আগুন ঝরা গরমে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশজুড়ে তাপপ্রবাহে ঘরে-বাইরে সবখানেই কাতর সবাই। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ যেন গনগনে আগুন। তাপপ্রবাহ বইছে দেশের ৪৯ জেলায়। বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিসকার নামাজ আদায় করা হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চলতি এপ্রিল মাসে টানা যতদিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরেও হয়নি। হিটস্ট্রোক ও গরমজনিত রোগে এবার অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর যে রেকর্ড হয়েছে, তা-ও অতীতে কোনোকালে হয়নি।
এদিকে চতুর্থ দফায় জারি করা হিট অ্যালার্ট বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহের তীব্রতা আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতিদিন বাড়বে। তারপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। মে মাসের প্রথমার্ধে সিলেট এবং পার্শ্ববর্তী হাওরাঞ্চল পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আবারও মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে চুয়াডাঙ্গা। পশ্চিমের এ জেলায় ২৭ দিন ধরে ‘মরুভূমির লু হাওয়ার’ মতো পরিস্থিতি। চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১১ শতাংশ। সেখানে ‘অনুভূত’ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি। এর আগে গত শনিবার মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল যশোরে। ওই দিন চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া পাবনার ঈশ্বরদী ও রাজশাহীতে ৪২ দশমিক ৪, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪১ দশমিক ৮, যশোর ও বগুড়ায় ৪০ দশমিক ৮, টাঙ্গাইলে ৪০ দশমিক ৬ ও বাগেরহাটের মোংলায় তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৪৮ সাল থেকে তাদের কাছে বিভিন্ন স্টেশনের আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত আছে। তবে সব বছরে সব স্টেশনের উপাত্ত নেই। উপাত্তগুলো একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে আছে ১৯৮১ সাল থেকে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ১৯৪৮ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহ হয়েছে এবারের এপ্রিল মাসে। এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা টানা ছিল না। কিন্তু এবার টানা ২৭ দিন তাপপ্রবাহ হলো।
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, ১৯৪৮ সালের পর এই ভূখণ্ডে এটাই সর্বোচ্চ টানা তাপপ্রবাহ। তবে এই ২৭ দিনের পুরো সময়ে সারা দেশের সর্বত্রই সমান হারে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়নি। ৩১ মার্চ থেকে শুরু করে ১১ এপ্রিলের পর্যন্ত দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। সে সময় তা খুব বেশি এলাকায় ছড়িয়ে যায়নি। এরপর ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কয়েকটি অঞ্চলে তাপপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ এপ্রিল থেকে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়, যা দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে টানা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে ব্যাপ্তিকাল কম থাকায় তাপপ্রবাহ বড় সমস্যার কারণ হয়ে ওঠেনি। আগামী বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল ও প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ৪৩ বছরের মধ্যে যশোরে তাপপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি দিন ঘটেছে। এর পরই আছে ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা।
আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এবারের তাপপ্রবাহ দেশের ৭৫ ভাগেরও বেশি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা নজিরবিহীন। ২০১৯ সালে চুয়াডাঙ্গায় এপ্রিল মাসে টানা ২৩ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। গত বছর এপ্রিলে টানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। তখন তাপপ্রবাহ এত ব্যাপক পরিসরেও ছিল না। ১৯৬৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস যশোরে। আর ১৯৮৯ সালে বগুড়ার তাপমাত্রা হয়েছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত বছর সারা দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ঈশ্বরদীতে। সে বছরের ১৭ এপ্রিল সেখানে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এর আগের ৮ বছরে অতি তীব্র তাপমাত্রার রেকর্ড নেই। তবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯৭২ সালের ১৯ মে। সেদিন রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।
গত ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরের যে কোনো মাসের চেয়ে এপ্রিল তুলনামূলক অনেক বেশি উষ্ণ ছিল। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে সাতবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এপ্রিল মাসে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ২৯ এপ্রিল রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৮ দশমিক ৫, ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল রাজশাহীতে ৪০ ডিগ্রি, ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি ও ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এরপর ২০২২ সালে আবারও এপ্রিলের ১৫ তারিখে রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গত ২০ এপ্রিল জেলাটিতে তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের স্থানিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে সূর্যের কাছে থাকে, যে কারণে সূর্যের তাপ বেশি পড়ে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে সূর্য সাধারণত একদম খাড়া অবস্থায় চলে আসে। সূর্য যত খাড়াভাবে আলো দেবে, তত বেশি তাপ অনুভূত হবে।
তিনি বলেন, দেশে পশ্চিমা বাতাস আসলে আর্দ্রতা কমে যায়। অন্য দিকে দক্ষিণ-পশ্চিমা বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। ঢাকা ও খুলনার দিকে আর্দ্রতা কম থাকে। আর বেশি থাকে চট্টগ্রাম ও বরিশালের দিকে। দেশের ওপরের দিকে যত যাবে, আর্দ্রতা তত কমে যাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, বগুড়া, বাগেরহাট, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, বান্দরবান জেলাসহ রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল বিভাগসহ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।
টানা অন্তত দুদিন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তা তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকতে পারে। বর্ধিত পাঁচ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ সময়ের শেষের দিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।
এদিকে, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় হিটস্ট্রোকে রাসেদুল ইসলাম নামে এক সংবাদপত্র বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল উপজেলার চামটাহাট বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তার বাড়ি হাতীবান্ধা উপজেলায়। স্থানীয়রা জানান, রাসেদুল দুপুরে চামটারহাটে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার শেষে আচমকা মাটিতে লুটে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে তিনি মারা যান। এ ছাড়া নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় হিটস্ট্রোকে ইয়াসিন নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার চানপুর ইউনিয়নের সওদাগরকান্দির এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চানপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেন সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শিশু ইয়াসিন উপজেলার চানপুর ইউনিয়নের সওদাগরকান্দি গ্রামের প্রবাসী এনামুল হকের ছেলে।
হাওরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা: মে মাসের প্রথমার্ধে পাহাড়ি ঢলে হাওরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, একটি শক্তিশালী পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে মে মাসের ৩ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলার ওপর দিয়ে শক্তিশালী কালবৈশাখী, তীব্র বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। পশ্চিমা লঘুচাপটির প্রভাবে মে মাসের ৩ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো এবং মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার ওপরে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইন্টিগ্রেটেড ফোরকাস্ট সিস্টেম মডেল অনুযায়ী এমন ধারণা করছি।
তিনি জানান, সম্ভাব্য এ বৃষ্টির পুরোটাই সিলেট বিভাগের বিভিন্ন নদনদীতে প্রবাহিত হয়ে সিলেট বিভাগের নিচু হাওর এলাকাগুলোকে প্লাবিত করবে। অন্যদিকে মে মাসের ৫ তারিখের পর থেকে পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেট বিভাগ ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার এবং বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে ৫০ থেকে ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টি হতে পারে খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে।
মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, পূর্বাভাসের উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন দুর্যোগ সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন হন। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলার প্রথম ধাপ এটি। এরপর যদি পূর্বাভাস শতভাগ সঠিক না-ও হয়, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু দুর্যোগের প্রস্তুতি না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা মোকাবিলা করতে হাওরবাসীর প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।