ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। পিআরসহ ৫ দফা দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহম্মাদ রেজাউল করীম এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে দেশকে স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করা, রাষ্ট্রের পরতে পরতে জমা হওয়া ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সর্বত্র জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ও স্বাধীন করার জন্য মৌলিক সংস্কার করার জন্য এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির শুদ্ধতা আনা ও সব নাগরিকের ভোটের অধিকার, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। অতএব জুলাই পববর্তী বাংলাদেশে ‘সংস্কার-বিচার ও নির্বাচন’ এই ক্রমধারা অনুসরণ করা রক্তের দায় ও অঙ্গীকার। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে, যা দেশকে পুরোনো অশুভ বন্দোবস্তে আবারও নিপতিত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।
চরমোনাই পীর বলেন, দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণ দেখলে মনে হয়, জুলাইয়ের আন্দোলন হয়েছিল কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। আদতে বিগত দিনের রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে, কেবলই নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয়নি।
যুগপৎ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, আমরা যারা জুলাইতে জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, যারা বাচ্চাদের রক্ত ও জীবন উৎসর্গিত হতে দেখেছি, যারা আহতদের রোনাজারি শুনছি তারা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। সেই তাকিদ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং আমরা জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই নানা মাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে আমাদের এই রাজপথের কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে।
জুলাই সনদ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ১৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদও আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো জুলাই সনদ ঘোষণা করা যায়নি। জুলাই সনদ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে কিন্তু আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন, ভবিষ্যৎ স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য আইনি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। একটি নির্দিষ্ট মহল থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা এসেছে। ফলে জুলাইয়ের মূল প্রত্যাশা স্বৈরতন্ত্রকে চিরতরে বিলোপের যে চাহিদা তা পূরণে তেমন প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। এমনকি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে কোনো কোনো সংস্কারের প্রস্তাব জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এখনই সেটা বাতিলযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ফলে জুলাই সনদ কার্যত সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন দলের মতামত দলিলে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রত্যাশা ছিল জুলাই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের দিকনির্দেশনা।
ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও জাপা নিষিদ্ধের বিষয়ে চরমোনাই পীর বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপতৎপরতায় জাতি বিষিয়ে ছিল বিগত ১৫ বছর। এই লজ্জাহীনরা ফ্যাসিবাদের সব অপকর্মের পক্ষ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারা ফ্যাসিবাদের মন্ত্রিসভায় ছিল। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থানের পরে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। দেশের একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের সব দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কোনো স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয় বরং তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।
পিআরের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দলের আমির বলেন, আমরা বারবার বলছি, বিগত ৫৪ বছরে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে সে পদ্ধতি দেশকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। দেশের বর্তমান যা কিছু উন্নয়ন তা ব্যক্তি খাতের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফল। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের ভিত্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নষ্ট করা এবং দুর্নীতি-দুঃশাসনের মাত্রায় প্রতিটি নির্বাচনই দেশকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় ফেলেছে। এমন তিক্ত অতীতের বাস্তবতায় পুরোনো বন্দোবস্তে নির্বাচন করার কোনো অর্থ হয় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাই উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, পিআরের সুবিধা কি তা আমরা বারবার আলোচনা করেছি। কিন্তু অশুভ পুরোনো বন্দোবস্তের কায়েমি স্বার্থবাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে পিআর নিয়ে সরকার যে আচরণ করছে তা দুঃখজনক। আমরা সরকারের এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং পিআর পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
যুগপৎ আন্দোলনের দাবিগুলোকে একত্রে উপস্থাপন করে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, আমাদের দাবি সুস্পষ্ট। আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই, এর আইনি ভিত্তি চাই। জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতেই আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন চাই। দ্রুততার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত দেখতে চাই। ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন বন্ধ করতে চাই। জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিষিদ্ধ চাই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। আমাদের অবস্থান কোনো দলের বিরুদ্ধে না। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই অবস্থান।
যুগপৎ আন্দোলন কোনো দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয় জানিয়ে চরমোনাই পীর স্পষ্ট করে বলেন, এই পরিস্থিতিতে দেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। আমরা সর্বদিক চিন্তা করে এবং জুলাইয়ের রক্তের প্রতি দায়বোধ থেকে সুনির্দিষ্ট এই দাবিগুলো নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একই দাবি নিয়ে যুথবদ্ধ কর্মসূচি পালন করব। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।
যুগপৎ আন্দোলনের দাবি ও কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধারাবহিক কর্মসূচি পালন করব এবং ক্রমান্বয়ে কর্মসূচি কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। এ সময় দলের পক্ষ থেকে ৫ দফা দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো- ১. জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। ২. নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। ৩. সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। ৪. গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হতে হবে। ৫. বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় তাঁবেদার ও ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার করতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে।
দাবি আদায়ের জন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এগুলো হলো- ১. ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল। ২. ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ। ৩. ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশে জেলা/উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল।
মন্তব্য করুন