সম্মিলিত চেষ্টায় এবার দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রা
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালুর মধ্য দিয়ে সড়ক-মহাসড়কে সার্বক্ষণিক নজরদারি, যানজট নিরসনে মহাসড়কে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিসহ পুলিশি তৎপরতায় সড়কপথে দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রা হয়েছে। সেইসঙ্গে এবারই প্রথম দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক উত্তরের পথে ড্রোন ক্যামেরায় যানজট নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যানবাহনের জটলায় টোলমুক্ত যাতায়াতের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে একাধিক সেতুতে। তবে এর সঙ্গে দীর্ঘ ছুটি এবং লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলতে না দেওয়া দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রার বড় কারণ বলে মনে করেন অনেকেই।
সড়কপথে এক কোটির বেশি মানুষ রাজধানী ছাড়ার হিসাব দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হিসাবে সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে ১৫৫টি যানজটপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল। হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ১২২টি যানজটপ্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়। তালিকা ধরেই সম্মিলিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রায় সাতটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিআরটিএ-বিআরটিসি-ডিটিসিএ ও ডিএমটিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে বিআরটিএ সদর দপ্তর কার্যালয়ে ঈদযাত্রা উপলক্ষে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (এস্টেট) মো. সাইফুল ইসলাম ফোকাল পারসন হিসেবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মূলত ৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু থাকবে।
এ ছাড়া ৪ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১১ দিন নিরাপদ যাতায়াত সরেজমিন মনিটরিং করতে ঢাকা মহানগরী এবং এ-সংলগ্ন জেলায় ৯ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা অভিযান পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে নিরাপদে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কার্যক্রম ১৫-১৬ তারিখ বাড়ানো হয়। দুই দিন ১৬ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে নিরাপদ ঈদযাত্রায় বিআরটিএ সদর দপ্তরে খোলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোকাল পারসন ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শীতাংশু শেখর বিশ্বাস। ৪-১৪ তারিখ পর্যন্ত এ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ১২৯ জন পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।
বিআরটিএ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ছিল সিসিটিভিতে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা। সড়ক-মহাসড়কে যে কোনো স্থানে সমস্যা দেখলেই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তেমনি হাইওয়ে পুলিশ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ উত্তরের পথে ড্রোন ক্যামেরায় যানজট নিয়ন্ত্রণ করে, যা এবারই প্রথম। ড্রোন ক্যামেরায় সড়ক পরিস্থিতি বিআরটিএ, জেলা ও হাইওয়ে পুলিশ একযোগে পর্যবেক্ষণ করে। সড়ক সচিব, একাধিক অতিরিক্ত সচিব, বিআরটিএ চেয়ারম্যান, পুলিশপ্রধান, হাইওয়ে পুলিশপ্রধান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিরাপদ ঈদযাত্রায় ধারাবাহিকভাবে মাঠে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন সমস্যায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন তারা। এর সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ, বিআরটিএ, বিআরটিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মাঠে ছিলেন। মূলত সমন্বিত পদক্ষেপের কারণেই দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রা হয়েছে এ বছর।
জানা গেছে, ঈদের এক দিন আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি সেতুতে যানজটের কারণে টোল ফ্রি করে দেওয়া হয় অল্প সময়ের জন্য। এতে দ্রুত যানজট নিয়ন্ত্রণে আসে। তেমনি প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ শেষে নিরাপদে কর্মস্থলে ফিরছেন নগর ছেড়ে যাওয়া মানুষ। সড়কপথে ঢাকায় ফিরতে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানা গেছে।
দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী কালবেলাকে বলেন, নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা সাজানো হয়। রাজধানী ঢাকাসহ মাঠপর্যায়ে যাদের যে দায়িত্ব ছিল, তারা সবাই তা যথাযথভাবে পালন করেছেন। অনেকেই ঈদে রাস্তায় ছিলেন।
তিনি বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ সুপার, ইউএনও, বিআরটিএ থেকে সবাই সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। মালিক ও শ্রমিক নেতারাও সহযোগিতা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে কিছুটা যানজট হয়েছে সেখানেই অতিরিক্ত জনবল দেওয়া হয়েছে। নষ্ট গাড়ি দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সব মহাসড়কে হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলো ঘিরে মাঝেমধ্যে কিছুটা যানবাহনের জটলা হলেও টোল ফ্রি করতে হয়নি। ঈদের পরে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কার্যক্রম আরও বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান সড়ক সচিব।
ঈদযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে হাইওয়ে পুলিশ। জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শ্যামল কুমার মুখার্জী কালবেলাকে বলেন, নিরাপদ ঈদযাত্রায় হাইওয়ে পুলিশের প্রায় সব সদস্য মাঠে কাজ করেছেন। ৮ এপ্রিল গার্মেন্টস ছুটি হওয়ায় ৯ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন ও যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। যেখানে যে সমস্যা হয়েছে, তা দ্রুত নিরসন করা হয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল, ঈদযাত্রায় যেন যাত্রীদের কোনোভাবেই দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। ৯ তারিখ বিকেলের পর থেকে রাস্তার চাপ একেবারেই কমে যায় বলেও জানান তিনি।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ভোগান্তি নেই: ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরছে মানুষ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রবেশ পথ রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট। রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৪ হাজার যানবাহন দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে পারাপার হয়েছে। তবে কোনো ভোগান্তি ছিল না। কর্মক্ষেত্রে যাত্রীদের স্বস্তিতে ফিরতে ঘাটের পয়েন্টে পয়েন্টে পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সোমবার ভোরে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমে যায়। যানজট ও ভোগান্তি না থাকায় স্বস্তিতে ফিরছে ঢাকামুখী যাত্রীরা। বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ কালবেলাকে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাস ৫২১টি, ট্রাক ২৯২টি, ছোট গাড়ি ১ হাজার ৬১৭টি এবং মোটরসাইকেল ১ হাজার ৫১৪টি পারাপার হয়েছে। দৌলতদিয়ায় ৭টি ফেরিঘাটের মধ্যে ৩টি ঘাট সচল রয়েছে। এর মধ্যে ৩, ৪ ও ৭ নম্বর ঘাট চালু আছে।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ফেরিঘাট শাখা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন কালবেলাকে জানান, ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা মানুষ ও যানবাহনের চাপ নেই। যাত্রী ও যানবাহন ফেরিঘাটে পৌঁছানো মাত্রই ফেরিতে উঠে চলে যাচ্ছে। এ নৌরুটে ছোট-বড় মিলে মোট ১৮টি ফেরি বর্তমানে চলাচল করছে।
বিআইডব্লিউটিএ দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের ম্যানেজার নুরুল আনোয়ার মিলন কালবেলাকে জানান, বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ২০টি লঞ্চ চলাচল করছে। এ লঞ্চগুলো দিয়েই যাত্রীদের পারাপার করা হচ্ছে।
রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার জি এম আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে জানান, ঢাকামুখী যাত্রীদের নির্বিঘ্নে পারাপার ও নিরাপত্তা জোরদারের জন্য পুলিশ কাজ করছে। ঘাটের বিশেষ পয়েন্টগুলোতে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য দৌলতদিয়া ঘাটে ট্রাফিক পুলিশ, ডিবি পুলিশ, গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ মিলিয়ে ৪ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু আছে।
১৬ এপ্রিল, ২০২৪