ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / শিক্ষানৈতিক দীনতাই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধকতা
ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। এ শিক্ষানীতিতে জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার চেয়েও, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উন্নয়নকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ শিক্ষানীতিতে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালুর বিষয়টিকে ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নের নিয়ামক বলে ধরা হয়। সে অনুযায়ী ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে এ ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা ইংরেজি শিক্ষাবিদদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রণয়ন করা হয়। এই ইংরেজি শিক্ষাবিদরা হলেন মূলত ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ দেশ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদ থেকে ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত, যারা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। তারা দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউনেসকো ও ইউনিসেফ ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তায় এ বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। অর্থাৎ নিজেদের ইংরেজি শিক্ষানীতির দীনতার সঙ্গে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির চাতুর্য যুক্ত হয়ে বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে।  এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষানৈতিক দীনতাটি বুঝতে হলে, ইংরেজি শিক্ষার নির্ধারিত লক্ষ্য এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিটি উদঘাটন করতে হবে। এ পর্যায়ে আমাদের জানা দরকার ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়।  ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষক, ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষার পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সহায়ক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে বোঝায়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার উন্নয়ন, যেন একজন শিক্ষার্থী এই ইংরেজি ভাষায় অর্জিত দক্ষতাটি জ্ঞান অর্জন বা পারস্পরিক সংজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত জ্ঞান দ্বারা প্রণীত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ঈপ্সিত ইংরেজি ভাষা দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিদদের মূল গবেষণার বিষয় হলো ইংরেজি ভাষার শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নয়। যে কারণে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে বিবৃত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে বিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যয়িত জাতীয় শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্থ, যার পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, তার অধিকাংশই অপচয় হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে এ ব্যর্থতার মূল কারণ হলো ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দৈন্যদশা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা বলতে বোঝায় ইংরেজি ভাষার শব্দ সংখ্যা ও ব্যাকরণে দখল, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার শ্রবণ, বাচন, লিখন ও পঠনগত দক্ষতাকে প্রকাশ করে থাকে। এ দক্ষতার প্রারম্ভিক, প্রাথমিক, প্রাক-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর—এ ছয়টি ধাপ রয়েছে। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার এ ছয়টি ধাপকে বিবেচনায় না নিয়েই বর্তমান ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে। ভাষাগত দক্ষতার ধাপকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ হলো, তাদের বিজাতীয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং জাতীয় ভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অসক্ষমতা। অথচ ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য জানা অপরিহার্য। ইংরেজি ভাষা হলো মূলত বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম। তার বিপরীতে বাংলা ভাষা শুধু বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যম নয়। বরং সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম। তা ছাড়া এ ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতার প্রতীক। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষা হলো বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক। কিন্তু ইংরেজি ভাষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয়। শিক্ষানৈতিক আদর্শ অনুযায়ী বুনিয়াদি শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পাঠ্যক্রমে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয় বিধায় এই ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। বরং ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়ে ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমে বাংলা ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে এ ভাষায় সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম হিসেবে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা যেহেতু সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম নয়, শিক্ষাক্রমে এ ভাষায় পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ইংরেজি শিক্ষাক্রম দ্বারা ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত না হলে, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বি-সামাজিকীকরণ ও বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বস্তুত বাংলাদেশে তেমনটাই ঘটছে। যা ঘটছে তা হলো, বর্তমান প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ঈপ্সিত ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না, তার বিপরীতে শিক্ষার্থীরা বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার ঝুঁকিতে নিপতিত রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ভাষাগত দক্ষতা না থাকায় শিক্ষা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং জ্ঞান অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। অধিকন্তু ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাবে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে, তা সমাজ জীবনে বাংলিশ বিস্তৃতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত ওই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে ইংরেজি ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি, বাংলা ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ভিন্নতর হবে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা পাঠ্যক্রম ও ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি হবে যথাক্রমে কৃতিভিত্তিক ও দক্ষতাভিত্তিক। সে হিসেবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থী ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও, শুধু ইংরেজি ভাষা দক্ষতা পরীক্ষা পাস সাপেক্ষে একজন শিক্ষার্থী ছয় ধাপভিত্তিক ওপরের দক্ষতা সম্পন্ন ক্লাসে উত্তীর্ণের সুযোগ পাবে। এ দক্ষতাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী যে শ্রেণির শিক্ষার্থীই হোক না কেন, ইংরেজি ভাষার ক্লাসের তার অন্তর্ভুক্তি হবে ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতার ধাপ অনুযায়ী। সে হিসেবে একটি দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ—একজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী—এ তিনজন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা যদি উচ্চমাধ্যমিক ধাপের হয়, তাহলে তারা সবাই একই ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রস্তাবিত দক্ষতাভিত্তিক এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় ধাপভিত্তিক পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে, একটি জাতীয় ভাষাগত দক্ষতা পরিমাপক অভীক্ষা চালু করতে হবে। এই অভীক্ষা চালু করা হলে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্তযুক্ত করা যাবে। তা ছাড়া ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্ত যুক্ত করা যাবে। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজ ভাষা শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে, ভাষিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানীয় কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতামুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়ন সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।  ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো; জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম / বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন
গত ১ জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। এই বাজেটে শিক্ষা খাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এই অর্থের বেশিরভাগই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মূলধারার শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা—এই ধারার শিক্ষায় ব্যয় করা হবে।  শিক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশে যুগোপযোগী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক মানবসম্পদ বা মানবিক পুঁজি গড়ে তোলা। কারণ দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেমন আর্থিক পুঁজি প্রয়োজন; ঠিক তেমনিভাবে মানবিক পুঁজিরও প্রয়োজন। অর্থাৎ যতই আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ করা হোক না কেন, কোনো বাণিজ্যিক, শিল্প বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যদি জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানবিক সম্পদ কাজ না করে তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অভীষ্ট সুফল পাওয়া যায়? উত্তর হলো—না। কারণ জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগকৃত অর্থের অধিকাংশই অপব্যয় ও অপচয় হয়ে থাকে। এই অপব্যয় ও অপচয় সবচেয়ে বেশি হয়ে থেকে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায়। এর প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে নীতিবিবর্জিত শিক্ষানীতি, ভুল ইংরেজি শিক্ষা পরিকল্পনা ও শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রশাসনের বিমুখতা এবং ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়োজিত শিক্ষক-প্রশিক্ষকদের সঠিক শিক্ষাদানে অদক্ষতা ও অনীহা। কিন্তু দেশে মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক একটি সুষ্ঠু ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা পরিকল্পনা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা মেরামতে হাত দিতে হবে। আর মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দেশে কথিত অন্যান্য ভাষা শিক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এসব ভাষার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষা। কারণ একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভাষিক উন্নয়ন অপরিহার্য। যে কারণে ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষার ভাষিক উন্নয়নকে বাদ দিয়ে শুধু ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের সার্বিক ভাষিক উন্নয়নের জন্য একটি সর্বাত্মক ভাষানীতি প্রয়োজন। বিদেশি ভাষার ভাষিক উন্নয়নেও ভাষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। সে জন্য বিদেশি ভাষার বাস্তব প্রায়োগিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে সাময়িকভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।   বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, কোন ভাষাগুলো বিদেশি এবং বিদেশি ভাষার মধ্যে কোনগুলোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সমসাময়িককালে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রজোটের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায় বিদেশি ভাষা শিক্ষার এই সুযোগ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং জনশক্তি রপ্তানিতে তৎপর রয়েছে। এই কাজে সরাসরি যুক্ত রয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শিল্পোন্নত ও বিত্তশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দ্বিপক্ষীয় সভায় সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে নিয়মিত দেনদরবার করে থাকে। বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আরব ভাষাভাষী অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, পূর্ব এশিয়ার জাপান ও কোরিয়া এবং ইউরোপের ইতালি ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করছে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করতে আগ্রহী দেশসমূহে অদক্ষ থেকে শুরু করে অর্ধদক্ষ ও দাপ্তরিক কাজে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মীদেরই ভাষাগত দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ভাষাগত দক্ষতা মানবিক পুঁজির নিয়ামক বিশেষ। জনশক্তি আমদানিকারক দেশসমূহের চাহিদা বিবেচনায় এখন দেশে যেসব বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তার অন্যতম হলো আরবি, মালয়, জাপানি, কোরীয় ও ইতালীয় ইত্যাদি। উল্লিখিত বিদেশি ভাষাগুলো ছাড়াও আরও কিছু বিদেশি ভাষা শিক্ষার চাহিদা রয়েছে। কারণ দেশের যুবসমাজ এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। সেসব দেশে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সংজ্ঞাপনে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া দেশেও কোনো কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বিদেশে ও দেশে কর্মসংস্থানের জন্য আর যেসব বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো চীনা, ফরাসি, স্পেনীয়, তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও গ্রিক ইত্যাদি। এটি এখন বাস্তবতা যে, দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে দেশজুড়ে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই শিক্ষার অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত বিস্তার ঘটছে। যার ফলে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, যার অন্যতম হলো : i) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসমূহ ii) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ (যেখানে ১/২টি কোর্সের মাধ্যমে সীমিত পর্যায়ে বিদেশি ভাষার পাঠদান করা হয়) iii) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়াধীন একাডেমিসমূহ iv) শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ v) জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ vi) বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহে vii) English Medium School সমূহ viii) বিভিন্ন শহরে বা বাজারে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ  বৈদেশিক কর্মসংস্থানের কারণে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা উপরোল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিপূরণ হচ্ছে না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সঠিক নয়। কিন্তু বিদেশে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা বেশি এবং তদানুসারেও মাসিক বেতন-ভাতাও বেশি হয়ে থাকে। প্রত্যেক বিদেশগামী কর্মীর ভেতন-ভাতা যথেষ্ট হলে, তার অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফেরত আসে। দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় এবং বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান বিবেচনায় দেশে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ ও সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে ওই বিদেশি শিক্ষাকার্যক্রমে ব্যাপৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এই উন্নয়নে অর্থ প্রয়োজন। এই দেশব্যাপী পরিব্যাপ্ত শিক্ষাকার্যক্রমের অর্থের জোগান জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই শিক্ষা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয়, কোনো ব্যক্তি ও সংস্থা কর্তৃক মেটানো সম্ভব নয়। জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলে, দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশগামী মানুষ বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরিপ্রাপ্তিতে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে। তৎপরবর্তী সময়ে বিদেশে কর্মসংস্থান হলে সেসব মানুষ দেশে উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠাতে সক্ষম হবে। ফলে জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থের কয়েক গুণ লাভ হিসেবে ফিরে আসবে। দেশের সার্বিক জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটবে। এভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রচুর লাভ হিসেবে দেশের মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। কাজেই চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় শিক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ। পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট। ভূতপূর্ব অভ্যাগত শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়
২৪ জুন, ২০২৩
X