ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ হলেও পুরোপুরি যানজটমুক্ত হতে পারেনি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে নগরবাসীর গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করা বড় বড় ট্রাক-লরির অব্যবস্থাপনাই এর বড় কারণ। এসব ট্রাক-লরি চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকতে ও বের হতে যে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ায়, তার জন্যই সড়কজুড়ে লেগে থাকে জট। এই জটে প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাজার হাজার পরিবহন ও লাখ লাখ মানুষকে।
এসব বিবেচনায় এবার নতুন এক সিস্টেম চালু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। যার মাধ্যমে কমতে পারে চট্টগ্রাম নগরের যানজট। চলতি মাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে চালু হচ্ছে ডিজিটাল গেট ফি সিস্টেম। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে একজন চালক বন্দরে না এসেও বাড়িতে বসে দিতে পারবেন গেটের ফি। তা দেখিয়ে মিনিটের মধ্যেই প্রবেশ করতে পারবেন বন্দরে। ফলে সড়কে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে না হওয়ায় কমে যাবে যানজট।
বন্দর কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, এই পদ্ধতি সঠিকভাবে ব্যবহারের ফলে সড়কে যেমন যানজট কমবে, তেমনি বন্দরের কার্যক্রমেও গতি ফিরবে। পাশাপাশি কমে যাবে পণ্যবাহী যানবাহনের জটও।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলে বন্দরের গেট ফি দেওয়ার কার্যক্রম ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০২১ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু নানা জটিলতায় গাড়ি প্রবেশের এই ডিজিটাল কার্যক্রম এতদিন সফল হয়নি। তবে তিন বছর পর আবারও গতি পেয়েছে এই কার্যক্রম। গাড়ি প্রবেশ সিস্টেম ডিজিটাল করতে বন্দরে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত প্রায় এক লাখ ট্রাকচালক ও হেলপারের ছবি দিয়ে সফটওয়্যারে তথ্য নিবন্ধন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে প্রতিদিন প্রায় আট হাজার গাড়ি প্রবেশ করে এবং বের হয়। বর্তমানে বন্দর গেটে এসে হাতে হাতে (ম্যানুয়ালি) এ ফি পরিশোধে সময় লাগে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। নতুন ডিজিটাল ব্যবস্থায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বন্দর গেটে আসার আগে যে কোনো স্থান থেকে এন্ট্রি ফি পরিশোধ করতে পারবেন গাড়ির চালকরা। টাকা পরিশোধের কাগজপত্র দেখিয়ে এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে বন্দরে প্রবেশ করতে পারবেন গাড়ি নিয়ে। বর্তমানে প্রতিটি গাড়ি বন্দরে প্রবেশে ফি দিতে হয় ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। নতুন নিয়মে প্রবেশ ফি একই থাকবে বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালিত হয় টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেমের (টিওএস) মাধ্যমে। টস সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত হবে এই ডিজিটাল গেট ফি সিস্টেম। ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের কম্পিউটারাইজড কনটেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিটিএমএস) উদ্বোধনের মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর। পরে সিটিএমএসকে আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (টিওএস) করা হয়। ২০২১ সালে টিওএস অনলাইন পেমেন্ট ফর গেট টিকিট চালু হলেও চালক ও হেলপারদের অনলাইনে গেটপাস নেওয়া এবং পেমেন্ট দেওয়ার বিষয়টি পরিচিত করতে সময় লেগেছে।
ডিজিটাল এই ফি পদ্ধতি নিয়ে ধারণা দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (সিকিউরিটি) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রথমত ব্যবহারকারীরা বাসায় বসেই এই ফি পরিশোধ করতে পারবেন, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার প্রয়োজন হবে না। ফলে ব্যবহারকারীদের পরিশ্রম ও সময় দুটোই বাঁচবে। আগে রাস্তায় গাড়ি রেখে চালক গেটে গিয়ে টিকিট কাটতেন। এতে দীর্ঘ যানজট লেগে যেত। যেহেতু এখন সেখানে টিকিট কাটতে হবে না, ফলে রাস্তারও চাপ এখন কমে যাবে। এ ছাড়া অনেক সময় একটা অভিযোগ আসত, নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। অতিরিক্ত ফি নেওয়ার যে অভিযোগ উঠত, তা এখন আর আসবে না।
তিনি আরও বলেন, বন্দর সংশ্লিষ্ট এলাকায়ও যানবাহনের চাপ কমে যাবে। দেখা গেছে, বন্দরের বাইরেও গড়ির জট হওয়ার কারণে ভেতরে গাড়ি আটকা পড়ে গেছে, গাড়ি বের হতে পারছে না। নতুন এই পদ্ধতির ফলে বন্দরের গতিশীলতা বাড়বে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দীর্ঘ যানজট যেহেতু লেগেই থাকত, তাই নির্ধারিত সময়ের আগে চালকরা চলে আসতেন। কিন্তু এখন সেটা অনেকখানি কমে আসবে। এরই মধ্যে আংশিকভাবে ডিজিটাল এন্ট্রি চালু হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে পুরোপুরি চালু করা যাবে।
ডিজিটাল গেট ফি সিস্টেমের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, গেট ফি ডিজিটাল করা আসলে বড় কোনো প্রকল্প নয়। চট্টগ্রাম বন্দরের অটোমেশন প্রকল্পে ৩০টির মতো মডিউল রয়েছে। এ কাজটি কনটেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিটিএমএস) একটি সাধারণ মডিউল। এই সিস্টেমটি তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য তেমন খরচ হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কিছু গেটে এই প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। সিঅ্যান্ডএফদের এই কাজ অ্যাসাইন্ট করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে যেহেতু ফি দেওয়ার বিষয়টি অনলাইনে হবে, তাই এখানে কোনো ধরনের জালিয়াতি কিংবা অতিরিক্ত ফি আদায়ের সুযোগ থাকবে না। যেই গাড়ির যখন প্রয়োজন তখনই গেটে এসে ঢুকতে পারবে।
আর্কাইভ 
| ২১ জুন ২০২৫ 