ব্যাংক থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট
নানা অনিয়মের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংক থেকে এ পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অনিয়ম রোধ করা গেলে এ টাকায় বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে প্রথমসারির গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ হিসাব দিয়েছে সিপিডি। গতকাল শনিবার ঢাকার ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৩-২৪ : চলমান সংকট ও করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ হিসাব তুলে ধরেন।
সিপিডির তথ্যমতে বলছে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট হওয়ার কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
কোথায় কত টাকা গেছে?
সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ নিয়ে গেছে ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। জনতা, প্রাইম, যমুনা, শাহজালাল ও প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়ে গেছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১৫ সালে
জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় ৬০টি মামলা করেছে ১২০ জনের বিরুদ্ধে।
জালিয়াতির মাধ্যমে অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে থার্মেক্স গ্রুপ এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ৮১৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যদিও ব্যাংকটিতে ওই কোম্পানির ঋণ সীমা ছিল ২৬৪ কোটি টাকা।
সিপিডি আরও জানায়, জনতা ব্যাংক থেকে ২০২০ সালে ঋণ সীমা লঙ্ঘন করে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে গ্লোবাল ট্রেডিং ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এবি ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে দুদক মামলা করেছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার ২০২১ সালে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করেন। এ ঘটনায় দুদক ৩৭টি মামলা করেছে তার বিরুদ্ধে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০১৬ সালে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয় অনিয়মের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে। এ বিষয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ অনিয়মের অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করেন এক আইনজীবী। ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে অপরিচিত নয়টি কোম্পানিকে নিয়ম লঙ্ঘন করে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়। মিথ্যা তথ্যে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে এ ঋণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভুয়া কোম্পানিকে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণ দেয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
অনিয়ম-খেলাপির প্রধান এই ঘটনাগুলোর বাইরেও অনেক ঋণখেলাপির ঘটনা রয়েছে বলেও জানিয়েছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাত বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পুঁজিবাদের দখলে চলে গেছে। এ ধরনের পুঁজিবাদীরা তাদের আর্থিক অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাংকিং খাতকে ব্যবহার করছে। ফলে এই শ্রেণি বা গোষ্ঠী ব্যাংকিং খাতকে ব্যবহার করে একের পর এক ঋণ অনিয়ম করছে। যদিও ব্যাংকে টাকা রাখে সাধারণ জনগণ। সেই টাকা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা দেখার দায়িত্ব আমাদেরও। জনগণের অধিকার রয়েছে তা জানার।’
এমন বাস্তবতায় ব্যাংকিং খাতের নিয়মকানুন জোরদার করার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা অনিয়ম করে ঋণ নিচ্ছে, তারাই আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে নীতিমালা করার জন্য চাপ দেয়। অর্থাৎ কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছে ব্যাংক খাতের সুশাসন কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। এজন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
বিভিন্ন ঋণখেলাপির ঘটনায় বিশাল পরিমাণ এ অর্থ বেরিয়ে গেলেও এর বিপরীতে ‘যৎসামান্য’ অর্থ আদায় হয়েছে জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ‘শক্তিশালী’ করার ওপর জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো না গেলে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। ফলে সুশাসনের অভাবে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অর্থ পাচার বেড়েই যাবে।’
ব্রিফিংয়ে সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, তা পুরোটা নয়। ১০ বছর আগে খেলাপির পরিমাণ ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা থাকলেও গত সেপ্টেম্বর শেষে তা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ ১০ বছরে খেলাপিঋণ বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণেরও বেশি। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল, মামলা এবং অবলোপনের কারণে অনেককে ঋণখেলাপি হিসাবে দেখানো হয় না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লুটপাট হওয়া অর্থের কতটা পাচার হয়েছে, তা বলা মুশকিল। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশ থেকে গড়ে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারি অর্থায়ন, ব্যাংকিং খাত, বিদেশি অর্থায়ন ও ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং শ্রম অধিকার ইস্যু নিয়ে নানা সমস্যা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, যা আগামী নতুন বছরে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে শেষ হবে না। বরং বাড়তে পারে। তাই এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের সঠিক নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধির মোহ কাটিয়ে বাস্তবতার নিরিখে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির এই ক্রান্তিকাল পার হওয়ার জন্য যথাযথ সংস্কার দরকার এবং পদক্ষেপ অবশ্যই রাজনৈতিক পর্যায় থেকেই আসতে হবে। এজন্য জনগণের কল্যাণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ।’
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমানে অর্থনীতিতে চার ধরনের সংকট রয়েছে, যার ফলে অর্থনীতি ক্রমে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত বৈকল্যদশায় পড়েছে। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার ছুটে চলা অব্যাহত রয়েছে, বহিঃখাত পঙ্গুত্বের ভেতরে পড়ছে আর শ্রম খাতে অন্ধত্ব বা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই সংকট উত্তরণে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।’
এ অবস্থায় তিনি ১২টি বড় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেন। সেগুলো হলো—বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), প্রতিযোগিতা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, বেপজা, শ্রম আদালত, শিল্প পুলিশ, বিজিবি, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (এবিবি), প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩