মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৬ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর দুঃসময়ের বন্ধু, কিংবদন্তি রাজনীতিক শওকত আলী

ছবি : পুলিশের লাঠি চার্জে আহত শওকত আলীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, ১১ মার্চ, ১৯৪৮। ছবি : সংগৃহীত
ছবি : পুলিশের লাঠি চার্জে আহত শওকত আলীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, ১১ মার্চ, ১৯৪৮। ছবি : সংগৃহীত

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে লেপ্টে থাকা এক উজ্জ্বল নাম শওকত আলী। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ছিল এই ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ১৫০ মোগলটুলির বাড়িটি। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি, সেই দুঃসময়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শওকত আলী। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, দেশ ও জাতির জন্য শওকত আলীর অপরিসীম আত্মত্যাগের কথা তরুণ প্রজন্ম খুব একটা জানে না।

১৯১৮ সালের ২০ এপ্রিল পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আমার বাবা শওকত আলী। ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুলে পড়াকালীন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এক সময় গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। আরও পরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তরুণ বয়সে শওকত আলী চলে আসেন পুরান ঢাকার ১৫০ চক মোগলটুলীতে এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি চর্চার সূতিকাগার, প্রগতিশীল মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ কর্মীদের পার্টি হাউস, পাকিস্তান আন্দোলনের ঘাঁটি। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই ভবনের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমেই উঠেছিলেন বন্ধু শওকত আলীর ১৫০ চক মোগলটুলীর বাড়িতে এবং বছর কয়েক সেই বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেন।

প্রথম যেদিন বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে আসেন, সেদিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধুর বয়ানেই শোনা যাক— ‘১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কী যে করবে ভেবে পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।’ (অসামাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৮৩)।

তৎকালে লীগ অফিস নামে অধিক পরিচিত ছিল বাড়িটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, অলি আহাদ, কমরুদ্দিন আহমেদ, মো. তোয়াহা, খালেক নেওয়াজ খাঁন, এম এ ওয়াদুদ প্রমুখ নেতারা শওকত আলীর এই বাড়িতে বসবাস করতেন। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো।

শওকত আলী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বঙ্গবন্ধুর ঝড়-ঝঞ্ঝাময় জীবনে ঢাল হয়ে ছিলেন আমৃত্যু। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনগুলো যাদের শ্রমে-ঘামে-অর্থে আজকের মহীরূহুতে পরিণত হয়েছে সেই অল্প কয়েকজনের একজন শওকত আলী।

শুরুতে আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন শওকত। আওয়ামী লীগ গঠনে তার ত্যাগ ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু নিজেও একাধিকবার সেই ‘ঋণের’ কথা বলেছেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলিস্থ রোজ গার্ডেন প্যালেসে নতুন দল গঠনে কর্মী সম্মেলনের আহবান করা হয়। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে ১৫০ চক মোগলটুলিতে প্রস্তুতিমূলক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শওকত আলী।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসে সেই খবর পাই। ১৫০ মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১২০)।

২৩ জুনের সম্মেলনের আগে মওলানা ভাসানীকে গ্রেপ্তার করা হবে, এরকম একটা খবর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন দল গঠন হচ্ছে আর এ সময় যদি ভাসানীকে গ্রেপ্তার করা হয় তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন রাতের অন্ধকারে কম্বল পেঁচিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে সম্মেলন শুরুর দুদিন আগে ভাসানীকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যাওয়ার মূল নায়ক ছিলেন এই শওকত আলী।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানা বৈরিতার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন শওকত আলী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই হরতাল সফল করতে শওকত আলীর অবদান অনস্বীকার্য।

পিকেটিংয়ের একপর্যায়ে পুলিশের আইজিকে সচিবালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে। আটক হয়ে জেলেও ছিলেন। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। একই সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে যে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, শওকত আলী সে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

ভাষা আন্দোলন করার সময় সবচেয়ে বেশি পুলিশী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন শওকত আলী। ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে তিনি গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। বন্ধু শওকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে তৎক্ষনাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল, জনসভা, ছাত্রসভা, পিকেটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে শওকত আলী সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অপরাধে শওকত আলী ২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে গ্রেপ্তার হন এবং বহুদিন জেলে আটক ছিলেন।

লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারী এই মানুষটি আজীবন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন। বড় পদ বা ক্ষমতার জন্য তিনি রাজনীতি করেননি। শওকত আলী জাতির একজন গর্বিত সন্তান।

৪০-এর দশকের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় শওকত আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। চরম দুঃসময়ে তিনি সার্বক্ষণিক দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন এবং সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। সেই সময় সবার মুখে মুখে তিনি ‘দুর্ভিক্ষ শওকত’ নামেই বেশি পরিচিতি পান। বয়োজ্যেষ্ঠ পুরান ঢাকাবাসী এখনো তাকে ‘দুর্ভিক্ষ শওকত’ নামেই চেনে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু শোকে তার ঠিক দুদিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন শওকত আলী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদে শওকত আলী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা আন্দোলনে শওকত আলীর কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অবদানের জন্য ২০১১ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০১০ সালে জাতির এই গর্বিত সন্তানের নামে ধানমন্ডিস্থ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করে।

লেখক : শওকত আলীর সন্তান

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরীক্ষার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুচ্ছের ফল প্রকাশ 

গরমে স্বপ্ন-তে পথচারীদের জন্য ফ্রি শরবত বিতরণ

৯ মে হজের প্রথম ফ্লাইট : ধর্মমন্ত্রী

বন্দর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ইসির শোকজ

সাতক্ষীরায় ভুয়া সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের কার্ড দিলেন রিটার্নিং অফিসার

রাতেই ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে যেসব অঞ্চলে

জীবিত থেকেও মৃত রুস্তম আলী

গাছ কাটার সিদ্ধান্তে অনড় বন বিভাগ

জানা গেল এসএসসির ফল প্রকাশ কবে হতে পারে

তীব্র দাবদাহে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ইসির

১০

ঢাকার সিভিল সার্জন হলেন ডা. বিপ্লব কান্তি

১১

সমাবেশের ঘোষণা দিল বিএনপি

১২

ইন্টারনেট-ওটিটি প্লাটফর্মে স্বাধীনতা নিশ্চিতের দাবি

১৩

লোহাগড়ায় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উদ্বোধন করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

১৪

চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট 

১৫

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে মৌলভীবাজারে অর্ধশতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত

১৬

এবি পার্টির স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বক্তারা / দেশে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার সুযোগ নেই

১৭

চাকরি ছেড়ে বসের সামনে ঢোল বাজিয়ে উল্লাস

১৮

দুই লাখের বিল পেতে ৮০ হাজার টাকার ঘুষ!

১৯

ভর্তি উৎসব / কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ ভর্তি ফিতে শতভাগ ছাড় 

২০
*/ ?>
X