ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:০২ পিএম
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ

বাংলাদেশের ভাষারাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন

ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির। ছবি : সৌজন্য
ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির। ছবি : সৌজন্য

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসের কতকগুলো মাইলফলক ঘটনা হলো— ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি নতুন রাষ্ট্রের সৃজন, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টব্দে বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের পরিণতি, ২৩ মার্চ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্ত পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ।

এরপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে সামরিক অভ্যুত্থান ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ এবং তৎপরবর্তীকালে ১৫ বছরব্যাপী সামরিক সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তারিখে সামরিক সরকারের পতন। উল্লেখিত এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও তৎসংশ্লিষ্ট আরও কিছু রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ বাংলাদেশের ভাষারাজনৈতিক আদর্শ রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট পূর্ববাংলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিরাজ্য পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভের সময় ৩টি ভাষারাজনৈতিক আদর্শ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে। এগুলো—

ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষা,

খ) মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক উর্দু ভাষা এবং

গ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির প্রতীক ইংরেজি ভাষা।

মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যুদয়কালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব সমগ্র ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক ইসলাম ধর্ম ও উর্দু ভাষার মাধ্যমে সমস্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তান রাষ্ট্র সমাজে আত্তীকরণে প্রয়াসী ছিলো। কিন্তু উর্দু ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির এই আত্তীকরণ প্রয়াসের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটে। এই বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এবং পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে।

পরে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের গণপরিষদে গৃহীত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দু ভাষার সাথে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উর্দু ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে হাওয়া জোগায়। কিন্তু বাঙালি সমাজে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ হিসেবে প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায় ইংরজি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ কালপর্বে সংঘটিত ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের প্রণোদনায় পরবর্তীকালে যথাক্রমে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং এর পরম্পরায় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। অতঃপর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলা ভাষার অনুকূলে নিম্নরূপ ঘোষণা প্রদান করেন,

‘...আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে। বাংলাভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা চালু করবেন, তারপরে বাংলাভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা চালু করে দিব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে’।

এভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে অধিষ্ঠিত সরকার শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী ছিল। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাব্যবস্থায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে এবং ইংরেজি ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সকল বিদেশি ভাষার সমান শিক্ষার সুযোগ রেখে শিক্ষাব্যবস্থা সাজায়।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায় প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যা করে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর মুক্তিযু্‌দ্ধে পরাজিত নেতৃত্ব ও নীতিভ্রষ্ট বামপন্থী নেতৃত্বের সহায়তায় সামরিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং কখনও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ও কখনও গণতন্ত্রের আভরণে এই সামরিক সরকার ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে।

সামরিক শাসন কালপর্বের ১৫ বছর সামরিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রতি যত্নবান ছিল। এর প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ তারিখে সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ কর্তৃক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তারিখে জারিকৃত দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপনের পক্ষে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ জারিকরণের বিষয়। এই আইনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে (৩ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা) পূর্ণরূপে কার্যকর করবার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইন।

এই আইন প্রণয়নের পর থেকে জাতীয় সংসদের সকল আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নথি, চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে বাধ্যতা আরোপিত হয়। সে অনুযায়ী বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল বেআইনি ও অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের আপামর সকল জনগণকে তাদের নিজেদের ভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়নের পথে ঔপনিবেশিক ভাষিক বাধা দূরীভূতকরণে আইনটির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সুপ্রিম কোর্টে আইনটি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।

জানুয়ারি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কালপর্বে সংঘটিত ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

সামরিক সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পর গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এর পর থেকে দেশে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারকে বাদ দিলে, এ কালপর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথাক্রমে ৩ মেয়াদে ও ২ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এ সময়ের মধ্যে দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে নতুন ধারার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। নতুন বিকশিত এই রাজনৈতিক শক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, ফলশ্রুতিতে এই শ্রেণির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপন্থি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের উন্মেষ ঘটে।

এই নতুন রাজনৈতিক শক্তি শিক্ষানীতিতে পুনঃপুনঃ পরিবর্তনের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষাকে সর্বাত্মক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এই নব্যরাজনৈতিক শক্তি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে চালু করে এবং পরবর্তীতে যথাক্রমে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতির মাধ্যমে English version School এবং English medium বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। শিক্ষানীতিতে পুনঃপুনঃ পরিবর্তনের ফলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলো সূচিত হয় তা নিম্নরূপ

ক) ইংরেজি-বাংলা দ্বি-ভাষিক স্বাক্ষরতা বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন

খ) প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্বাক্ষরতা ইংরেজি কোর্সের প্রবর্তন

গ) ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড ও জিইডি ইত্যাদি বিদেশি কারিক্যুলামে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন

ঘ) শিক্ষার সকল স্তরে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন

এই কালপর্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষার পক্ষে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি কেবলমাত্র একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো ভাষা-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। বাংলা ভাষার পক্ষে যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করে তা হলো— উচ্চ আদালত কর্তৃক বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেনো দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর-প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ।

ভাষারাজনৈতিক আদর্শিক বিবর্তনের নেতিবাচক ফল

বাঙ্গালী জাতি ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া বিভক্তির সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক, মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতীক ও ব্রিটিশ রাজের ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হিসেবে যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি— এই ৩টি ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিল। বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর আশা করা হয়েছিল, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকবে।

কিন্তু গত ৭৬ বছরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষারাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেই জাতীয়তাবাদী ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। এসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি উদ্ভবের পেছনে যে ভাষারাজনৈতিক আদর্শ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তা বিস্মৃত হয়েছে। তারা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উর্দু ভাষারাজনৈতিক আদর্শের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক অবশেষ হিসেবে রেখে যাওয়া ইংরেজি ভাষিক ভাষারাজনৈতিক আদর্শ এসব রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিকাশের প্রক্রিয়ায় পুনরুজ্জীবন ঘটেছে।

এর নিদর্শন দেখা যায় যখন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা লাভের পরও, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠা না করে, ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়।

ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলে দেশে এখন একটি সর্বব্যাপী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা ও যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি সাক্ষরতা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা লাভের কারণে মানুষের মধ্যে ভাষিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। অধিকন্তু যুগপৎ বাংলা-ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণজনিত অনাসৃষ্টি বাংলিশ সৃষ্টি করছে। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও বাংলা ভাষা— এই উভয়ই কলুষিত হচ্ছে। সমাজের একটি অংশের মানুষের বাঙালি হিসেবে সামাজিকীকরণ ঘটছে না, পরিণামে তারা বাঙালি সমাজে বিআত্তীকৃত রয়ে যাচ্ছে।

বিআত্তীকৃত এই জনগোষ্ঠী থেকে সঞ্জাত নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য চিন্তা, মনন ও মূল্যবোধ ধারণ করছে। এই প্রজন্মটি না বাঙালি না ইংরেজ হিসেবে গড়ে উঠছে। বস্তুত জাতীয় বাজেট দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি শিক্ষা দ্বারা বাঙালি জাতি বিবাঙালিআয়ন প্রক্রিয়া ও বাংলা ভাষা দূষণ প্রক্রিয়া— এই দ্বিবিধ প্রক্রিয়াধীনে নিপতিত হয়েছে। জ্ঞানীয় কর্মকাণ্ড ইংরেজি ভাষায় লিপিবদ্ধায়তি হচ্ছে বিধায় ইংরজি ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু বাংলা ভাষা অসমৃদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক বাংলা ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।

বিভিন্ন কালপর্বে রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক গৃহীত ভাষিক কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট, দেশে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শের ব্যাপক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার চেয়ে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো; জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা

‘অসিম ওর ছোট্ট বাচ্চাগুলোকেও ছেড়ে গেল’

কলেজশিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

স্ত্রীর দাবিতে তরুণীর অনশন, পালালেন আরিফ

মানিকগঞ্জে চিরনিদ্রায় শায়িত পাইলট রিফাত

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা / ‘সি’ ইউনিটে পাবিপ্রবিতে উপস্থিতি ৮৩.১৮ শতাংশ

‘ব্যাড গার্লস’-এ তানিন সুবহা 

চুরি ঠেকাতে রাত জেগে পাহারা, সড়কে চেকপোস্ট

নড়বড়ে সেতু, ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল

দেশে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট নির্মাণের কাজ চলছে : প্রধানমন্ত্রী

১০

আসছে অর্ণববের নতুন অ্যালবাম

১১

জনের সঙ্গে বিপাশার প্রেম নিয়ে মুখ খুললেন ডিনো (ভিডিও)

১২

দেড় মাস ধরে নষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডিজিটাল এক্সরে মেশিন

১৩

টঙ্গী যাবে মেট্রোরেল

১৪

ভাবিকে হত্যায় দেবরের ফাঁসি

১৫

সন্ধ্যার মধ্যে ঝড়ের আভাস, ৪ জেলায় সতর্কসংকেত

১৬

জাতিসংঘে উঠছে ফিলিস্তিনের সদস্যপদের আবেদন, আসতে পারে সুখবর

১৭

আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য : প্রধানমন্ত্রী

১৮

৮ বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস

১৯

দ্রাবিড়ের বদলে ভারতীয় দলে বিদেশি কোচ!

২০
X