শেখ হাসিনার কূটনীতি নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনের পরেই ভারত, চীন এবং রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি এশীয় এবং মিত্র দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো প্রায় নীরব থেকেছে।  নির্বাচনের এক মাস পর শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে সহযোগিতার চিঠি পান। এরপর গত সপ্তাহের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে।  নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও মার্কিন অবস্থানের এই পরিবর্তন শুধু ওয়াশিংটনের ইচ্ছার ফল নয়, বরং শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দক্ষতারও ফল এটি। বন্ধুত্ব অর্জনের জন্য শেখ হাসিনা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন।  শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত চার মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে পঞ্চম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ হাসিনার এই সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের রাস্তাটি কেমন ছিল? কীভাবে তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসেবে নিজের জায়গাকে শক্তিশালী করেছেন?  আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ হাসিনা। দলের ইতিহাসে অন্য কোনো রাজনীতিবিদ এত দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেননি। আওয়ামী লীগে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। একইসঙ্গে জনসাধারণের কাছেও মুখ্য নেতৃত্ব হয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয় তাকে।   যাইহোক, রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্থান মসৃণ ছিল না। ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে ফেরার পর, বিভক্ত আওয়ামী লীগকে একত্র করা তার জন্য ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২১ আগস্ট বোমা হামলায় আইভি রহমানসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতার হত্যার ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তদুপরি, তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের থেকেও নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এসব বাধা সত্ত্বেও, দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং এর চূড়ান্ত পুনরুত্থানের পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।  আ.লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ‘পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সহজ কীর্তি নয়। বিশেষত যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা তার এক দশকের শাসনামলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করেছেন। তার সরকার ভিন্নমতের কণ্ঠকেও রুদ্ধ করেছে। গুম, খুন, গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’  বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার দীর্ঘ নেতৃত্ব শুধু দলের অভ্যন্তরে এবং দেশের মধ্যে নয় বরং তা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে তার বুদ্ধিদীপ্ত উপলব্ধিও তাকে দর কষাকষির করতে সাহায্য করেছে।  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বলতে গেলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের যেমন উল্লেখ করেছেন, ‘শেখ হাসিনার প্রভাবের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। তিনি সবসময় অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেন, যা আমি মনে করি তার পররাষ্ট্রনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে।’ ওবায়দুল কাদের দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলার সময় এই উদ্বৃতি দিয়েছিলেন।  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। এই অর্থনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।  শেখ হাসিনার ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকে পরিপক্ব করেছেন। দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে যা এই সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত বছর $১৬ বিলিয়নে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। এদিকে, রাশিয়া বাংলাদেশে ১২ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প।  পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক রপ্তানির প্রধান ক্রেতা। ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি করে গত বছর বাংলাদেশ আয় করেছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে স্বীকার করে। ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয় বাজারে পরিণত হচ্ছে। গত নির্বাচনের ঠিক আগে বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সফরকালে তিনি বাংলাদেশ-ফ্রান্স এভিয়েশন জায়ান্ট এয়ারবাসের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মতে, ‘ভৌগোলিক অবস্থান এবং বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশকে ভারত ও চীন উভয় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পাশাপাশি এটি বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম করার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আর শেখ হাসিনার অটল কূটনীতি আজ আমাদের বিশ্ব মঞ্চে একজন উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করেছে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল নীতি, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। কয়েক দশকের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন বাংলাদেশকে অধিকতর আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে আন্তর্জাতিক আলোচনায় যুক্ত হতে এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উভয় প্ল্যাটফর্মে তার স্বার্থ অন্বেষণ করতে সক্ষম করেছে।  বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘‘কূটনীতি ও বাণিজ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্য তার সমকক্ষরা স্বীকার করেন। এ ছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বৈশ্বিক সমস্যা নিয়েও খুব সোচ্চার ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণকে 'গণহত্যা' বলে আখ্যায়িত করে একটি জোরালো বিবৃতি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি তার সরকারও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যান্য দেশকে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শেখ হাসিনা।”  বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা সুজিত রায় নন্দী শেখ হাসিনার দক্ষতার প্রশংসা করে ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রশংসা করতেই হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেছে। তিনি প্রথমে তার দলে শৃঙ্খলা এনেছেন এবং তারপরে তার যোগাযোগের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এবং এই দৃঢ়তা ও শক্তি শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও ভালো করতে সাহায্য করেছে।’ আবু জাকির: সাংবাদিক 
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ডিপ্লোম্যাটে আলী রীয়াজের নিবন্ধ
বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ড. আলী রীয়াজের নিবন্ধ প্রকাশ করেছে দ্য ডিপ্লোম্যাট। আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। ড. রিয়াজ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তার গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, সহিংস উগ্রবাদ, ধর্ম ও রাজনীতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত তার নিবন্ধটি ভাষান্তর করে কালবেলায় তুলে ধরা হলো -   বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধীদলসহ তাদের সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের মধ্যেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে টানা চতুর্থবারের মেয়াদে ক্ষমতায় বসেছে দলটি। নির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার রাখা হয়েছে। নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অনেক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে?  আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়নি। বরং তা এখনও লেখা হচ্ছে : বিরোধীরা যদি বুঝতে পারে, দেশ একদলীয় শাসনের যুগে প্রবেশ করছে, তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে পারে। তারা ভাবতে পারে, রাজনীতির বর্তমান গতিপথই তাদের নিয়তি নয়।  জনসাধারণের কথা বলার এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নাগরিকরা অসন্তোষ ও হতাশা প্রকাশ করছে, তবুও এখন পর্যন্ত কোনো জনরোষ দেখা যায়নি। বিরোধীদলের অংশগ্রহণবিহীন এবং কম ভোটার উপস্থিতির নির্বাচনের পরেও জনগণের কাছ থেকে শক্তিশালী কোনো প্রতিক্রিয়া না আসার জন্য মোটামুটি ৩টি কারণকে দায়ী করা যেতে পারে।  প্রথমত, নির্বাচন এমন হবে সেটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। ২৮ অক্টোবর থেকে, ঘটনার প্রবাহ জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে, নির্বাচন এমনই হবে। আর একারণে মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, নির্যাতিত হওয়ার ভয়। ভয়ের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমরা নিপীড়নের প্রকৃতি প্রত্যক্ষও করেছি। এসবই একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে। তৃতীয়ত, বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অনুপস্থিতি। ১৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলেও তারা একক মঞ্চে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে, জনসাধারণ মনে করেন- এমন একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা নেই যিনি সবাইকে একত্রিত করতে পারেন। ভারত, চীন এবং রাশিয়ারর প্রতিক্রিয়া আগে থেকেই অনুমানযোগ্য ছিল। তারা শেখ হাসিনার বিজয়কে স্বাগত জানান। এদের মধ্যে, চীনের বিবৃতি ছিল সবচেয়ে জোরাল। তারা ‘চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বকে’ একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া মৃদু সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে জোরাল মনোভাব প্রকাশ করেছে, তারা নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নয়’ বলে বিবৃতি দিয়েছে। তবে তার বিবৃতিতে একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতির কথাও বলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  যুক্তরাজ্য জোর দিয়ে বলেছে, এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৌলিক উপাদানগুলো পূরণ করেনি। নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, উন্মুক্ত এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার ছিল না। কানাডা হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের নীতির ঘাটতি হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের কাছ থেকে তীব্র নিন্দা এসেছে, তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা, প্রচারণার সময় এবং নির্বাচনের দিনে আইন লঙ্ঘন ও অনিয়মের ঘটনাগুলো স্বাধীন ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ‘সব বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  চীনের বিবৃতিটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে। বিবৃতিটি কেবল অভিনন্দন বাক্য বা একটি সাধারণ অভিনন্দন বার্তা ছিল না। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে চীন বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।’ বিবৃতিটি চীনের পূর্বের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে। অবশ্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবক্ষয়ের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলোর মনোযোগও স্পষ্ট। তবে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো আবারও গণতন্ত্রের চেয়ে আঞ্চলিক স্বার্থের কথা চিন্তা করছে বলে মনে হচ্ছে যা চীনের আরও উত্থানকে সহজতর করবে।  আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর কার্যত কোনো ভূমিকা ছিল না। বিগত নির্বাচনে এই দলগুলোর জনপ্রিয়তা কেমন ছিল সেই হিসেবে দেখলে এবারের নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কেমন হবে সেটা আগে থেকেই অনুমানযোগ্য ছিল। নির্বাচনে ছিল ৪টি নতুন দল যারা আগে কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২০ টি দল ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল।  এই দলগুলো সরকারের কাছে আসন ভাগ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। পূর্বের নির্বাচনগুলোতে আসন ভাগের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে অনেকেই সংসদ সদস্য হয়েছিল। সরকার এই দলগুলোকে নির্বাচনে যোগদানের জন্য প্ররোচিত করেছিল। একবার এই দলগুলো মনোনয়ন জমা দিলে তারা শাসনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এখন এসব দল ও তাদের নেতাদের কেউ কেউ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করে কান্নাকাটি করছে।  নিঃসন্দেহে আগামী দিনে বিএনপি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে। কিন্তু তারা সংসদের বাইরে থাকবে বলে নয়; দলটি ২০১৪ সালের পর সংসদের বাইরে ছিল এবং গত সংসদে তাদের মাত্র সাতজন সদস্য ছিল। বিএনপির ভবিষ্যৎ কঠিন হতে চলেছে, একারণেও নয় যে তাদের জনসমর্থন নেই। প্রকৃতপক্ষে ২০২২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেছে এবং এই জনসমর্থন ক্রমবর্ধমান বলে দেখা গিয়েছিল। বিএনপিকে ভাঙার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলটি ঐক্যবদ্ধ ছিল। অন্যান্য বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্যবদ্ধ আহ্বান জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এসব ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান প্রমাণিত হয়েছে।  কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের দুর্দশা আরও বাড়বে কারণ তারা শাসকদের কঠোর পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে পারে। কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ‘অদৃশ্য মামলা’, কয়েক বছরের পুরোনো অভিযোগসংক্রান্ত হয়রানি চলতেই থাকবে। অনেককে দোষী সাব্যস্ত করা হবে যেমনটা আমরা নির্বাচনের আগে দেখেছি।   এক অর্থে বিএনপির ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে জড়িত। নিপীড়নের মাধ্যমে দলটিকে নিষিদ্ধ বা আন্ডারগ্রাউন্ডে ঠেলে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তবে নির্বাচনই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ নয়। বিরোধীরা যদি উপলব্ধি করতে পারে, দেশ একদলীয় শাসনের যুগে প্রবেশ করছে, তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে পারে। তারা ভাবতে পারে, রাজনীতির বর্তমান গতিপথই তাদের নিয়তি নয়। সব প্রতিকূলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপাতদৃষ্টিতে বিএনপিই সবচেয়ে শক্তিশালী দল।  আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট 
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

নিউজউইকে প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিখ্যাত আমেরিকান সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইকে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেনের সঙ্গে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। যখন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপায় খুঁজে বের করার জন্য বিশ্ব নেতারা দুবাইতে কোপ২৮ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে সমবেত হয়েছেন।  সম্পূর্ণ নিবন্ধটি কালবেলার পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো: লেটস পুট ব্যাক পিপল অ্যাট দ্য হার্ট অফ ক্লাইমেট অ্যাকশন ॥শেখ হাসিনা এবং প্যাট্রিক ভারকুইজেন॥ জলবায়ু পরিবর্তন হল একটি বৈশ্বিক বিপর্যয় যা গরীবদের ওপর ধনীরা চাপিয়ে দেয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে এটি তাদের নিজেদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দুবাইতে কোপ২৮ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রিত বিশ্ব নেতাদের বুঝতে হবে যে তাদের টপ-ডাউন (উপর থেকে নিচে) পদ্ধতি কখনই কাজ করতে পারে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লড়াইয়ের জন্য আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে এবং এই লড়াইয়ে তাদের অর্থায়ন করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নেতাদের মতদ্বৈততায় জলবায়ু বিপর্যয় থেমে থাকবে না। এর ফলে ইতোমধ্যেই জনপদের ওপর টাইফুন এবং বন্যা হচ্ছে এবং খরার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষুধা ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু তহবিলের একটি ক্ষুদ্র অংশই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করা লোকেদের কাছে পৌঁছায়-তাদের নিজেদের এবং জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্থান ছাড়া তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। জলবায়ু অনাচার ও বৈষম্য আরও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রথম সারিতে থাকা মানুষকে রক্ষায় সাহায্য না করলে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু কার্যক্রমের কোনো মানে হয় না। আমাদের স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক উদ্যোগের জন্য সব প্রয়োজনীয় তহবিল দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে হস্তান্তর করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য নতুন চিন্তাভাবনা এবং একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনার প্রয়োজন। কোপ২৮ এ, বিশ্বকে অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত তহবিলটি অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হতে হবে যাতে আমরা অবকাঠামো পুননির্মাণ এবং জলবায়ু প্রভাবগুলোর সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে খাপ খাইয়ে নিতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের চাহিদা মেটাতে দ্রুত এবং জরুরি ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মুভিং ফরম গ্লোবাল টু লোকাল  গ্লাসগোতে কোপ২৬-এর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে উন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন অর্থের প্রবাহ দ্বিগুণ করে ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে অর্থ প্রদানকারীদের অবশ্যই ২০২২ এবং ২০২৫ এর মধ্যে বার্ষিক অভিযোজন প্রবাহ গড়ে কমপক্ষে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। তবুও অভিযোজন অর্থায়ন প্রবাহ বিকাশে দেশগুলো ২০২১ সালে ১৫ শতাংশ কমে ২১.৩ বিলিয়ন হয়েছে। এই অর্থ খুবই সামান্য। তবুও এই অর্থের ৬ শতাংশেরও কম, এবং সম্ভবত ২ শতাংশের কম স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে জলবায়ু-স্থিতিস্থাপকতা প্রকল্পগুলোতে পৌঁছায়। সঠিকভাবে ট্র্যাকিং এবং অর্থ প্রবাহের প্রতিবেদন না করার কারণে অনুমান পরিবর্তিত হয়-এবং এটির উন্নতি করা দরকার। এর কারণ জলবায়ু নীতি-কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ওপর থেকে নিচে প্রবাহিত হয়।  কোনো শহর, রাস্তা, মাঠ এবং বাড়ি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তা যারা জানে তারাই সেখানে বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের অবশ্যই তাদের একত্রিত হতে এবং তাদের নিজস্ব প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং ক্ষমতায়িত করতে হবে।  এটি বলা সহজ, করা কঠিন। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রায়শই সময় এবং দক্ষতার অভাব হয়। প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করার জন্য তাদের সাহায্য এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং তহবিল সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের মৌলিক জিনিসগুলোর প্রয়োজন যেমন- আইনিভাবে গঠিত সংস্থা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। বাংলাদেশ সবসময়ই স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন জলবায়ু অভিযোজনে একটি শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে এবং সম্প্রতি সরকার স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে জলবায়ু সহায়তা পৌঁছানোর বিভিন্ন উপায় অন্বেষণ করছে। মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অভিযোজনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা সহজ করে তোলে, অভিযোজনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সম্প্রদায় এবং স্থানীয় সরকারগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি জলবায়ু ঝুঁকি তহবিল রয়েছে, সবুজ ব্যাঙ্কিং পরিষেবাগুলো প্রসারিত করে এবং বাস্তুতন্ত্র পরিষেবাগুলোর জন্য অর্থপ্রদানকারী সম্প্রদায়গুলোকে অন্বেষণ করে।  ঢাকায় গ্লোবাল হাব অন লোকালি লিড অ্যাডাপ্টেশনের মাধ্যমে সরকার সমাধান জোরদারে এবং বিশ্বের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সর্বোত্তম অনুশীলন বিনিময় করতে সহায়তা করছে। এই প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে নাটকীয় সাফল্য অর্জন করেছে।  চ্যালেঞ্জ থেকে সম্ভাবনা  বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলায়, মেয়র এবং বাসিন্দারা তাদের জলবায়ু চ্যালেঞ্জের মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ চিহ্নিত করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করছে। অন্যান্য বড় শহরগুলোর মতো, মংলা জলবায়ু অভিবাসীদের একটি বড় আগমন দেখেছে যদিও এটি ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলস্বরূপ-শহরের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহকে দূষিত হচ্ছে। মংলা জনবসতির মানচিত্র তৈরি করছে, জলবায়ুর প্রধান দুর্বলতা চিহ্নিত করছে এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন উদ্যোগের উন্নয়ন করছে। ব্র্যাক, একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং এটি যুক্তরাজ্য এবং কানাডার সরকারের সহায়তায় গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে কাজ করছে। এটি আশা করা যায় যে মংলার জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া অন্যান্য শহর ও শহরগুলোর জন্য একটি ব্লুপ্রিন্ট হয়ে উঠতে পারে। এটি আমাদের দেখায় যে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজনই এগিয়ে যাওয়ার পথ। কিন্তু আমাদের এই পদ্ধতিগুলো ব্যাপকভাবে জোরদার করতে হবে। এজন্য দাতাদের জন্য অযাচিত ঝুঁকি তৈরি না করে আমাদের স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে অর্থায়ন করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোসহ বৃহৎ অর্থদাতাদের পোর্টফোলিওতে জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাগুলোকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি ট্রান্সমিশন বেল্ট হিসাবে কাজ করার জন্য শক্তিশালী মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলো এখানে মূল্যবান হতে পারে। কোপ২৮ তখনই সফল হবে যখন এটি জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটির জন্য প্রকৃত সুবিধা অর্জন করবে। এই বছরের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র সম্প্রদায়ের কাছে অর্থ প্রবাহ এবং স্থানীয় ভাবে নেতৃত্ব, উপযুক্ত এবং কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এটি অর্জন করতে পারি, তাহলে সেটি হবে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর অবিচার প্রতিকারের একটি বড় পদক্ষেপ।   
০১ ডিসেম্বর, ২০২৩

২৮ অক্টোবরের সংঘাত নিয়ে নিক্কেই এশিয়ার নিবন্ধ
শনিবার ঢাকার রাস্তায় সমাবেশ ডেকেছিল বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। পৃথকভাবে তিনটি দলের ডাকা এই সমাবেশে যোগ দিতে রাজধানীতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। সেই সমাবেশকে ঘিরে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং নির্বাচনের আগে তা উত্তেজনার পারদ ছড়িয়েছে।  মহাসমাবেশ ডেকেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার সাবেক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তাদের প্রধান দাবি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে বদ্ধপরিকর।  কিন্তু ইতিমধ্যেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিএনপি এবং জামায়াতের মহাসমাবেশস্থলের পাশেই একই দিনে একই সময়ে পাল্টা সমাবেশ ডাকে তারা। পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষের পাশাপাশি সমাবেশকে ঘিরে উদ্বেগের জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে কিছু বিএনপি কর্মী ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মী এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুপুর আড়াইটার দিকে বিএনপির সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।   বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২৮ অক্টোবর তারিখের একটি তাৎপর্য রয়েছে। ২০০৬ সালের এই দিনে দেশটিতে রাজনৈতিক সহিংসতায় এক ডজনেরও বেশি মানুষ মারা যায়। গত শনিবার সেই একই ধরনের ঘটনার প্রতিধ্বনিত হলো। আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি ফাটল সৃষ্টি হলো।  ২০০৮ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ নিজেদের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের কৌশলের সমালোচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নির্বাচন ঘিরে চাপ বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে বাংলাদেশের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পরাশক্তিশালী এই দেশটি। ভিসা বিধিনিষেধে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের এবং তাদের পরিবারকে আমেরিকার ভিসা দেওয়া হবে না।   বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি বড় বড় রাজনৈতিক সমাবেশ করেছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছিল শান্তিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো চলতে থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরিস্থিতি সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।  রাজনীতি বিশ্লেষক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমি ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কিছু উদ্বেগ দেখতে পাচ্ছি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একটি যুদ্ধাংদেহী ভঙ্গিতে অবস্থান নিচ্ছেন এবং তারা আশা করছেন এটি তাদের দলের সমর্থকদের মনোবল বাড়িয়ে দেবে এবং বিরোধীদের ভয় দেখাবে। অন্যদিকে বিরোধীরা তাদের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান সমর্থনে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানে মনে করছে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পরিবেশ নেই প্রশ্নে সব বিরোধীদের মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য দেখা দিয়েছে।  শনিবারের সমাবেশের আগের দিন পুলিশ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে তাদের পছন্দের জায়গাতেই সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি বলছে, সমাবেশ চলাকালে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার জন্য পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। পুলিশ প্রথমে তাদের সমাবেশের জন্য অন্য জায়গা প্রস্তাব করলেও বিএনপির জোরালো অবস্থানের মুখে পরে তাদের পছন্দের জায়গাতেই সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। গত ডিসেম্বরে পুলিশ দলটিকে অন্যত্র সমাবেশ করতে বাধ্য করেছিল। সে সময় পুলিশ কয়েক দিন ধরে দলটির দলীয় কার্যালয় ঘেরাও করে রেখেছিল এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছিল। তবে পুলিশ এখন অনেকটা নমনীয়। কিন্তু শনিবারের সমাবেশের আগে নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং নজরদারি করতে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের আশপাশে ক্যামেরা স্থাপন করে পুলিশ।  বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, গত কয়েকদিনে তাদের দলের কয়েকশ নেতাকর্মী এবং সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে কারণ তারা সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি'র সমাবেশকে ঘিরে কিছু গণপরিবহন পরিষেবাও বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বিএনপি বলছে, গ্রেপ্তার করে এবং গণপরিবহন বন্ধ করে তাদের কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে।  সমাবেশের আগের দিন শুক্রবার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘গত চার দিনে পুলিশ প্রায় ১৭০০ জন বিএনপি নেতাকর্মী ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।’ অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শনিবার ভোর রাতে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের পাশে একটি ভবন থেকে ২০০ বিএনপি কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন-অর রশিদ সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা নাশকতার পরিকল্পনা করছিল এবং তাদের কাছ থেকে ছোট বোমাসহ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।’ শনিবার দুপুরে বিএনপির সমাবেশ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সমাবেশস্থলের আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে প্রচারিত লাইভ ফুটেজে দেখা গেছে, বিএনপি কর্মীরা তাদের সমাবেশ এলাকার কাছে বেশ কয়েকটি গাড়ি এবং একটি পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায় এবং মূল ফটকের ভেতরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।  বিএনপিকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে মারামারির ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভ দমনে সহায়তা করার জন্য রাস্তায় আধাসামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড নামানো হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, অন্তত একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন এবং বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিএনপি সমর্থক। কয়েকজন সংবাদকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। সমাবেশ বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি।  চলতি বছরের শুরুর দিকে নিক্কেই এশিয়ার সাথে এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করছেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপস নয় বরং সরকারের কৌশলের পরিবর্তন। কারণ সরকার বুঝতে পেরেছে, বিশ্ব তার দিকে নজর রেখেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা সিভিল সার্ভিস এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা ও অস্বস্তির তৈরি করেছে। আর এই সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’ শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপির সাবেক জোটসঙ্গী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে পুলিশ তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি। তবে সমাবেশের আগের দিন জামায়াত ঘোষণা করে- তারা যেভাবেই হোক রাজধানীর মতিঝিলে তাদের সমাবেশ করবে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য শনিবারের মহাসমাবেশে সবাইকে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।  জামায়াত তাদের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের জড়ো করে সমাবেশ করে। প্রশাসন তাদের তেমন কোনো বাধা দেয়নি। জামায়াতের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।  ২৮ অক্টোবর তারিখের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। ২০০৬ সালের এই দিনে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল এবং তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে বিচারপতি কেএম হাসানকে রাখার বিরোধিতা করে। সেদিন ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকায় এবং এর আশপাশে বিএনপি, জামায়াতের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।  পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে আসে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলের অনেক নেতাকে জেলে পাঠানো হয়। শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অসংখ্য আইনি মামলা করা হয়।  ২০০৬ সালে গঠিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং তখন থেকেই দলটি ক্ষমতায় রয়েছে। জনমত জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিরোধীদল এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সংলাপ জরুরি। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করে আনতে হবে। সমাধান না হলে এই সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য শুভ কোনো পরিণতি বয়ে আনবে না।  সাইফুল ইসলাম : সাংবাদিক। ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
৩১ অক্টোবর, ২০২৩

ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে ফ্রি প্রেস জার্নালের নিবন্ধ
‘বিগ ব্রাদার’ শব্দটির অর্থ বেশ নেতিবাচক এবং আপত্তিকর। কোনো বড় ও শক্তিশালী দেশ যখন একটি ছোট ও দুর্বল দেশের ওপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আধুনিক কূটনীতির ভাষায় ‘বিগ ব্রাদার’ বলে ডাকা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারতকেও প্রায়ই ‘বিগ ব্রাদার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এখন নয়াদিল্লির উচিত এই ‘বিগ ব্রাদার’ না হয়ে সত্যিকারের বড় ভাই হিসেবে বাংলাদেশের সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, যাতে দেশটির সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা বন্ধ করে। সরকার যদি ভারতের কথা শোনে, তাহলে তা ভারতের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে।  খালেদা জিয়া দুবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান। ২০২০ সাল থেকে তিনি হাউস অ্যারেস্টে আছেন। গত সপ্তাহে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য খালেদা জিয়ার জার্মানি যাওয়ার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার। তার লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস এবং হার্টের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে বলছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে জরুরি চিকিৎসা না পেলে তার মৃত্যুর ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ জন শীর্ষ চিকিৎসকের একটি প্যানেল ঘোষণা করেছে, তাদের আর কিছু করার নেই।  সরকার শুধু খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতেই বাধা দিচ্ছেন না, বরঞ্চ যুক্তি দিচ্ছেন- তার বয়স এত বেশি যে এমনিতেই যে কোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে।  বর্তমানে বেঁচে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে সব থেকে বিখ্যাতদের একজন প্রফেসর ইউনূস। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার পর তিনি বাংলাদেশিদের কাছে নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে। গরিবের ব্যাংকার হিসাবে পরিচিত প্রফেসর ইউনূস বিশেষ করে নারীদের চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন। বাংলাদেশের বাইরেও বহু মানুষ তাকে অনুসরণ করেন। অনেক বিশ্বনেতাকেই তার ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে গণনা করা যেতে পারে।   কিন্তু এই মাসে ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হতে হয়েছে প্রফেসর ইউনূসকে। এ জন্য তাকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সফর সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের পর ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইউনূস নির্ভয়ে ঘোষণা করেন, তিনি কাউকে ভয় পান না- কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি। ইউনূসের বদনাম ও তাকে ছোট করতে বছরের পর বছর ধরে নানা কথা বলছে সরকার। সরকার প্রকাশ্যে নোবেল বিজয়ীকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলে অপমান করেছে। যে মামলাটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল, তা তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৭৫টি ফৌজদারি ও শ্রম মামলার একটি। সবগুলো মামলাই করা হয়েছে ২০০৯ পরবর্তী সময়ে।  প্রফেসর ইউনূস ২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল চালুর চেষ্টা করেছিলেন আর মূলত তার খেসারত এখনও তাকে দিতে হচ্ছে। সে সময় শেখ হাসিনা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া উভয়কেই সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন কারাগারে পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন হিসেবে সাধারণ বাংলাদেশিরা ইউনূসকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। সে ডাকেই সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনব্যবস্থার একটি বিকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি।  প্রফেসর ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি দল চালু করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আমি আর রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছি না। কিছু করার জন্য এখনই সেরা সময়। পরিস্থিতি অনুধাবন করে দুই মাসের মধ্যেই তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ত্যাগ করেছিলেন। তার খেসারত এখনও তাকে দিতে হচ্ছে।  ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক হয়রানি বন্ধের জন্য ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং শতাধিক নোবেল বিজয়ী। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ইউনূসকে ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকার। পাশাপাশি তাকে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের ইউনূসের পক্ষে লবিং বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার। এস এন এম আবদি : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক  (সংক্ষেপে ভাষান্তর)
২১ অক্টোবর, ২০২৩

ড. ইউনূসকে নিয়ে চিঠি, ইইউ নিউজ প্ল্যাটফর্মে পাল্টা নিবন্ধ
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে নিয়ে সম্প্রতি খোলা চিঠি পাঠানো হয়েছে। যা নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এবার সেই খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ব্রাসেলস-ভিত্তিক ইউরোপীয় অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্ম। যেখানে বলা হয়েছে, খোলা চিঠি পাঠানো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নয় বরং তিনি যে দেশটি শাসন করছেন সেটিরও অবমাননা করা। লন্ডন ভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক সৈয়দ বদরুল আহসান ‘বাংলাদেশ বানানা (কলা) প্রজাতন্ত্র নয়’ শিরোনামে নিবন্ধটি লিখেছেন। নিবন্ধটি তুলে ধরা হলো- যখন ১৭০-এর বেশি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং একই সাথে এটি সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচার করেছিলেন, তখন তারা অনুধাবন করতে পারেননি যে, এই ধরনের কাজটি ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত যা শুধু বাংলাদেশের নেত্রীই নয় বরং তিনি যে দেশটি শাসন করছেন সেটিকেও অবমাননা করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চিঠিতে ব্যবহৃত ভাষাও এমন ভাষা নয় যা সরকার প্রধানকে সম্বোধন করার জন্য প্রযোজ্য। আমরা নোবেল বিজয়ীদের ও সেইসাথে অন্যদের কথা বলি যারা সম্প্রতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে কথা বলা উপযুক্ত বলে মনে করেছেন, যিনি সম্প্রতি বাংলাদেশে আইনি জটিলতায় নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। বাংলাদেশে তিনি ব্যাপকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার অবদান বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত। ১৭০ জনের বেশি ব্যক্তির চিঠিতে তাকে সমর্থনের বিষয়টি উদ্বেগজনক এই কারণে যে, এই ব্যক্তিরা তাদের চিঠির মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে এমনভাবে চাপে রাখতে চেয়েছিলেন যা কেবল অপ্রীতিকর নয় বরং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থি। প্রকৃতপক্ষে, চিঠির বিষয়বস্তু যা সুস্পষ্ট করেছে, তা কেবল দুঃখজনকই নয়, বরং আপত্তিকরও। যিনি তার আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট কিছু আইনি সমস্যার জন্য লড়াই করছেন এমন একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করার বিষয়ে কথা বলে চিঠির লেখকরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান আদালতের কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন চিঠির লেখকরা। তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি নিরপেক্ষ বিচারকের একটি প্যানেল দ্বারা পর্যালোচনা করা হোক। তারা আরও জানিয়েছে যে, সুবিচারের জন্য পর্যালোচনার অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু বিশেষজ্ঞকে বিচারের বোর্ডে আনা উচিত। তারা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে (ইউনূসের) বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী ও শ্রম আইনের মামলাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার ফলে তিনি খালাস পেয়ে যাবেন।’ সকলকে অবাক করে দিয়ে তারা বাংলাদেশের নেত্রীকে হুঁশিয়ার করে বলেছে, আগামী দিনগুলিতে কীভাবে এই বিষয়গুলি সমাধান করা হবে তা নিবিড়ভাবে ট্র্যাক করার জন্য আমরা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ উদ্বিগ্ন নাগরিকের সাথে যোগ দেব। চিঠির লেখকরা সম্ভবত এই পয়েন্টটি মিস করেছেন, সেটি হল যে একবার আইনের আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হলে, যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছার জন্যই সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। বিশ্বের কোথাও এমন কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই যেখানে একটি মামলা, একবার এটি আদালতে শুরু হলে, কার্যক্রম থেকে অপসারণ করা এবং একটি 'নিরপেক্ষ বিচারকদের প্যানেল'-এর কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। কারণ এটি হবে আইনের সঙ্গে প্রতারণা। এছাড়াও, একটি দেশের স্বাভাবিক আইনে পরিচালিত একটি মামলা স্থগিত করা এবং এর বিবরণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের কাছে পর্যালোচনার জন্য হস্তান্তর করার বিষয়টিও বোধগম্য নয়। চিঠিটি, একাধিক উপায়ে, বাংলাদেশ সরকারকে ঘায়েল করার একটি অপপ্রয়াস এবং বাংলাদেশের জনগণকে একদল লোকের সামনে নতজানু করার প্রয়াস, যারা প্রফেসর ইউনূসের কল্যাণের কথা মনে রেখেছেন কিন্তু তারা দেশটির সরকারের ওপর তাদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য তাদের অধিকার সম্পর্কে অহংকার প্রকাশ করেছেন। এটা আইনের শাসন থেকে বিচ্যুতি। চিঠির লেখকরা অধ্যাপক ইউনূসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি ট্র্যাক করার কথা বলেছেন, যা বাস্তবে সরকারের জন্য একটি হুমকি। তারা দাবি করে যে তারা তাই করবে ইচ্ছামতো যা তারা করতে চাইবে ...   নোবেল বিজয়ী ও অন্যরা যারা চিঠিতে তাদের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা স্পষ্টতই ইউনূসের বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে যা এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ সকলের সন্তুষ্টির জন্য করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রশ্নে প্রফেসর ইউনূসের রক্ষার বিষয় থেকে চিঠির লেখকরা সরে গেছেন। তাদের কথাগুলো লক্ষ্য করুন- আমরা বিশ্বাস করি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অসঙ্গতির বিষয়ে ভুল করা উচিত নয়। চিঠির পিছনের উদ্দেশ্যটি অনুধাবন করা কঠিন নয়। বাংলাদেশে আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্ধারিত নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে পথ দেখানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য এতে রয়েছে। হঠাৎ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার ধারণাটি ওঠে আসেনি যা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে ঠেলে দেবে বলে মনে হচ্ছে। চিঠির লেখকরা কেন ইউনূস মামলার সঙ্গে নির্বাচনের যোগসূত্র বেছে নিয়েছেন সেটি একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন। স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্টতই কাজ করেনি। কাউকে অবাক করবে না যে, যারা এই চিঠিটি লিখেছেন এমন অনেক নারী ও পুরুষ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের অপছন্দ কখনও গোপন করেননি। এটা দুঃখজনক, যারা চিঠিটি পড়েছেন তাদের জন্য নয়, চিঠির লেখকদের জন্য। বাংলাদেশ সরকারের এমন প্রকাশ্য নিন্দা যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার কারণ হবে তা বুঝতে তাদের ব্যর্থতা দুঃখজনক। চিরকালই তাদের ঐতিহ্যের জন্য গর্বিত একটি জাতি এই বাংলাদেশের জনগণ চিঠির মনোভাব ও বিষয়বস্তু দেখে হতবাক। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই চিঠি লেখকরা অতীতে বিশ্বজুড়ে জনসাধারণের মনোভাব সম্পর্কে অন্যান্য সরকার প্রধানদের কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা তা নিয়ে দেশে প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নগুলি লক্ষ্য বিবেচনা করুন: কয়েক দশক ধরে গুয়ানতানামোতে বিনা বিচারে আটকে থাকা এবং কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে এই বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বরা কি কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপতির কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন? কোন কারণ ছাড়াই ২০০৩ সালে  স্বাধীন দেশ  ইরাক আক্রমন থেকে  বিরত থাকতে এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম  হোসেনকে বিচারের নামে প্রহসন করে যখন ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এই বিশিষ্ঠ ব্যক্তিরা কি তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে কোন  চিঠি লিখেছিলেন? এই চিঠি লেখকরা কি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হয়রানি বন্ধে, তার বিরুদ্ধে ১৫০ টির বেশি মামলা প্রত্যাহার  এবং তার মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে একটি উন্মুক্ত বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেছেন? চিঠির লেখকরা নিজেদেরকে আইনের শাসনে বিশ্বাসী বলে মনে করে। তবে তারা কি  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাদের বর্বর ভূমিকার কথা জেনেও কখনো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত দুই খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে মার্কিন ও কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেছে। ২০০১ সালে অক্টোবরে  সাধারন নির্বাচনে জয়ের পরপরই আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জোট সমর্থকরা যে তান্ডব চালিয়েছিল, তখন এর বিচার চেয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে এই ধরনের কোন চিঠি পাঠানো হয়েছিল? এই ব্যক্তিবর্গ কি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন এবং এটিকে পশ্চিমা সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচার করে দাবি করেছেন যে আলেক্সি নাভালনির বিরুদ্ধে সমস্ত  আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিতে হবে এবং তাকে মুক্তি দিতে হবে? এই চিঠি লেখকরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ পর্বে কোথায় ছিলেন? তারা কি যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে কোন খোলা চিঠি লিখেছেন যে, গণমাধ্যমের  স্বাধীনতার স্বার্থে অ্যাসাঞ্জকে তার পেশা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তি দিতে হবে? এই চিঠির লেখকদের মধ্যে কতজন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে বন্দী অং সান সুচির বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার এবং মিয়ানমারের নির্বাচিত নেতা হিসাবে তাকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন? মিয়ানমারের  রাখাইন রাজ্যের  লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের কবে দেশ ফিরিয়ে নেয়া হবে সে বিষয়ে  এসব ব্যক্তি কি মিয়ানমারের জান্তার কাছে জানতে চেয়েছেন? মিশরে সাংবাদিকরা বছরের পর বছর ধরে সে দেশের কারাগারে বন্দি। রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কাছে কি তাদের মুক্তির জন্য কোনো খোলা চিঠি লেখা হয়েছে? কয়েক বছর আগে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খুন হন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। এই নোবেল বিজয়ী এবং বৈশ্বিক নেতারা কি সৌদি সরকারকে চিঠি লিখে এই ট্রাজেডির সত্যতা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন? ২০০৯ সালে সালে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হাতে এলটিটিই-এর পরাজয়ের পর তামিল সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচার  হয়েছিল এবং তামিলদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো খোলা চিঠি তো পাঠানো হয়নি। সুষ্ঠু বিচারের জন্য ভন্ডামি কোন বিকল্প নয়। যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছেন তারা স্পষ্টতই প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ সরকারকে বিচক্ষণ কূটনৈতিক উপায়ে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা যে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ীকে তাদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছেন এটা মূলত বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর একটি কৌশল। একজন ব্যক্তির একটি ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করার বিষয়ে কৌতূহলী হওয়া ও অনাকাক্সিক্ষত কাজটি নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ার চেয়ে বরং ১৭০-এর বেশি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বদের আরও ভাল কিছু চিন্তা করা উচিত ছিল। কৌশলটি সম্ভবত কাজ করেনি।
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ / বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অবস্থান বদলাচ্ছে ভারত?
২০২৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা বেশ লক্ষণীয়। গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে ভারত সরকার। এর মধ্যে বিএনপি ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে বৈঠক করেছে আর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দল বৈঠক করতে দিল্লি সফর করেছে। এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এই ধরনের বৈঠকের ঘটনা প্রথম দেখা গেছে। বাংলাদেশের সরকার ও আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের অবস্থান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে সেটির একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে এই নিবন্ধে। কালবেলার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো… আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে। গত মার্চে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে দেখা করা ছাড়াও জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল আগস্টের শুরুর দিকে ভারত সফর করে। এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে ভারত এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলের মধ্যে এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রথম দেখা গেছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ভারত যদি নিয়ম রক্ষার খাতিরেও বৈঠক করে থাকে, তারপরও এটিকে একটি পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলেছে, ‘নয়াদিল্লির প্রতি বিএনপির নীতিতে কোনো স্পষ্ট পরিবর্তনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে না ভারত।’ আরেকটি বিষয় হলো—গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন অনুসন্ধান মিশন ভারতবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করলেও প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে ভারতকে সংযত থাকতে দেখা গেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সংশ্লিষ্ট সম্পর্কিত কোনো বিবৃতি দেয়নি। মজার বিষয় হলো—ভারতীয় রাজ্যগুলোর অনেক আঞ্চলিক পত্রিকায় জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করা হলেও ভারতের নেতৃস্থানীয় জাতীয় গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে, ইইউ—জামায়াত মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য না করে বরং নীরবে সয়ে যাচ্ছে ভারত! এসব উদাহরণগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারত ২০২৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করছে। তবে নানা বিষয় থেকে আওয়ামী লীগ হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মোদির মন্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন তোলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শেখ হাসিনা ভারতের বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। ভারত সফরে গেলে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তিনি দেখাও করেন। গত ৩ আগস্ট ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সহিংসতামুক্ত এবং যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করতে ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নির্বাচনের বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য তৈরির জন্য যে বৈঠক করেছে সেখানেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। বলা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় ভারত যে নীতি গ্রহণ করেছিল, এবার তাতে অনেকটা পরিবর্তন আসতে পারে। সে সময় নির্বাচন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবে বড় পার্থক্য ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতাসহ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে মোদির দ্রুত অভিনন্দন জানানোর বিষয়টিকে অনেকখানি হালকা করে দিয়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগও আন্তর্জাতিক ধাক্কা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মোদি-হাসিনার বন্ধুত্বের কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত প্রতিবেশী দেশে এমন একটি সরকার খুঁজে পেয়েছে যা সন্ত্রাসবিরোধী, ভারতবিরোধী নয় এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, আবার দুশ্চিন্তারও কারণ হতে পারে। সম্প্রতি ভারতের মণিপুর রাজ্যে চলমান সংঘাতের পটভূমিতে মেইতেই সম্প্রদায় বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ভারতকে যেসব সুবিধা দিয়েছে, তা নিরঙ্কুশ নয়। এই অবস্থায় এসে মনে করা হচ্ছে, ২০১৮ সালের তুলনায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে এটা সঠিক, এটা শুধু ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্যই নয়, পরবর্তী নির্বাচনগুলোর জন্যও বটে। নিবন্ধটির লেখক অর্কপ্রভো হাজরা ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে যোগাযোগ এবং কৌশল নির্ধারণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জামায়াত নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ প্রকাশ (১ম পর্ব)
চলতি বছরের জুনে রাজধানী ঢাকায় একটি সমাবেশ করেছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিউজ ফুটেজে দেখা গেছে, সেই সমাবেশে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। এটি ছিল এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দলটির করা প্রথম কোনো সমাবেশ।  সমাবেশে জোরালো একটি বার্তা দিয়েছে দলটি। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে জামায়াত চাপের মধ্যে থেকেও টিকে আছে।  দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত সিডনিভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক মোবাশ্বের হাসানের এক নিবন্ধে এ কথাগুলো উঠে এসেছে। নিবন্ধে আরও বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সুসংগঠিত ইসলামিক দল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করেছিল। এর বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।  বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাবেক নির্বাচনী শরীক জামায়াতে ইসলামী। দলটি ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে অংশীদার ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, বিরোধী দলগুলো এবং বিশেষ করে জামায়াতকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকদের উপর চালানো ভয়াবহ সহিংসতায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নামে এই ঘরোয়া আদালত গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অপরাধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দেয়।  আইসিটি ট্রায়াল এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া জামায়াতের উপর কঠিনভাবে আঘাত হানে। এতে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে হারিয়েছে দলটি। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়া জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতার ছেলেও গুমের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গুমের শিকার হওয়া দুজন হলেন- প্রয়াত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম এবং জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযমের ছেলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আজমি।   জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযম এবং জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী দুজনই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আদালতের রায়ে  মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল এবং গোলাম আযম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারেই মারা যান।   আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের বিরুদ্ধে এবং জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়া এসব রায়ের বিরুদ্ধে সহিংসভাবে প্রতিবাদ করেছিল জামায়াত। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অনেক কর্মীকে হারিয়েছে জামায়াত এবং তার ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির।  জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে তাদের প্রায় ২৪০ কর্মী নিহত হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ হাজারের বেশি মামলা এবং ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সাড়ে ৯ হাজার মামলা রয়েছে। নারীসহ দলটির ৯০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছে। তবে স্বাধীনভাবে এই পরিসংখ্যান যাচাই করা সম্ভব হয়নি।  জামায়াতের অনেক কর্মী স্থানীয়ভাবে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন এবং আরও অনেকে মালয়েশিয়া, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে নির্বাসনে গিয়েছিলেন।   জামায়াত সবচেয়ে বড় আঘাতটি পায় হাইকোর্ট যখন দলটির নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ দেন।   আওয়ামী লীগের মিত্র তরিকত ফেডারেশনের দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেন হাইকোর্ট। যেখানে বলা হয়েছে, ‘জামায়াত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। সুতরাং জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণে করতে পারবে না।’ জামায়াত এবং এর কার্যক্রমের উপর দীর্ঘ ১৫ বছরের চাপের পরও দলটি টিকে গেছে বলেই মনে হয়। গত জুনে রাজধানীতে জামায়াতের সমাবেশ প্রমাণ করে- দলটি এখনও বিশাল সমাবেশ এবং বিক্ষোভ সংগঠিত করার ক্ষমতা রাখে।  পুলিশের একটি গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত ১৫ বছরে জামায়াতের স্থায়ী সদস্য সংখ্যা ২৩ হাজার ৮৬৩ থেকে বেড়ে ৭৩ হাজার ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দলটির স্থায়ী সদস্য সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে চাপের মধ্যেও জামায়াত উন্নতি লাভ করেছে। মার্কিন স্কলার এবং দলটির একজন রুকন বা স্থায়ী সদস্য নকিবুর রহমান দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ‘জামায়াত একটি আদর্শভিত্তিক দল। অতএব ক্রমাগত নিপীড়নের পটভূমিতে এটি হারিয়ে যাচ্ছে না।’    নকিবুর রহমান জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে এবং তার দলের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।  জামায়াতের গবেষকরা দলের টিকে থাকার কৌশলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দলটি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে এবং লোকেদেরকে রাজনৈতিক দলে যোগদানের আহ্বান জানানোর পরিবর্তে ধর্মীয় পথ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর কৌশল গ্রহণ করার চেষ্টা করছে।    একইসাথে নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকতে তারা স্থানীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দিয়েছে। পাশাপাশি গ্রেফতার এড়াতে এর কর্মীরা সদা তৎপর রয়েছে। (১ম পর্ব) মোবাশ্বর হাসান: সিডনি-ভিত্তিক স্কলার এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক
৩০ আগস্ট, ২০২৩
X