‘সনাতনীরা না থাকলে এই দেশ আফগানিস্তান-সিরিয়া হবে’ মন্তব্য করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী বলেছেন, ‘যদি এই দেশ থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে কেউ শান্তিতে থাকতে চান, তাহলে এটা আফগানিস্তান-সিরিয়া হবে, গণতান্ত্রিক শক্তি থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য হবে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের গণসমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী বলেন, ‘যেই মঞ্চ থেকে ছয় দফা দাবি ঘোষিত হয়েছে, সেই লালদীঘির ময়দানে আজ হিন্দু সনাতনীদের গণজোয়ার এসেছে। আমাদের যত বেশি নির্যাতন করা হবে, তত বেশি আমরা এক হবো। এই ঐক্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বাংলার কৃষ্টিকালচারের ঐক্য। এই ঐক্য কোনোভাবে খণ্ডিত করা যাবে না।’ আট দফা দাবি আদায়ে এরই মধ্যে ১৯ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জন হিন্দুকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ভেটেরিনারি, চবিতে হিন্দুদের শনাক্ত করা হচ্ছে। যারা রাজনীতি করে না, মানবতার কথা বলছে, তাদের মামলার আসামি করা হচ্ছে।’ সংখ্যানুপাতিক হারে হিন্দুদের সংসদে আসন বিন্যাস করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ভোট বর্জন করব, গণতন্ত্রের নামে প্রহসন চাই না।’ ১৫ হাজার কোটি টাকা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের মাত্র ২০০ কোটি টাকা সংখ্যালঘুদের জন্য কেন—এমন প্রশ্নও রাখেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী।
এ সময় তিনি দেশের প্রতিটি জেলায় মহাসমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জেলায় জেলায় সমাবেশের পর ঢাকা অভিমুখে ‘লংমার্চ’ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী মন্দির, হিন্দু বাড়িঘরে হামলা, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগের প্রতিবাদে এবং আট দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণসমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চ। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এ গণসমাবেশে চট্টগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলা, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলা থেকে সনাতনীরা মিছিল নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এতে লালদীঘির মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গণসমাবেশ হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য।
সনাতনীরা ‘একদফা এক দাবি, আট দফা মানতে হবে’, ‘প্রশাসন নীরব কেন? জবাব চাই দিতে হবে’, ‘আমার মায়ের কান্না... বৃথা যেতে দেব না’, ‘আমার দেশ সবার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘অমার মাটি আমার মা, এই দেশ আমরা ছাড়ব না’, ‘রক্তে আগুন লেগেছে, সনাতনীরা জেগেছে’, ‘আমার ঘরে আগুন কেন, জবাব চাই দিতে হবে’, ‘আমার মন্দিরে হামলা কেন, জবাব চাই দিতে হবে’, ‘হিন্দুদের ওপর হামলা কেন? জবাব চাই, দিতে হবে’, ‘বৈষম্যহীন বাংলায়, সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার’, ‘লাখো শহীদের বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শংকর মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ তপনান্দ গিরি মহারাজ। স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীর সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন পটিয়া পাচোরিয়া তপোবন আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ রবীশ্বরানন্দ পুরী মহারাজ, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, বাঁশখালী ঋষিধামের মোহন্ত সচিদানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ মুরারী দাস বাবাজী, তপোবন আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রাঞ্জলানন্দ পুরী মহারাজ প্রমুখ।
অন্য বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সনাতনীরা শুধু অবহেলিত ছিল। সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু সনাতনীদের ভাগ্য বদলায় না। যেই সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা সনাতনীদের দুঃখ দুর্দশাকে লুকানোর চেষ্টা করে; সনাতনীদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়, নির্যাতন লুকিয়ে স্বাভাবিকতার কথা বলে। গত ৫৩ বছরে এ দেশে হওয়া হিন্দু নির্যাতন, খুনের কোনো বিচার হয়নি।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, প্রতিবার ভোট-পরবর্তী বা ক্ষমতার পালাবদলের সময় নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে হিন্দুদের ওপর। সেটা কেন হবে? কারা দোষী? কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত? তাদের আইনের আওতায় আনা হলে তো বেরিয়ে আসবে কারা সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িত? কেন সরকার সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে না।
বক্তারা আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা দুর্গাপূজায় এক দিন ছুটি বাড়িয়েছে। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। আমরা চেয়েছি পাঁচ দিনের ছুটি। সেখানে দুদিন ছুটি কেন? যেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এ দেশের ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছে, সেখানে আবার বৈষম্য হবে কেন? ক্ষতিগ্রস্ত সনাতনীদের ক্ষতিপূরণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করার কথা বলেছে সরকার। এটি খুবই ইতিবাচক। দ্রুত এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
তারা আরও বলেন, এই সরকার যদি সনাতনীদের আট দফা মেনে নেয়, তবে সনাতনীরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। সনাতনীরা আন্দোলন সংগ্রাম করতে জানে, অধিকার আদায়ও করতে জানে। প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি যেন সনাতনীদের জন্য শান্তির একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সেই আশা করব আমরা।
সনাতনীদের আট দফা: সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান; ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; অনতিবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা এবং সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা; বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা; দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করা; প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা রুম বরাদ্দ করা; সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড, আধুনিকায়ন করা এবং দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি দেওয়া।