দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক ও দ্বিকক্ষ সংসদে একমত
জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতির ব্যাপারে একমত রাজনৈতিক দলগুলো। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার পক্ষেও তারা। আর সংসদ বা সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরই বহাল রাখার পক্ষে দলগুলো। অন্যদিকে একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হতে কোনো বাধা না রাখার কথাও বলেছে দলগুলো। টানা দুই মেয়াদের পর বিরতি দিয়ে একই ব্যক্তি ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে তারা। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের আলোকেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। তবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের সুযোগ প্রদানের বিষয়ে এখনো পর্যালোচনা চলছে। ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত জানাতে অনুরোধ করে স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় ঐকমত্য কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কমিশনের সভাপতি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩৫টি দলের কাছ থেকে মতামত পেয়েছে। আর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ২৭টি রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেছে। সূত্র জানায়, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসহ বেশিরভাগ দলই জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রেও ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছে তারা। পাশাপাশি সংসদের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করার পক্ষে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতা করে বেশিরভাগ দলই পাঁচ বছর করার ব্যাপারে মত দিয়েছে। এ ছাড়া নারীর উন্নয়ন ও সংসদে নারী প্রতিনিধি বাড়াতে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১০০-তে উন্নীত করার পক্ষে মত দিয়েছে দলগুলো। ফলে এ চারটি বিষয়ে দলগুলোর ঐকমত্যের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। এ ছাড়া একই ব্যক্তি টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—সংস্কার কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। এ ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ চেয়েছে দলগুলো। ফলে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়টিতেও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে ঐকমত্য কমিশন। অন্যদিকে, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও নির্দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়েও একমত হয়েছে দলগুলো। জানা গেছে, সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের সুপারিশের আলোকে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রায় ৬৯৪টি প্রস্তাবের মধ্যে পাঁচ শতাধিক বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। তবে সংস্কারের কিছু মৌলিক সুপারিশের বিষয়ে একমত হয়নি দলটি। কমিশনের সুপারিশের মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নয়, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া, ন্যায়পাল নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা, বিদ্যমান সংবিধানের ৭(ক) ও ৭(খ) বিলুপ্ত করাসহ বেশিরভাগ বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ আইন, ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন, মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, গণভোট, ৭০ অনুচ্ছেদ, সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন, নারী আসনে সরাসরি ভোট, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন, সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর করা, নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করা এবং একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে না থাকার বিষয়সহ বেশকিছু সুপারিশে বিএনপি একমত হয়নি। সূত্র জানায়, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে বিএনপি ১৪১টিতে একমত হয়েছে। আংশিক একমত হয়েছে ১৪টিতে, মন্তব্যসহ ভিন্নমত দিয়েছে ৬৪টিতে। আর একমত নয় ২৪টিতে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ১৮৭টিতে তারা একমত হয়েছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৮৯টি সুপারিশকে দলটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ৬২টিতে তারা একমত হয়েছে। দুদক সংস্কার কমিশনের ২০টি সুপারিশের মধ্যে একটিতে তাদের আপত্তি আছে। সংবিধান সংস্কারের ১৩১টি সুপারিশের বেশিরভাগের সঙ্গেই দলটি একমত হয়েছে। বিএনপি অবশ্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সে আইনে রাষ্ট্রপতিকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা তারা স্পষ্ট করেনি। দলটি বলেছে, এ বিষয়ে পরবর্তী সংসদে আলোচনা করে তা ঠিক করা হবে। দলটি বলছে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা তাদের অঙ্গীকার। তবে একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না; এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন—এই দুটি প্রস্তাবে একমত নয় দলটি। এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন একটি প্রস্তাব আলোচনায় এলেও তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর করা, সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের অনুমোদনের পর গণভোট করা, জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তাবিত বিধান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নামে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা, সংবিধানে দেশের নাম পরিবর্তন, নিম্নকক্ষে তরুণদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়া, সংসদ নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করার মতো প্রস্তাবগুলোতেও বিএনপি একমত হয়নি। আর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং নিম্নকক্ষে সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টি করার বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তাদের মত ভিন্ন। আরেক প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতেও একমত পোষণ করেছে দলটি। ৭০ অনুচ্ছেদের কিছু সংশোধনীসহ কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে দলটি। সেটি হচ্ছে সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদন এবং আস্থা ভোট ছাড়া বাকি যে কোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য যে কোনো দলের ও মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। দলটির নেতারা এনসিসি প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। কিন্তু পাওয়ার এবং অথরিটির জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন বলে কমিশনকে জানিয়েছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারেও একমত হয়েছেন দলটির নেতারা। অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি ((এনসিপি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া স্প্রেডশিটে থাকা ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১৩টি প্রস্তাবে পুরোপুরি একমত হয়েছে। এ ছাড়া ২৯টি প্রস্তাবে আংশিক একমত এবং ২২টিতে একমত হতে পারেনি দলটি। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় দলটির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে একমত হয়েছেন। একমত হয়েছেন বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগের বিষয়েও। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ব্যাপারে একমত হয়েছেন নেতারা। তারা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থী কারা, তা দলগুলোকে ঘোষণা করতে হবে। কারণ, নির্বাচনে একজন ভোটার একটি দেবেন। সে ক্ষেত্রে তার জানার অধিকার আছে উচ্চকক্ষে কারা যাচ্ছেন। এ ছাড়া ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ এবং টানা দুই মেয়াদের পর প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিষয়েও একমত পোষণ করেছেন দলটির নেতারা। একমত হয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টিতেও। এদিকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (এলডিপি) বিএনপি ও সমমনা জোটের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই প্রায় বিএনপির মতো করে তাদের প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ১০৮টি বিষয়ে একমত, ৩২টি বিষয়ে দ্বিমত এবং ২৬টি বিষয়ে আংশিক একমত পোষণ করেছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাবে একমত, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে আপত্তি, প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থায় দ্বিমত, সংবিধানের সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন ও গণভোটের বিধানকে সমর্থন এবং প্রার্থীর বয়সসীমা ২১-এর পক্ষে লিখিত মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া মতামত সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশে তো আমরা বাকশাল করতে যাচ্ছি না। সবাইকে একমত হতে হবে এমন নয়। কারণ বিভিন্ন দলের বিভিন্ন দর্শন, বিভিন্ন চিন্তা থাকবে, ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে যেখানে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলোর বাইরে সংস্কার করার সুযোগ নেই। যেসব প্রস্তাবে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেই বিষয়গুলো জাতির সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে আশ্বস্ত করতে হবে জাতি গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে, জাতি গণতন্ত্র ফিরে পেতে যাচ্ছে। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আমরা যে কয়টি বিষয়ে একমত হয়েছি তার ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ ১০ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। আমরা জাতীয় সংবিধান কাউন্সিলের প্রস্তাবের সঙ্গেও নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। কিন্তু পাওয়ার এবং অথরিটির জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন। আমরা সেটি বলেছি, উনারাও আলোচনার জন্য অগ্রসর হয়েছেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ব্যাপারে আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি এবং এ ব্যাপারে একমত। তবে আমরা পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের পক্ষে। তার মানে সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন হবে মার্কা বা দলের ভিত্তিতে। সারা দেশে যে দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই পরিমাণে সংসদে আসন নির্ধারিত হবে। এদিকে বেশিরভাগ সুপারিশে বিএনপির সমর্থনের বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য কিছু মৌলিক সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এসব বিষয়ে মতানৈক্য দূর করতে আরও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবনা এবং ঐকমত্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সব দল সব বিষয়ে একমত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হবে সেটি আমলে নিয়েই ঐকমত্য প্রকাশ করে সংস্কার করতে হবে। কিছু সংস্কার বাকি থাকলে তা পরবর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রেখে দিতে হবে। তবেই আমরা এর সুফল পেতে পারি।
৩০ নভেম্বর, ০০০১

৫ কারা তত্ত্বাবধায়ককে সিনিয়র পদে পদোন্নতি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা অধিদপ্তরের পাঁচ কারা তত্ত্বাবধায়ককে সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সুপারিশক্রমে ও রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হাফিজ-আল-আসাদের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে  তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হলেন : কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (চলতি দায়িত্ব) হালিমা খাতুনকে সিনিয়র তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক মোকাম্মেল হোসেন মোল্লাকে সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. শাহ আলম খানকে সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশিক্ষণ ও ক্রীড়া) মো. তায়েফ উদ্দিন মিয়াকে সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক ও নাটোর জেলা কারাগারের কারা তত্ত্বাবধায়ক মোছা. কাওয়ালিন নাহারকে সিনিয়র কারা তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পদে যোগদানের তারিখ হতে এ আদেশ কার্যকর হবে এবং জনস্বার্থে এই আদেশ জারি করা হলো।
১৯ মার্চ, ২০২৫

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রিভিউ আবেদনের শুনানি ৮ মে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা চারটি আবেদনের শুনানি পিছিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৮ মে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। গতকাল রোববার আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক ও এক ব্যক্তি এই চারটি রিভিউ আবেদন করেন। আগের ধারাবাহিকতায় পুনর্বিবেচনার আবেদনগুলো রোববার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১৮ নম্বর ক্রমিকে ওঠে। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে ক্রমিকটি উল্লেখ করে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক বলেন, বিষয়টি হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন। সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ ও ছুটি (২০ মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল) শেষে আবেদনগুলো শুনানির জন্য কার্যতালিকার তালিকার শীর্ষে রাখার আবেদন জানান তিনি। পরে আদালত আগামী ৮ মে দিন রাখেন। এ সময় বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন। এর আগে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর করে এ রায় দেওয়া হয়। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছরের অক্টোবরে একটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। অন্য চারজন হলেন তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন। পৃথক রিভিউ আবেদন গতকাল আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১৮ নম্বর ক্রমিকে ওঠে। ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারী পক্ষ। এই আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। ঘোষিত রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত বছরের অক্টোবরে একটি রিট করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে রুল হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল ঘোষণা করা হয়।
০৩ মার্চ, ২০২৫

নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন জামায়াতে ইসলামীর ‘মৌলিক দাবি’—একথা জানিয়ে দলটি বলেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। গতকাল সোমবার দুপুরে জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ে বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের নির্বাচনী চাহিদা মূল্যায়ন মিশনের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘এটা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) তো একেবারেই আমাদের মৌলিক দাবি। এর আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল, তা জামায়াতে ইসলামীই আগে করেছিল। পরে অন্যান্য দল এটাকে সাপোর্ট দিয়েছে। আমরা এর জন্য আন্দোলন করেছি। এটা সংবিধান সংযোজিত হয়েছিল; কিন্তু দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এটা বন্ধ করে। তারাও আন্দোলন করেছিল আমাদের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য। নিজের সুবিধার জন্য তারা এটি বন্ধ করেছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এটা আমাদের মৌলিক দাবি এবং এটাই হতে হবে।’ এর আগে ডা. তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াতের একটি প্রতিনিধি দল জাতিসংঘ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ। জাতিসংঘ মিশনের পক্ষে ছিলেন মিসেস সারা পিট্রোপাওলি, রাজনৈতিকবিষয়ক কর্মকর্তা, জাতিসংঘের রাজনৈতিক ও শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক বিভাগ এবং নির্বাচনী সহায়তা বিভাগ, আদিত্য অধিকারী, রাজনৈতিকবিষয়ক কর্মকর্তা, এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগ, জাতিসংঘের রাজনৈতিক ও শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক বিভাগ এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বিভাগ, মিসেস নাজিয়া হাশেমি, উপদেষ্টা, ডিজিটাল যুগে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান এবং প্রক্রিয়া (ইউএনডিপি)। বৈঠকে দেশের চলমান পরিস্থিতি, নির্বাচনী সংস্কার, জামায়াতের সাংগঠনিক কমর্কাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতিসংঘের নির্বাচনী চাহিদা মূল্যায়ন মিশনের আমন্ত্রণে আমরা এখানে এক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছি। তারা কয়েকটি বিষয়ের ওপর জানতে চেয়েছে যে, নির্বাচনে ইউএনডিপি কী ধরনের সহযোগিতা করতে পারে এবং স্বচ্ছ নির্বাচন হওয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার এবং সে ব্যাপারে আমরা কী ভাবছি? এসব বিষয়ে তারা কথা বলেছে এবং ইউএনডিপির এ মিশনকে আমরা স্বাগতম করি কি-না। আমরা বলেছি, যে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আমরা সহযোগিতার জন্য স্বাগত জানাই। তবে হস্তক্ষেপের জন্য নয়। উইদাউট ইন্টারফেয়ারে যদি আমাদের টেকনিক্যাল এবং ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করে, সেটার জন্য আমরা বলেছি আপনাকে স্বাগতম। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে আমরা বলেছি– প্রত্যেক কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা সংযোগ করার জন্য। কারণ সিসি ক্যামেরা থাকলে ইলেকশনের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে। এখানে প্রচুর ফান্ডের কথা আসছে। আমরা বলেছি এক্ষেত্রে তোমরা আমাদের সহযোগিতা কর। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে এটা বড় ধরনের সহযোগিতা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছি, আমরা নীতিগতভাবে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন চাই। এটা আমাদের মূলনীতির ভেতরেই আছে। নির্বাচনের তারিখ প্রশ্নে বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব। তবে এখানে কিছু জরুরি সংস্কার প্রয়োজন, অন্যথায় নির্বাচন আগের মতোই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জরুরি সংস্কার করা এবং নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করাটা নির্বাচনকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বেশি অথরিটি দেবে; আমরা সেটার ওপর জোর দিয়েছি।’ সাংবিধানিক মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার বলেছি। আমরা বলেছি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী কন্টিনিউ করতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। এসব বিষয়েও সংস্কার দরকার বলে আমরা জানিয়েছি। এক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব জমা দিয়েছে আমরা মনে করি সেগুলোকে নিয়েই সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনতিবিলম্বে ডায়লগ শুরু করা দরকার। এরপর নির্বাচন শুরু করার জন্য যে সময় দরকার তার ভিত্তিতেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন করা দরকার। আর সংস্কারের নামে অযথা সময়ক্ষেপণ করাও সঠিক হবে না। মৌলিকভাবে এসব বিষয়ে আজ আমাদের কথা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ডা. তাহের বলেন, ‘বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় দল। তাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং তারাও তাদের বক্তব্য রেখেছে। আমরা বলেছি, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যথাসম্ভব নির্বাচন দেওয়া। এটাই আমাদের স্ট্যান্ড।’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণ কী বলে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার ওপর নির্ভর করবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে ডা. তাহের বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে আইনগত বিষয়ে মতামত দেবে না। এটা জনগণ, সমাজ, পরিস্থিতি সিদ্ধান্ত নেবে।’ আগে স্থানীয় সরকার না জাতীয় সরকার নির্বাচন সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো মতামত ঠিক করিনি। আলোচনা করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাব।’
২১ জানুয়ারি, ২০২৫

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে রিভিউ শুনানি ৯ ফেব্রুয়ারি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বিশিষ্টজনের করা পৃথক চারটি রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। গতকাল রোববার বিএনপির পক্ষ থেকে সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন। এর আগে বিএনপির পক্ষে সময় আবেদন করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। গত ১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ শুনানির জন্য ১৯ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন। এর আগে তিনবার পেছানো হয়েছে আবেদনগুলোর শুনানি। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পাস করা হয়। ওই বছরের ২৭ মার্চ সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে। এই পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে তিন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন।
২০ জানুয়ারি, ২০২৫

নৌপরিবহন উপদেষ্টা / সবাই যদি চায় নির্বাচন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, তামাবিল স্থলবন্দরে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সমস্যার সমাধান করা হবে। যাত্রী ছাউনি, ফায়ার ব্রিগেড, সিএনফের বসার জায়গা ও ইউনিয়নের জায়গার স্থায়ী সমাধানে কাজ চলছে। অনেক বড় একটি ইয়ার্ড হয়েছে। হয়তো আরেকটু বাড়বে। কাজ চলছে। গতকাল বুধবার দুপুরে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। উপদেষ্টা আরও বলেন, সবাই যদি চায় নির্বাচন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ রাজনীতি করেন না, তাই সংস্কার শেষেই নির্বাচন করার ম্যান্ডেট আছে। এর আগে বেলা ১১টায় ড. এম সাখাওয়াত হোসেন তামাবিল স্থলবন্দরে পৌঁছে স্থলবন্দরের প্রশাসনিক ভবন, তামাবিল ইমিগ্রেশন, বধ্যভূমি ও স্থলবন্দরের পণ্য পরিমাপ স্কেল পরিদর্শন করেন। পরে বন্দরের প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সে সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ স্থলবন্দরের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান, গোয়াইনঘাট ইউএনও মো. তৌহিদুল ইসলাম, তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানসহ পাথর আমদানিকারক গ্রুপের নেতারা। পরে দুপুর ৩টার দিকে জাফলংয়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন উপদেষ্টা।
১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

সবাই যদি চায় নির্বাচন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে : নৌ উপদেষ্টা
সবাই যদি চায় নির্বাচন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বতী সরকারের কেউ যেহেতু রাজনীতি করে না, তাই সংস্কার শেষে নির্বাচন করার ম্যান্ডেট আছে। তবে সময় হলে সবই পরিষ্কার হবে।’ বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সবাই যদি মনে করে নির্বাচন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে অথবা নতুন কাউকে যুক্ত করা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনে যে সময় সীমা আছে তা কীভাবে সমাধান হবে তা একটি বিষয়। তবে এখন এ বিষয়ে হাত দেবে না বর্তমান সরকার।’ তিনি বলেন, ‘তামাবিল স্থল বন্দরের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সব ধরনের সমস্যা সমাধান করে সহযোগিতা করা হবে।’ এর আগে সকাল ১১ টায় নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন তামাবিল স্থলবন্দরে পৌঁছে বন্দরের প্রশাসনিক ভবন, তামাবিল ইমিগ্রেশন, বধ্যভূমি ও স্থলবন্দরের পণ্য পরিমাপ স্কেল পরিদর্শন শেষে স্থল বন্দরের প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ স্থলবন্দর আয়োজিত তামাবিল স্থলবন্দরের অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ স্থল বন্দরের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান, গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম, তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানসহ তামাবিল পাথর আমদানিকারক গ্রুপের নেতারা। মতবিনিময়কালে তামাবিল পাথর আমদানিকারক গ্রুপের পক্ষ থেকে আমদানি করা পাথরে ওজনে যৌক্তিক ছাড়, লেবার হ্যান্ডেলিং, ইয়ার্ড ব্যবহারে অতিরিক্ত ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা, বন্ড এরিয়া বৃদ্ধি এবং স্থল বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানানো হয়। এদিকে, বিকেল ৩টায় জাফলংয়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং হাসিনার প্রহসন
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি দেশে চালু হয়েছিল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অধীনে দেশে তিনটি সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই তিনটি নির্বাচন ছিল দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য। পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দেশের উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন। দীর্ঘ ১৩ বছর পর গতকাল সেই আদালতের রায়েই আবার ফিরে এসেছে এই ব্যবস্থা। ফ্যাসিবাদের অনুভূতিহীন দানব শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যে নির্লজ্জ প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তার প্রতারণা, প্রহসন এবং বেহায়াপনার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৯৯৩ সালের শেষদিকে শেখ হাসিনা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রথমবারের মতো সামনে আনেন। ৯০-এর গণআন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের পতন এবং পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পটভূমিতে এ পরাজয়ের গ্লানি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনাকে ধারণ করে তিনি এ দাবি উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। বিএনপি চেয়ারপারসন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধী দলগুলোর এ দাবিকে নানাভাবে সমালোচনা করলেও তিনি বরাবরই সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলগুলোকে সংসদে এসে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন এমপি জামায়াত, জাপা ও আওয়ামী লীগের দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা মেনে নেওয়ার চেয়ে আত্মহত্যাই শ্রেয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ’৯০-এর গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর তার দল উত্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আওয়ামী লীগ একটি অসভ্য প্রস্তাব হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এরশাদের পতনের ছয় ঘণ্টা আগে মওদুদ আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, জামায়াত চায় মধ্যযুগীয় ব্লাসফেমি আইন। জাতীয় পার্টি চায় এরশাদের মুক্তি। আর আওয়ামী লীগ চায় যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলেন ১৯৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়। এদিন তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল আনবে। বিএনপি যাতে এই বিল পাস করতে বাধ্য হয় এ জন্য তিনি আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এরপর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে সংসদের সব বিরোধীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার আহ্বানে সংসদের সব বিরোধী দল ও গ্রুপের নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর ২৬ এপ্রিল থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী যৌথভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে হরতাল, অবরোধ, মশাল মিছিল, পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ৯৪ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ, জাপা এবং জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদের ১৪৭ জন বিরোধীদলীয় সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এদিন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এনডিপির সদস্যরা স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। স্যার নিনিয়ানের ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারি ও বিরোধীদের দলের সমঝোতার লক্ষ্যে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। ঢাকার আসার পর থেকে তিনি মাসব্যাপী উভয় দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপের মধ্যস্থতা করেন। সংলাপের একপর্যায়ে তিনি একটি ফর্মুলা উত্থাপন করেন। এতে স্যার নিনিয়ান সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় নির্বাচনের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলেন। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের পাঁচজন এবং বিরোধী দলের পাঁচজন মন্ত্রী থাকবেন। তারা সবাই বর্তমান ৫ম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে থেকে মনোনীত হবেন। এ ছাড়া বাকি একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি মন্ত্রিসভার অন্তর্ভুক্ত হবেন। যার ওপর স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ভার ন্যস্ত থাকবে। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে সহায়তাকারী স্যার নিনিয়ান স্টিফেন সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে পৃথকভাবে আলাপ করে তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করেন। নিনিয়ানের এই প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন বিএনপি সম্মতি জানালেও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানিয়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা তিনি মানবেন না। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ আনে এবং তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উল্লেখ করে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠায়। কমনওয়েলথ চিফ এমেকা এনিয়াওকু আওয়ামী লীগের এ অভিযোগ নানচ করে দেন। পাকিস্তান সফররত কমনওয়েলথ চিফ ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিনিয়ান কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে স্যার নিনিয়ান সাংবাদিকদের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতাশার পথেই দেশকে নিয়ে যাবে। ব্যর্থ মিশন শেষে তিনি ১৪ নভেম্বর দেশে ফিরে যান। সহিংসতায় নিহত প্রায় অর্ধশত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে ৭০ দিন হরতাল অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, ২টি ৭২ ঘণ্টা এবং ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। আর ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে লাগাতার পালিত হয় ২২ দিন। আন্দোলনের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে টার্গেট করে হরতালের কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত। এক্ষেত্রে ’৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানেই নির্বাচনী সফরে যান, সে জেলাতেই হরতাল ডাকা হয়। বিরোধী দলগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে ডাকা এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাঙচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং সহিংসতায় নিহত হয় অর্ধশত মানুষ, আহত হয় সহস্রাধিক। ’৯৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল ও গণকারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং আহত হয় আরও ছয় শতাধিক মানুষ। বিরোধী দলগুলোর হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়েত ইসলামীর শীর্ষপর্যায়ের নেতারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পিকেটিংয়ে অংশ নেন। এরা হলেন আওয়ামী লীগের জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, কাজী জাফর আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী ফিরোজ রশীদ, জামায়াতে ইসলামী আলী আহসান মুজাহিদ প্রমুখ। ’৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছামতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল। আর লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে ১৯৯৫ সালের ১৮ অক্টোবর ফার্মগেটের এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, এ সরকার হরতাল ছাড়া আন্দোলনের কোনো ভাষা বোঝে না। হরতালে মানুষের দুঃখে কষ্ট হয়। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের করাই বা কী আছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস: তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের সমঝোতা উদ্যোগ নিষ্ফল হওয়া এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগের মাধ্যমে লাগাতার হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করে। অন্যদিকে এই নির্বাচনের আগে এবং পরে বিএনপি চেয়ারপাসন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। এই নির্বাচনে যেসব বিরোধী দল অংশ নেয়নি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আলোচনায় সবাই মিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ’৯৬ সালের ২১ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় এবং এ দিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিল উত্থাপন করা হয়। উদ্ভূত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অসাংবিধানিক শক্তির অশুভ তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ রাতভর আলোচনা শেষে ভোররাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা খালেদা জিয়া ২৬ মার্চ সকাল ৬টায় জাতীয় সংসদে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করলাম। পরদিন (২৭ মার্চ বুধবার) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রেসিডেন্টকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন-সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনসহ বিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট আইন অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলে সম্মতি দেন। প্রেসিডেন্টের এই সম্মতির পর বিলটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পথ সুগম হয়। ২৯ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আবারও বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং মে মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের প্রতি অনুরোধ জানান। হাবিবুর রহমানের শপথ গ্রহণ : ৩০ মার্চ শনিবার বিকেলে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী অলি আহমদ সংসদ বিলুপ্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর লিখিত অনুরোধ প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় এদিন প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং রাতে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে শপথবাক্য পাঠ করান। এ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়াপারসন খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, কূটনৈতিকবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা অংশ নেন। এদিন এক বিবৃতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্য কামনা করেন এবং অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তিনি তার দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনগণের অপরিসীম ত্যাগ ও তিন দলের আন্দোলনের ফলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি জাতি আরেকবার প্রমাণ করেছে জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি টিকে থাকতে পারে না। ন্যায্য ও সত্যের সংগ্রাম সবসময় জয়ী হয়। লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর পথ খুলল
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করাকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল, অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। এ রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করার সিদ্ধান্ত অবৈধ হয়েছে। তবে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি ফেরার বিষয়টি আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এ বিষয়ে পৃথক রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আগামী ১৯ জানুয়ারি সেসব রিভিউর শুনানির দিনও ঠিক করা আছে। আপিল বিভাগের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। একই সঙ্গে হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা জাতির পিতা, ৭ মার্চসহ বেশ কয়েকটি বিষয় সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। এসব ব্যাপারে সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন আদালত। রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। ৬টি বিষয় বাতিল করে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এদিকে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলেও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে আপিল বিভাগ থেকে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন বিচারাধীন। এখন এই রায়ের (হাইকোর্টের রায়ের) ফাইন্ডিংসগুলো সেখানে তুলে ধরা হবে। সবকিছু মিলিয়ে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’ অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জকারীদের পক্ষের আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না। কারণ, সেটা বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।’ তিনি বলেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার ও আরও চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।’ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আনা হয়। এরপর ওই বছরই জুনে দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারপর ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংকটকালীন অবস্থায় ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ক্ষমতায় বসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যেটি বাংলাদেশে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার নামেও পরিচিত ছিল। ওই সরকার প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজন করে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর পাসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিন আইনজীবী দুটি মামলা করেন। হাইকোর্ট সেগুলো খারিজ করে দেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আপিলের শুনানি করে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, পরবর্তী দুটি নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের রাখার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের মাস দেড়েকের মাথায় একই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এই সংশোধনী পাস হয় সংসদে। এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সে সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোনো অধিবেশন বসবে না বলেও সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া সংশোধনী অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলেও বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। একই সঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ২০২১ সালের এই সংশোধনীর মাধ্যমে। অন্যদিকে গত আগস্ট মাসে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন দায়ের করেন। এরপর বিএনপি, জামায়াতের পক্ষ থেকে আরও দুটিসহ মোট তিনটি রিভিউ আবেদন দায়ের হয়েছে। এখন পৃথক চারটি রিভিউ আবেদনের ওপর আগামী ১৯ জানুয়ারি শুনানির জন্য রেখেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। আর আপিল বিভাগ থেকেই এই রিভিউর রায়ের মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিলের রায়: গতকাল সকাল ১০ টা ৫২ মিনিট থেকে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা শুরু করেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী এ রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪(২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬টি বিধান বাতিল করেন হাইকোর্ট। বাকিগুলো সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত আরও বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো রয়েছে। গণভোটের বিষয়ে রায়ে হাইকোর্ট বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো। হাইকোর্টের রায়ে ৭ক, ৭খ এবং ৪৪(২) অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭খ সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। এদিকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা আছে। ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবেন। এ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। ‘এ রায় দিতে পেরে নারী হিসেবে আমি গর্বিত’: বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করে মূল রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ আদালতে পাঠ করেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রায় প্রদানকালে মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন, এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি, নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এ রায় দেওয়ার সময় আমরা জনগণের চাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছি। এসময় আইনজীবীরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। আইনজীবীরা যা বলছেন: রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, রিটকারীরা সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটাই অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত পুরো সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেননি। আদালত বলেছেন, পুরোটা সংবিধান পরিপন্থি বলছি না। দ্বিতীয়ত বলেছেন, সংবিধানের ৭(এ) ও ৭(বি) এই দুটো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা সংবিধানে ছিলই না—এভাবে ধরে নিতে হবে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা আদালত অবৈধ বলেছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা বাতিল করা হয়েছে। রেফারেন্স হিসেবে আদালত বলেছেন, গত তিনটি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কীভাবে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে, কীভাবে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, কীভাবে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কীভাবে সংবিধানের মূল ভিত্তিতে আঘাত হানা হয়েছে—এগুলো উনারা বলেছেন। এরপর সংবিধানের ৪৪(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সরকার ইচ্ছা করলেই যে কোনো জায়গায় হাইকোর্ট বসাতে পারবেন। এটা অবৈধ। কারণ, এটা অষ্টম সংশোধনীর রায়ে বলা হয়েছে, এখানে একটি সুপ্রিম কোর্ট থাকবে। এই একটা সুপ্রিম কোর্টকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবেন, এটার সুযোগ নেই। তৃতীয়ত, গণভোটে জনগণের যে ক্ষমতা (পাওয়ার), সরকার যেভাবে সংকুচিত করেছিলেন, সেটা অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আদালত কিছুই বলেননি। বাকি বিষয়গুলো বৈধ নাকি অবৈধ, কিছুই বলেননি। সেগুলো সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে সেগুলো রাখবে কি রাখবেন না। সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর মোট ছয়টি বিধান বাতিল করেছে। ওই সংশোধনীতে ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বাকিগুলো পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। পরবর্তী সংসদ এসে যৌক্তিক মনে করলে রাখবে, অথবা রাখবে না। রিটকারীদের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে, সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটা ঐতিহাসিক রায়। সংবিধানে জাতির পিতা, ৭ মার্চসহ কয়েকটি ধারা যে সংসদের জন্য আদালত ‘রেখে দিয়েছেন’ তা জানিয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত। সার্বিকভাবে তিনি রায়কে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করে বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকবে বলে তিনি আশা করেন। বহাল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না। মামলার ইতিবৃত্ত: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এই সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে আরও একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর দ্বাদশ দিনে ৪ ডিসেম্বর শুনানি শেষ হয়। পরদিন আদালত রায়ের জন্য ১৭ ডিসেম্বর তারিখ রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় পর্যবেক্ষণসহ রুল আংশিক যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেন। আলোচিত এই রিটের রুল শুনানিতে সুজনের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। ইনসানিয়াত বিপ্লব দলের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুর রউফ ও ইশরাত হাসান। এ ছাড়া রুল শুনানিতে পক্ষভুক্ত হওয়া সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। এদিকে গতকাল রায় ঘোষণার সময় পক্ষভুক্ত হওয়া আইনজীবী ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী, নাফিউল আলম সুপ্ত এবং সাইয়েদ আবদুল্লাহসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

সংবিধানে জাতির জনক, ৭ মার্চসহ কয়েকটি ধারা সংসদের জন্য রেখেছেন আদালত
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল। এই সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। জাতির জনক, ৭ মার্চসহ এর কয়েকটি ধারা ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখেছেন আদালত।  আইনজীবীরা জানান, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা আদালত বাতিল করেননি। আদালত বাকিগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করেন আদালত। রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, তারা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলেন। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেননি। আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও তিনি দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে। এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত। সার্বিকভাবে এটি ঐতিহাসিক রায়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।  
১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
X