আগুন লাগলে বেরিয়ে আসে গোপন গুদাম
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২৪ জন নিহত হওয়ার পর সামনে আসে বসতবাড়িতে ভয়ংকর রাসায়নিকের গুদাম থাকার বিষয়। এরপর রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা বা দোকান সরাতে তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু এসব এলাকায় আগুন লাগলেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গত ১৪ বছরেও সরেনি রাসায়নিকের গুদাম। সরকার বসতি এলাকা থেকে গুদাম সরাতে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে কেমিক্যাল পল্লি, টঙ্গী আর ঢাকার শ্যামপুরে গুদাম তৈরির উদ্যোগ নিলেও এত বছরেও এসব উদ্যোগ কাজে আসেনি।
সর্বশেষ গত শনিবার ভোরে লালবাগের ইসলামবাগে রাসায়নিকের একটি গুদামে আগুন লাগলে ফের বিষয়টি সামনে আসে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লালবাগের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যালের গুদামের আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর পর বেরিয়ে আসে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের নামে একেকটা বাসাবাড়ি ‘গোপন বোমা’ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এরপর ফের টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। শিল্প মন্ত্রণালয় দ্রুততম সময়ে রাসায়নিক গুদাম অপসারণের ঘোষণা দেয়।
তোড়জোড় দেখা যায় সিটি করপোরেশনেরও। ওই ঘোষণার পর ২০২১ সালের এপ্রিলে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুনে প্রাণ হারান পাঁচজন। দগ্ধ হন অন্তত ২৫ জন। ওই বছরের নভেম্বরে সোয়ারীঘাটে লাগা আগুনে প্রাণ যায় আরও পাঁচজনের। এসব ঘটনার পর বেরিয়ে আসে ভবনগুলো কেমিক্যালে ঠাসা ছিল।
গত শনিবার ইসলামবাগে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগার পর গতকাল রোববার পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান। মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোড, আগামাসিহ লেন, মাহুৎটুলী, চকবাজার ও লালবাগের বিভিন্ন এলাকা, বংশাল, আলুবাজার আর সিদ্দিকবাজারসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কেমিক্যাল বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। ঝুঁকি নিয়ে গাড়িতে স্থানান্তর করা হচ্ছে, গুদাম থেকে বের হচ্ছে কেমিক্যাল, আবার ঢুকছে। এসব এলাকায় ঘুরলে তাজা কেমিক্যালের উৎকট গন্ধ নাকে লাগে, চোখ ঝাঁ ঝাঁ করে। এসব গুদাম-দোকানে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, গ্লিসারিন, সোডিয়াম থায়োসালফেট, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, টলুইন ও আইসোপ্রোপাইল মতো অতিদাহ্য পদার্থ রয়েছে।
পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানাতে চাননি। কয়েকজনের ভাষ্য, যুগের পর যুগ ধরে তারা এসব এলাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা করে আসছেন। সরকার তাদের পুরান ঢাকার বাইরে এই কেমিক্যালের গুদামের জন্য জায়গা দিতে চাইলেও দোকান এক জায়গায় আর গুদাম অন্যত্র—এজন্য তারা আগ্রহী হচ্ছেন না।
পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম-দোকান কত: পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম বা দোকান কতগুলো তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। ২০২০ সালে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে বিস্ফোরক জাতীয় প্লাস্টিক ও রাসায়নিক ব্যবসা পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তৈরির জরিপ শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দক্ষিণ সিটির পুরান ঢাকা এলাকায় (কর অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫)-এ জরিপ চালায়। ওই জরিপে ২০২১ সাল পর্যন্ত পুরান ঢাকায় বিস্ফোরক জাতীয় প্লাস্টিক ও রাসায়নিক ব্যবসা পরিচালনা করে এমন ১ হাজার ৯২৪টি রাসায়নিক গোডাউন রয়েছে বলে বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বেরিয়ে আসে ভিন্ন তথ্য। বাপার গবেষণায় পুরান ঢাকায় অন্তত ২৫ হাজার রাসায়নিক পণ্যের গুদাম থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে, যার মধ্যে ১৫ হাজারই বসতবাড়িতে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম বা এই ধরনের যত দোকান আছে, এর সবই অবৈধ। কারণ কারোই কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেই। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সাল থেকে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি ২০১৯ সাল থেকে বিস্ফোরক জাতীয় রাসায়নিক ব্যবহার করে এমন প্লাস্টিক কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন বন্ধ রয়েছে। এজন্য এগুলো অবৈধ।
কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কত দূর : গত কয়েক বছরে শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির খালি জায়গায় রাসায়নিকের অস্থায়ী গুদাম তৈরি, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ এবং গাজীপুরের টঙ্গীর কাঁঠালদিয়ায় অস্থায়ী গুদাম নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর মধ্যে শুধু শ্যামপুরে অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। গত বছর এই প্রকল্প উদ্বোধনের পর মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান সেখানে গুদাম গড়ে তুলেছে। বাকি জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। সিরাজদীখানে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি এক যুগেও। ফলে আটকে আছে পুরান ঢাকা থেকে গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমও।
ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। ১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার ওেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের জুনে। ওই সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় দীর্ঘ আট মাস সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল এই প্রকল্প। এরপর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা করা হয়। চলতি বছর পর্যন্ত পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এত বছরে প্রকল্পে জায়গা অধিগ্রহণ আর কিছু জায়গা ভরাট করা হলেও কাজের আর অগ্রগতি নেই। মেয়াদ শেষ হয়েছে টঙ্গীর গুদাম প্রকল্পেরও। তবে সেখানেও রাসায়নিকের গুদাম সরেনি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সংস্থাটির চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক কালবেলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাটসহ ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরও অন্তত দেড় বছর সময় লাগবে।
অন্যদিকে সিরাজদীখানে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রস্তুত হওয়ার আগে সাময়িকভাবে রাসায়নিক কারখানাগুলো ঢাকার শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর নেওয়া ওই সিদ্ধান্ত ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও গত বছর সেই কাজ শেষ হয়। ওই প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক আ. ন. ম শরীফুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্প শেষ করেছি। সব গুদাম প্রস্তুত। এখন ব্যবসায়ীরা চাইলেই সেখানে মালামাল রাখতে পারবেন।’
জানা যায়, গত বছর শ্যামপুরের ‘অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য নির্মিত গুদাম’ উদ্বোধন হলেও এখন পর্যন্ত ‘মেসার্স রয়েল টন লেকার কোটিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সেখানে গুদামজাত শুরু করেছে। এজন্য গত মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ দেয় সিটি করপোরেশন। তবে বেশির ভাগ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীই সেখানে যেতে রাজি নন।
শ্যামপুরের গুদামে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা যেতে রাজি নন কেন তা জানতে কালবেলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইম্পোটার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে। সংগঠনটির মহাসচিব আবুল কালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, সব ব্যবসায়ী নিরাপদ স্থানে গোডাউন নিতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের ব্যবসার দিকটাও দেখতে হবে। সেখানে ভাড়া অনেক বেশি। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা সেখানে যেতে চান না। তিনি জানান, শ্যামপুরের গুদামে প্রতি বর্গফুট জায়গা প্রথমে ৭০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এরপর তাদের দাবির মুখে ৩৮ টাকা করা হয়। কিন্তু তাও ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক বেশি। কারণ এখন যেখানে তাদের গুদাম রয়েছে, সেখানে ১২ টাকা বর্গফুট হিসেবে তারা ভাড়া দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে যাওয়া কঠিন।
অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আশা করছি, সব রাসায়নিক গুদাম ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান শ্যামপুরে স্থানান্তরিত হবে। যারা স্থানান্তরিত হবে না পর্যায়ক্রমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২৫ মার্চ, ২০২৪