সেই দিনটি / শওকত আলী
শওকত আলী রাজনীতিক ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম ভাষাসংগ্রামী। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা, যা পরে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত। তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের মুখ্য সংগঠক ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ১৫০ মোগলটুলীর বাসস্থানটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। শওকত আলী ১৯১৮ সালের ২০ এপ্রিল পূর্ববাংলা ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শমসের আলী ছিলেন এলাকায় একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মা মেহেরুননেসা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। শওকত আলী তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ‘তমদ্দুন মজলিশের রাষ্ট্রভাষা উপকমিটি’ নামে গঠিত হয়। শওকত আলী এই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলী। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট তিনি মারা যান।
২০ এপ্রিল, ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর দুঃসময়ের বন্ধু, কিংবদন্তি রাজনীতিক শওকত আলী
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে লেপ্টে থাকা এক উজ্জ্বল নাম শওকত আলী। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ছিল এই ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ১৫০ মোগলটুলির বাড়িটি। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি, সেই দুঃসময়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শওকত আলী। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, দেশ ও জাতির জন্য শওকত আলীর অপরিসীম আত্মত্যাগের কথা তরুণ প্রজন্ম খুব একটা জানে না। ১৯১৮ সালের ২০ এপ্রিল পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আমার বাবা শওকত আলী। ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুলে পড়াকালীন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এক সময় গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। আরও পরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।   তরুণ বয়সে শওকত আলী চলে আসেন পুরান ঢাকার ১৫০ চক মোগলটুলীতে এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি চর্চার সূতিকাগার, প্রগতিশীল মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মীদের পার্টি হাউস, পাকিস্তান আন্দোলনের ঘাঁটি। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই ভবনের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমেই উঠেছিলেন বন্ধু শওকত আলীর ১৫০ চক মোগলটুলীর বাড়িতে এবং বছর কয়েক সেই বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেন।  প্রথম যেদিন বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে আসেন, সেদিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই শোনা যাক— ‘১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কী যে করবে ভেবে পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।’ (অসামাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৮৩)। তৎকালে লীগ অফিস নামে অধিক পরিচিত ছিল বাড়িটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, অলি আহাদ, কমরুদ্দিন আহমেদ, মো. তোয়াহা, খালেক নেওয়াজ খাঁন, এম এ ওয়াদুদ প্রমুখ নেতারা শওকত আলীর এই বাড়িতে বসবাস করতেন। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। শওকত আলী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বঙ্গবন্ধুর ঝড়-ঝঞ্ঝাময় জীবনে ঢাল হয়ে ছিলেন আমৃত্যু। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনগুলো যাদের শ্রমে-ঘামে-অর্থে আজকের মহীরূহুতে পরিণত হয়েছে সেই অল্প কয়েকজনের একজন শওকত আলী।  শুরুতে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন শওকত। আওয়ামী লীগ গঠনে তার ত্যাগ ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু নিজেও একাধিকবার সেই ‘ঋণের’ কথা বলেছেন।  ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলিস্থ রোজ গার্ডেন প্যালেসে নতুন দল গঠনে কর্মী সম্মেলনের আহবান করা হয়। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে ১৫০ চক মোগলটুলিতে প্রস্তুতিমূলক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শওকত আলী।  বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসে সেই খবর পাই। ১৫০ মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১২০)। ২৩ জুনের সম্মেলনের আগে মওলানা ভাসানীকে গ্রেপ্তার করা হবে, এরকম একটা খবর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন দল গঠন হচ্ছে আর এ সময় যদি ভাসানীকে গ্রেপ্তার করা হয় তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন রাতের অন্ধকারে কম্বল পেঁচিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে সম্মেলন শুরুর দুদিন আগে ভাসানীকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যাওয়ার মূল নায়ক ছিলেন এই শওকত আলী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা বৈরিতার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন শওকত আলী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই হরতাল সফল করতে শওকত আলীর অবদান অনস্বীকার্য। পিকেটিংয়ের একপর্যায়ে পুলিশের আইজিকে সচিবালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে। আটক হয়ে জেলেও ছিলেন। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। একই সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, শওকত আলী সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।  ভাষা আন্দোলন করার সময় সবচেয়ে বেশি পুলিশী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন শওকত আলী। ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে তিনি গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। বন্ধু শওকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে তৎক্ষনাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে রিকশায় করে  হাসপাতালে নিয়ে যান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল, জনসভা, ছাত্রসভা, পিকেটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে শওকত আলী সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে শওকত আলী ২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে গ্রেপ্তার হন এবং বহুদিন জেলে আটক ছিলেন। লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারী এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন। বড় পদ বা ক্ষমতার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। শওকত আলী জাতির একজন গর্বিত সন্তান। ৪০-এর দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় শওকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। চরম দুঃসময়ে তিনি সার্বক্ষণিক দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন এবং সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। সেই সময় সবার মুখে মুখে তিনি ‘দুর্ভিক্ষ শওকত’ নামেই বেশি পরিচিতি পান। বয়োজ্যেষ্ঠ পুরান ঢাকাবাসী এখনো তাকে ‘দুর্ভিক্ষ শওকত’ নামেই চেনে।  বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু শোকে তার ঠিক দুদিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন শওকত আলী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদে শওকত আলী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে শওকত আলীর কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অবদানের জন্য ২০১১ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০১০ সালে জাতির এই গর্বিত সন্তানের নামে ধানমন্ডিস্থ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করে। লেখক : শওকত আলীর সন্তান
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

কর্নেল শওকত আলী ইতিহাসের নায়ক ছিলেন
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, কর্নেল (অব.) শওকত আলী ছিলেন ইতিহাসের নায়ক। সাচ্চা দেশ প্রেমিক ও গণমানুষের নেতা। সে কারণে শরীয়তপুরের মানুষ তাকে ছয়বার ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আসামি সাবেক ডেপুটি স্পিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) শওকত আলীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন। জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে জাতীয় বীর কর্নেল (অব.) শওকত আলী স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ও রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। কর্নেল শওকত আলীর দর্শন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমতাভিত্তিক সমাজবিষয়ক এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। অ্যাডভোকেট মেরিনা শওকত আলীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মরহুমের স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাজেদা শওকত আলী, সংসদ সদস্য এরোমা দত্ত, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. এ বি এম ফারুক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মোহাম্মদ সীমন, ফিরোজ শওকত আলী ও ডা. খালেদ শওকত আলী।
১৫ নভেম্বর, ২০২৩
X