স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে
স্তন ক্যান্সার হলো স্তনে উদ্ভূত রোগ, যেখানে স্তনের কোষগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। স্তন ক্যান্সার স্তনের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এটি সাধারণত দুধের নালিগুলোর অভ্যন্তরীণ আস্তরণে বা দুধ গঠনকারী লোবিউলগুলোতে শুরু হয়। সেখান থেকে এটি স্তন বা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্তন ক্যান্সার প্রথমে একই পাশের বগলের গ্রন্থিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে পিণ্ড তৈরি করে যাকে লিম্ফ নোড বলা হয়। অবহেলা করলে স্তন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে হাড়, ফুসফুস, যকৃৎ ও মস্তিষ্কে।
স্তন ক্যান্সারকে প্রারম্ভিক স্তন ক্যান্সার, উন্নত স্তন ক্যান্সার এবং মেটাস্ট্যাটিক স্তন ক্যান্সার হিসেবে বিভক্ত করা হয়।
স্তন ক্যান্সার নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যেও ঘটে তবে খুব কম।
স্তন ক্যান্সারের কারণ
যেসব কারণে স্তন ক্যান্সার হতে পারে সেগুলো হলো—স্থূলতা, ঋতুস্রাবের প্রথম দিকে, দেরিতে মেনোপজ, দেরি অর্থাৎ ৩০ বছরের বেশি বয়সে প্রথম গর্ভাবস্থা, শূন্যতা (সন্তানহীন), সন্তান জন্মদানের জন্য হরমোনাল চিকিৎসা, মেনোপজের জন্য হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা বা থাইমোমার জন্য আগে বিকিরণ থেরাপি, স্তন, ওভারিয়ান ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, বুকের দুধ খাওয়ানোর অনুপস্থিতি, জিনগত মিউটেশন চলমান পরিবারের সঙ্গে উপস্থাপনা, প্লাস্টিক এবং সৌন্দর্য পণ্যে বিপিএ এবং অন্যান্য রাসায়নিক।
স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রারম্ভিক বয়স বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জেনেটিক মিউটেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই রোগীদের ৪০ বছরের আগে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে, তাদের দ্বিপক্ষীয় স্তন ক্যান্সার কিংবা পরিবারে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষ রোগী থাকতে পারে।
প্রাথমিক স্তরে স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণ
স্তন ক্যান্সার হলে স্তনে ব্যথাহীন পিণ্ড, যা স্তনের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এটি স্তন ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ।
এ ছাড়া রোগীদের রক্তাক্ত বা স্পষ্ট স্তনের স্রাব হিসেবে দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো এটি স্তনের স্কেলিং এবং চুলকানি হিসেবেও দেখা দিতে পারে। কদাচিৎ লাল স্ফীত স্তন স্তনে পিণ্ডসহ বা ছাড়া দেখা যায়। রোগীর একই পাশের অ্যাক্সিলাতেও পিণ্ড থাকতে পারে।
স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে আগে থেকেই স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা যেতে পারে।
৪০ বছর বয়স থেকে বার্ষিক ম্যামোগ্রাফির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্তন-ওভারিয়ান ক্যান্সারের উল্লেখযোগ্য পারিবারিক ইতিহাসসহ নারীদের শুরুর দিকে স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন।
প্রারম্ভিক রোগ নির্ণয় বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুহার ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত কমতে দেখা গেছে।
মাসিকভিত্তিতে স্তন পরীক্ষা, স্তন ক্যান্সারের সমস্ত উপস্থাপিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতনতা তৃণমূল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসক দ্বারা সব নারীকে শেখানো উচিত।
স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা হয় ক্লিনিক্যাল স্তন পরীক্ষা, ম্যামোসোনোগ্রাফি এবং সোনোগাইডেড বায়োপসি দ্বারা। ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর, এইচইআর২ রিসেপ্টরগুলোর জন্য বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়। এই রিসেপ্টরগুলোর স্তন ক্যান্সারের আরও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রভাব রয়েছে।
পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি স্ক্যান (পিইটি স্ক্যান) বা হাড়ের স্ক্যানসহ বুক, পেট, পেলভিসের সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের বিস্তার অর্থাৎ মেটাস্ট্যাসিস নির্ণয় করা যেতে পারে।
চিকিৎসা
অধিকাংশ ক্যান্সারের মতো স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় ট্রাইমোডালিটি ট্রিটমেন্ট যার মধ্যে আছে অস্ত্রোপচার, টার্গেটেড থেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপিসহ বা ছাড়া কেমোথেরাপি। রিসেপ্টরের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অধিকাংশ রোগীর দীর্ঘমেয়াদি হরমোনাল থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে।
প্রতিরোধ
স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে জ্ঞান বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পারি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এটি হয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা এটিকে এড়াতে পারি কারণ এটি বাড়ছে মহানগরগুলোতে এবং প্রধানত জীবনধারার পরিবর্তনের কারণে।
অনেক নারীই দেরিতে বিয়ে করেন এবং দেরিতে সন্তান ধারণ করতে পছন্দ করেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বুকের দুধ খাওয়ানো এড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন। আবার অনেকে মেনোপজ এবং সন্তান ধারণের জন্য হরমোন প্রতিস্থাপন করেন। এ বিষয়গুলো নারীদের হরমোনের পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায়, যা ক্যান্সারের বিকাশের দিকে পরিচালিত করে। এই অভ্যাসের পরিবর্তন রোগটির বিস্তার কমাতে সাহায্য করতে পারে।
স্থূলতা বৃদ্ধি, মিষ্টি খাবার এবং জাঙ্ক ফুড খাওয়া, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং ধূমপান এই ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলো হরমোনের ভারসাম্যহীনতার দিকে পরিচালিত করে।
তাই কিছু পরিমাণে পরিবেশগত এবং জীবনধারা পরিবর্তন স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
ধারণা এবং বাস্তবতা
১. স্তন ক্যান্সার শুধু নারীদের হয় না, পুরুষদেরও হতে পারে।
২. প্রাথমিক স্তরে শনাক্ত করা গেলে স্তন ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
৩. প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে স্তন সংরক্ষণ অস্ত্রোপচার সম্ভব। সব রোগীর স্তন অপসারণের প্রয়োজন হয় না।
৪. স্তন সংরক্ষণের পর স্তনে ক্যান্সার থেকে যায় না। স্তন সংরক্ষণ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সমস্ত টিউমার অপসারণ করা হয়।
৫. সম্পূর্ণ স্তন অপসারণের পর রোগীর নিজের টিস্যু থেকে স্তন পুনর্গঠন করা সম্ভব এবং স্তন পুনর্গঠনের সেরা সময় হলো টিউমার অপসারণের সময়।
৬. স্তন ক্যান্সার নিরাময়ে শুধু অস্ত্রোপচারই যথেষ্ট নয়। রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সব চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন—অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি।
লেখক: কনসালট্যান্ট, সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, ওকার্ড হাসপাতাল, মুম্বাই সেন্ট্রাল, ভারত।
মেডিএইডার, ৫৬ লেক সার্কাস, পান্থপথ, ঢাকা ০১৭১৪১১৯৯৯৬।
১১ মার্চ, ২০২৪