টি বাংলিশ সৃষ্টি করছে। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও বাংলা ভাষা— এই উভয়ই কলুষিত হচ্ছে। সমাজের একটি অংশের মানুষের বাঙালি হিসেবে সামাজিকীকরণ ঘটছে না, পরিণামে তারা বাঙালি সমাজে বিআত্তীকৃত রয়ে যাচ্ছে।  বিআত্তীকৃত এই জনগোষ্ঠী থেকে সঞ্জাত নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য চিন্তা, মনন ও মূল্যবোধ ধারণ করছে। এই প্রজন্মটি না বাঙালি না ইংরেজ হিসেবে গড়ে উঠছে। বস্তুত জাতীয় বাজেট দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি শিক্ষা দ্বারা বাঙালি জাতি বিবাঙালিআয়ন প্রক্রিয়া ও বাংলা ভাষা দূষণ প্রক্রিয়া— এই দ্বিবিধ প্রক্রিয়াধীনে নিপতিত হয়েছে। জ্ঞানীয় কর্মকাণ্ড ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধায়তি হচ্ছে বিধায় ইংরজি ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু বাংলা ভাষা অসমৃদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।   বিভিন্ন কালপর্বে রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক গৃহীত ভাষিক কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট, দেশে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের ব্যাপক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।    ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো; জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক  
১৭ জানুয়ারি, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম / বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন
গত ১ জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। এই বাজেটে শিক্ষা খাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এই অর্থের বেশিরভাগই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মূলধারার শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা—এই ধারার শিক্ষায় ব্যয় করা হবে।  শিক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশে যুগোপযোগী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক মানবসম্পদ বা মানবিক পুঁজি গড়ে তোলা। কারণ দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেমন আর্থিক পুঁজি প্রয়োজন; ঠিক তেমনিভাবে মানবিক পুঁজিরও প্রয়োজন। অর্থাৎ যতই আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ করা হোক না কেন, কোনো বাণিজ্যিক, শিল্প বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যদি জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানবিক সম্পদ কাজ না করে তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অভীষ্ট সুফল পাওয়া যায়? উত্তর হলো—না। কারণ জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগকৃত অর্থের অধিকাংশই অপব্যয় ও অপচয় হয়ে থাকে। এই অপব্যয় ও অপচয় সবচেয়ে বেশি হয়ে থেকে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায়। এর প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে নীতিবিবর্জিত শিক্ষানীতি, ভুল ইংরেজি শিক্ষা পরিকল্পনা ও শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রশাসনের বিমুখতা এবং ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়োজিত শিক্ষক-প্রশিক্ষকদের সঠিক শিক্ষাদানে অদক্ষতা ও অনীহা। কিন্তু দেশে মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক একটি সুষ্ঠু ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা পরিকল্পনা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা মেরামতে হাত দিতে হবে। আর মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দেশে কথিত অন্যান্য ভাষা শিক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এসব ভাষার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষা। কারণ একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভাষিক উন্নয়ন অপরিহার্য। যে কারণে ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষার ভাষিক উন্নয়নকে বাদ দিয়ে শুধু ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের সার্বিক ভাষিক উন্নয়নের জন্য একটি সর্বাত্মক ভাষানীতি প্রয়োজন। বিদেশি ভাষার ভাষিক উন্নয়নেও ভাষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। সে জন্য বিদেশি ভাষার বাস্তব প্রায়োগিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে সাময়িকভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।   বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, কোন ভাষাগুলো বিদেশি এবং বিদেশি ভাষার মধ্যে কোনগুলোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সমসাময়িককালে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রজোটের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায় বিদেশি ভাষা শিক্ষার এই সুযোগ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং জনশক্তি রপ্তানিতে তৎপর রয়েছে। এই কাজে সরাসরি যুক্ত রয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শিল্পোন্নত ও বিত্তশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দ্বিপক্ষীয় সভায় সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে নিয়মিত দেনদরবার করে থাকে। বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আরব ভাষাভাষী অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, পূর্ব এশিয়ার জাপান ও কোরিয়া এবং ইউরোপের ইতালি ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করছে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করতে আগ্রহী দেশসমূহে অদক্ষ থেকে শুরু করে অর্ধদক্ষ ও দাপ্তরিক কাজে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মীদেরই ভাষাগত দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ভাষাগত দক্ষতা মানবিক পুঁজির নিয়ামক বিশেষ। জনশক্তি আমদানিকারক দেশসমূহের চাহিদা বিবেচনায় এখন দেশে যেসব বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তার অন্যতম হলো আরবি, মালয়, জাপানি, কোরীয় ও ইতালীয় ইত্যাদি। উল্লিখিত বিদেশি ভাষাগুলো ছাড়াও আরও কিছু বিদেশি ভাষা শিক্ষার চাহিদা রয়েছে। কারণ দেশের যুবসমাজ এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। সেসব দেশে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সংজ্ঞাপনে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া দেশেও কোনো কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বিদেশে ও দেশে কর্মসংস্থানের জন্য আর যেসব বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো চীনা, ফরাসি, স্পেনীয়, তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও গ্রিক ইত্যাদি। এটি এখন বাস্তবতা যে, দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে দেশজুড়ে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই শিক্ষার অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত বিস্তার ঘটছে। যার ফলে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, যার অন্যতম হলো : i) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসমূহ ii) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ (যেখানে ১/২টি কোর্সের মাধ্যমে সীমিত পর্যায়ে বিদেশি ভাষার পাঠদান করা হয়) iii) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়াধীন একাডেমিসমূহ iv) শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ v) জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ vi) বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহে vii) English Medium School সমূহ viii) বিভিন্ন শহরে বা বাজারে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ  বৈদেশিক কর্মসংস্থানের কারণে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা উপরোল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিপূরণ হচ্ছে না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সঠিক নয়। কিন্তু বিদেশে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা বেশি এবং তদানুসারেও মাসিক বেতন-ভাতাও বেশি হয়ে থাকে। প্রত্যেক বিদেশগামী কর্মীর ভেতন-ভাতা যথেষ্ট হলে, তার অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফেরত আসে। দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় এবং বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান বিবেচনায় দেশে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ ও সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে ওই বিদেশি শিক্ষাকার্যক্রমে ব্যাপৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এই উন্নয়নে অর্থ প্রয়োজন। এই দেশব্যাপী পরিব্যাপ্ত শিক্ষাকার্যক্রমের অর্থের জোগান জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই শিক্ষা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয়, কোনো ব্যক্তি ও সংস্থা কর্তৃক মেটানো সম্ভব নয়। জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলে, দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশগামী মানুষ বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরিপ্রাপ্তিতে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে। তৎপরবর্তী সময়ে বিদেশে কর্মসংস্থান হলে সেসব মানুষ দেশে উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠাতে সক্ষম হবে। ফলে জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থের কয়েক গুণ লাভ হিসেবে ফিরে আসবে। দেশের সার্বিক জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটবে। এভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রচুর লাভ হিসেবে দেশের মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। কাজেই চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় শিক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ। পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট। ভূতপূর্ব অভ্যাগত শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়
২৪ জুন, ২০২৩
X