সিলেটে পাখির মাংস বিক্রির রমরমা বাণিজ্য, থামাবে কে?
বন্যপ্রাণী আইন ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে সিলেটের জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারের হোটেলগুলোতে বন্যপাখির মাংস বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। প্রায় ৩ যুগ ধরে হোটেলগুলোতে চলছে অতিথি ও বিলুপ্ত প্রজাতির বিভিন্ন পাখির মাংস বিক্রয়ের রমরমা ব্যবসা। ওই জায়গায় পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত পাখির মাংস ভক্ষণের হুলি উৎসব চলেছে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে। পাখির মাংস বিক্রয়কারী ১২টি হোটেলের মধ্যে রয়েছে, জনপ্রিয় ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট, তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট, ভাই ভাই রেস্টুরেন্ট, স্বাধীন বাংলা রেস্টুরেন্ট, মা-বাবার দোয়া রেস্টুরেন্ট, চাচির দোকান, নিউ ড্রাইভার রেস্টুরেন্টে, চুয়াডাংগা রেস্টুরেন্ট, শাহজালাল রেস্টুরেন্ট, সোনার বাংলা রেস্টুরেন্ট, পুরান ড্রাইভার হোটেল ও বিসমিল্লাহ হোটেল। ক্রেতা সেজে হোটেলগুলোর ফোন নম্বরে কল দিলেও বিভিন্ন পাখির দাম জিজ্ঞেস করলে তারা অবলীলায় পাখির মাংসের দাম বলে দেয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই এসব কর্মকাণ্ড চলছে। প্রশাসন অভিযানে আসলে পাখির মাংসকে হাঁস ও কোয়েলের মাংস বলে চালানোর অপচেষ্টা করা হয়। জানা যায়, হোটেলগুলোতে দিনে প্রায় ২০০-৩০০ পিস বন্যপাখীর রোস্ট/রেসিপি বিক্রি করা হয়। পাখি ভেদে পাখির মাংসের মূল্য ১০০-৩০০ টাকা প্রতি পিস রাখা হয়। স্থানীয় শিকারি চক্রের কাছ থেকে ওই পাখিগুলো গোপনে ক্রয় করে হোটেল মালিকরা। অল্প খরচে অধিক লাভ করার লোভে শিকারিরা বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিও। এ পর্যন্ত স্থানীয় বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনে মোবাইল কোর্ট কমবেশি ৩ বারের মতো অভিযান করেছেন। স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপের অভাবে হোটেলগুলোকে পাখি মাংস বিক্রয় করা কোনোভাবেই বন্ধ করানো যাচ্ছে না। জৈন্তাপুর মডেল থানার ওসি তাজুল ইসলাম জানান, ওগুলো হাঁস ও কোয়েলের মাংস। যদি বন্যপাখি বিক্রয়ের কোনো আলামত পাওয়া যায় তবে আমরা ইউএনও স্যারকে নিয়ে অবশ্যই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব। জৈন্তাপুর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলাম জানান, পাখির মাংসকে হাঁসের মাংস বলে বিক্রি করাও একধরনের প্রতারণা। আমাদের একটি অভিযানে হোটেলসমূহের কিছু মাংস ল্যাব টেস্টের জন্য ঢাকা পাঠালে সেগুলা হাঁসের মাংস হিসেবেই রিপোর্ট আসে। তবে পাখি বিক্রয়ের হাতেনাতে প্রমাণ পেলে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হরিপুরে পাখির মাংস বিক্রয়ের ঘটনাটা আমরাও জানি। সীমিত লোকবল দিয়ে আমরা এই চক্রের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। র‍্যাব ও পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দ্রুতই একটি বড় কার্যকর অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করছি। পাখিপ্রেমিক সোসাইটি নামে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বন ও পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিকবার অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক বিশ্বজিৎ পাল। বন্যপাখিদের ওপর এই ক্রমাগত অমানবিক নির্যাতন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। পাখিপ্রেমিক সোসাইটির উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মো. আব্দুল আজিজ রাসেল হরিপুরের পাখি নিধন বন্ধে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন ফোরামে হরিপুরের পাখি হত্যা বন্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি। বন অধিদপ্তর এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আমরা উচ্চতর আদালতে রিট করতে বাধ্য হব। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৩৮(২) ও ৪১ ধারা অনুযায়ী পাখি হত্যা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইন লঙ্ঘন করলে ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ২ বছরের জেলের বিধানও রয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদেও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা আছে।
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
X