বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে কমিটি গঠন হাইকোর্টের
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রতিবাদকারী ‘প্রতিরোধ যোদ্ধাদের’ (১৯৭৫-১৯৭৯) চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সুপারিশ করতে চার সচিবের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, সমাজকল্যাণ সচিব ও অর্থ সচিবকে নিয়ে করা এ কমিটিকে ৪ আগস্টের মধ্যে ‘প্রতিরোধ যোদ্ধাদের’ চিহ্নিত করার বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পাঁচ ব্যক্তির করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত। আইনজীবী বাকির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন সামরিক সরকার মিছিল-মিটিং বন্ধ করে দেয়। তা সত্ত্বেও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, খুলনা, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ ও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ হয়। ১৯৭৫ সালে জাতীয় মুক্তি বাহিনী ও জাতীয় মুজিব বাহিনী নামে দুটি সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুভক্ত ছাত্র, তরুণ ও মুক্তিযোদ্ধারা তখন ওই বাহিনীতে যোগ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৪৭ বছর পার হলেও সেই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই পাঁচজন প্রতিরোধ যোদ্ধা ২০২২ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটের শুনানি শেষে রায় দিলেন হাইকোর্ট।
৩০ এপ্রিল, ২০২৪

বঙ্গবন্ধু হত্যা শুধু ক্ষমতার জন্য ছিল না - মতিয়া চৌধুরী
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ছিল না। এটা ছিল একটি দর্শন, আদর্শ ও স্বপ্নকে হত্যা করা। সোমবার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন ও বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন মিয়া, শেকৃবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. অলক কুমার পাল, কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব আমিনুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অ্যাসোসিয়েশন সহসভাপতি ডা. মো. মাহবুব আলম ফারুক।
২৯ আগস্ট, ২০২৩

সিআইএ, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং মার্কিন দূতাবাস (তিন)
ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ স্টেশনের চিফ ফিলিপ চেরি স্বীকার করেছেন, চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বরাবরই তার যোগাযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ তিনিই ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ সেই সংবাদ বুলেটিনও প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে আমেরিকার চক্রান্ত কতটা গভীর ছিল। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটা এই যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই বীভৎস কালরাতে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের অবস্থা কী ছিল? আগে থেকেই ১৫ আগস্ট দূতাবাসের ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হলেও সারারাত ওই দূতাবাসে ছিল অসীম কর্মব্যস্ততা। দূতাবাসের উচ্চপদস্থ অফিসারদের অধিকাংশই সেদিন অফিসে রাত কাটিয়েছেন। এ বিষয়ে ভারতীয় সাংবাদিক পরেশ সাহা তার ‘মুজিব হত্যার তদন্ত’ বইয়ে বলেছেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, শেখ মুজিবকে যেদিন হত্যা করা হয়, সেদিন রাতে মার্কিন দূতাবাস খুবই কর্মচঞ্চল ছিল। উচ্চপদস্থ অনেক অফিসারই সেদিন ঘুমোতে যাননি। ...ওই অভ্যুত্থানের সময় শেখ সেলিম ও শেখ মারুফ তাদের বাড়িতে নিকটবর্তী মার্কিন দূতাবাসের প্রধান সচিবের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যান। কিন্তু প্রধান সচিব তখন বাড়ি ছিলেন না। সারারাতই তিনি দূতাবাসে কাটিয়েছেন। তার পত্নী শেখ ভ্রাতৃদ্বয়কে বাড়িতে বসিয়ে স্বামীর কাছে টেলিফোন করেন। সব কথা জানান। প্রধান সচিব ওয়াশিংটন থেকে অনুমতি আনিয়ে মাত্র দিন কয়েকের জন্য তাদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে সম্মত হন। অবশ্য শেখ সেলিম ও তার ভাই এক দিনের বেশি সে বাড়িতে থাকেননি।’ আবার পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সকাল থেকে আবছা মেঘের আড়ালে একটি গাড়ি ঢোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গাড়িটি পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে যায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে বাইরে চলে যায়। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গোলাগুলি চলেছে। গাড়িটির বিবরণ ও প্লেট নম্বর দেখে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম নিশ্চিত হন যে, গাড়িটি মার্কিন দূতাবাসের। ১৫ আগস্ট সকালে ওই গাড়িটি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আবার বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘাতক ফারুক বলেছে, তার লোকেরা যখন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল তখন ঢাকার রাজপথে বহুসংখ্যক মার্কিন দূতাবাসের গাড়ির আনাগোনায় সে অবাক হয়ে যায়... অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতে (১৯৭৫ সালের ১৪-১৫ আগস্ট) ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের প্রধান সচিব বাসায় ফেরেননি। সারারাতই দূতাবাসে ছিলেন। কেন ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা সিদ্ধান্তই আমাদের মনে আসবে, ওইদিন ভোররাতে (ইংরেজি ক্যালেন্ডার মতে ১৫ আগস্ট) অভ্যুত্থানের খবর তাদের কাছে ছিল। ১৫ আগস্ট রাতে ওই দূতাবাসের এ ধরনের কর্মব্যস্ততা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। আমাদের সংগৃহীত তথ্যাদিও প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে যে আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্র কাজ করে, তাদের প্রধান ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। এরপরই পাকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার দু-একটি মুসলিম রাষ্ট্র—বিশেষ করে সৌদি আরবের স্থান। এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীর দলই বাংলাদেশে তাদের ক্রীতদাসদের দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর উদ্দেশ্য একটাই। বাংলাদেশের পালের হাওয়াকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের তল্পিবাহক করা। কিন্তু চক্রান্তকারীদের এ উদ্দেশ্য যে পুরোপুরি সফল হয়নি, বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাসে তার প্রমাণ মিলবে। লেখাটি সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত। (চলবে)
১১ আগস্ট, ২০২৩

সিআইএ, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং মার্কিন দূতাবাস (দুই)
ঢাকার সিআইএর স্টেশন চিফ (১৯৭৪-৭৬) ফিলিপ চেরি ভারতীয় সাংবাদিক পরেশ সাহাকে (ঢাকায়) বলেছেন, ঘাতক চক্রের সঙ্গে সিআইএর যোগাযোগটা এত ভালো ছিল যে, অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পেরেছিলেন। ফিলিপ স্বীকার করেন যে, তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে খবর পাঠান, তখনো (ঢাকায়) অভ্যুত্থান চলছিল। অন্যদিকে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার জানান, বঙ্গবন্ধুবিরোধী অভ্যুত্থানের সঙ্গে ফিলিপ চেরি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। বিদেশ দপ্তরের ওই অফিসার ও অন্যান্য সূত্র বলেন, ‘মোশতাক চক্রের সঙ্গে এ যোগাযোগ ছিল ১৯৭১ সালে, সেই কলকাতা থেকেই। তৎকালীন মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ-পাকিস্তানের একটি পৃথক শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্য মোশতাক চক্রের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। ১৯৭১ সালে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্লুপ্রিন্ট তৈরির পর প্ল্যানিং সেল গঠনের জন্য সিআইএ আবার তাদের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ করে। ঢাকায় নিযুক্ত সিআইএর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ব্যাপারটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন। কিন্তু... চেরি তার কথা শেষ করেননি। তা শেষ না করলেও বোঝা যায়, তিনি কী বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যা ঘটেছে সে সম্পর্কে সবকিছুই তার আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু সরকারি গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সেসব কথা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তিন দিন আগেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল। এ ছুটি ছিল তালিকাবহির্ভূত। ওইদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে কারও মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ১৫ আগস্ট হঠাৎ ছুটি ঘোষণা করেছিল কেন? এর উত্তরটাও বেশ সহজ, কেননা তাদের কাছে আগাম খবর ছিল, ওইদিন সৈন্যবাহিনীর একদল চক্রান্তকারী অফিসার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করবে। অন্যদিকে ওই বছর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মাহবুবুল আলম চাষী ছিল তার রাঙামাটির খামারবাড়িতে। দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ায় সে কুমিল্লায় আসে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন তিনেক আগে সে গা-ঢাকা দেয় ঢাকায়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকে দেখা যায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রে। নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের পাশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের যে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, এ বিষয়টি আরও কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণে বেশ পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম ঘোষণা আসে ওয়াশিংটনে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ থেকে। এ ঘোষণা দ্রুত পৃথিবীময় ছড়িয়ে যায়, তখনো অভ্যুত্থানের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। হত্যাকারীদের গাড়িগুলো তখনো ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে। লেখাটি সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত। (চলবে)
১০ আগস্ট, ২০২৩

সিআইএ, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং মার্কিন দূতাবাস (এক)
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর যাত্রা শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের হাত ধরে। এই ট্রুম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের আত্মসমর্পণ ত্বরান্বিত করতে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ট্রুম্যানসৃষ্ট এই সিআইএ জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি করছে, সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে, নির্বাচিত গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সরকারগুলোকে উৎখাত করছে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করে নিজেদের পছন্দসই সরকার প্রতিষ্ঠা করছে। কোরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত এবং কঙ্গো ও ইরানের সরকার উৎখাত করে একনায়কদের অধিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলেছে এ ঘাতক সংস্থাটি। নিজেদের স্বার্থে সিআইএ একদিকে যেমন প্রকাশ্যে আমেরিকাবিরোধী গোষ্ঠী আল-কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, তেমনি কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি ও মাফিয়াদের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছে। ৭২ বছর বয়সী এ সংস্থার ইতিহাস এক দীর্ঘ চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের রক্তাক্ত ইতিহাস। তবে সিআইএর গোপনীয়তার দেয়াল এতই শক্তিশালী যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তেমন কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না। যে কোনো অভিযোগই অস্বীকার করতে পারে সংস্থাটি। সিআইএর অবসরপ্রাপ্ত এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টম ডনোহই স্বয়ং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সিআইএ এমন কিছুই করে না, যা অস্বীকারের ক্ষমতা তার নেই।’ সিআইয়ের কার্যক্রম শুধু সাম্রাজ্যবাদী সামরিক হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, আরও নানারকম অভিনব উপায়ে বিশ্বের দেশে দেশে, বিশেষভাবে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে হত্যা অথবা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে, সেটি শুধু কয়েক বছরের ঘটনা নয়। প্রায় সাত দশক ধরে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশেও তাদের বহুবিধ অপকর্ম চলছে। এদের অপকর্মের তালিকা শেষ হওয়ার নয়। হত্যা, গুপ্তহত্যা, যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র এসবই লেগে আছে ৭২ বছর বয়সী সিআইএর প্রতিটি অংশে। আগেই বলেছি সিআইএর উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্লুপ্রিন্ট এবং গঠিত হয়েছিল প্ল্যানিং সেল। আর এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল মার্কিন দূতাবাস। মার্কিন দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক সূত্রে প্রকাশ—বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের মার্কিন দূতাবাসের অফিসিয়ালদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসে দূতাবাসের মধ্যে দফায় দফায় মিটিং হয়। মার্কিন গোয়েন্দা চক্র বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে আমেরিকা কীভাবে, কতখানি যুক্ত, তা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুল্টজ তার ‘বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন’ গ্রন্থে। ওই বইয়ে লিফসুল্টজ আরও কয়েকটি তথ্য তুলে ধরেছেন—এক. মার্কিন বিদেশ দপ্তরের অফিসাররা তাদের বলেছেন, যে চক্রটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে তাদের প্রতিনিধিরা ১৯৭৪ সালের শরৎকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চায়। দুই. ওই বিদেশ দপ্তরের সূত্র থেকেই জানা যায়, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএর স্টেশন চিফ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ওই সূত্রেই লিফসুল্টজকে জানিয়েছে যে, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, এবিএস সফদার ছিলেন তখন মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর মুখ্য এজেন্ট। এই সফদার যুক্তরাষ্ট্রে সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা সে অনেক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিল। লেখাটি সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে উদ্ধৃত। (চলবে)
০৯ আগস্ট, ২০২৩

টেনিস কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্ত
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে জেনারেল জিয়া একপর্যায়ে টেনিস কোর্টকে বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পাকিস্তানি-মার্কিন চক্রের প্ল্যানিং সেলের দুই সদস্যের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ দিতেন। বিষয়টি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে লে. কর্নেল হামিদ জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সিনিয়র অফিসাররা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট টেনিস কোর্টে নিয়মিত টেনিস খেলতাম। ১৪ আগস্ট বিকেলবেলা জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল মামুন, কর্নেল খোরশেদ এবং আমি টেনিস খেলছিলাম। তখন আমি লক্ষ করলাম, চাকরিচ্যুত মেজর ডালিম এবং মেজর নূর টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের দুজনকে পঁচাত্তরের আগস্টের প্রথম দিক থেকে এরূপভাবে দেখেছি। এটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়, কারণ তারা ছিল চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। একদিন জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলেন, এরা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার, এরা কেন এখানে টেনিস খেলতে আসে? এদের মানা করে দেবেন, এখানে যেন আর না আসে। খেলা শেষে আমি মেজর নূরকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা কার অনুমতি নিয়া এখানে খেলতে আস? জবাবে জানায়, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতিতে খেলতে আসে।’ জেনারেল সফিউল্লাহ, কর্নেল সাফায়াত জামিল এবং কর্নেল হামিদের জবানবন্দি সাক্ষ্য আইনের আলোকে বিশ্লেষণ করলে কোনো আদালতের পক্ষেই জিয়াকে দোষীসাব্যস্ত করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। এ কথা ফৌজদারি আইনে মোটামুটি ধারণা আছে—এমন সব আইনজীবীই বলবেন। সাক্ষ্য আইনে একটি তত্ত্ব রয়েছে, যাকে বলা হয় সার্কামন্সট্যানশিয়াল এভিডেন্স বা পরিস্থিতিগত সাক্ষ্য। এ কথাও বলা হয়, একজন চাক্ষুষ সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে; কিন্তু পরিস্থিতি মিথ্যা বলতে পারে না। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দুই খুনি ডালিম ও নূর টেনিস কোর্টের পাশে ঘুরঘুর করছিল, সেখানে জিয়াও টেনিস খেলছিলেন। লে. কর্নেল হামিদের টেনিস খেলা সম্পর্কীয় জবানবন্দিও সার্কামন্সট্যানশিয়াল সাক্ষ্যকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। এটা সবারই জানা, সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলার বিধি-বিধান কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। যেখানে টেনিস কোর্টটি ছিল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত, সেখানে জিয়াউর রহমান কর্তৃক আগস্ট মাসব্যাপী এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে চাকরিচ্যুত নিম্ন মর্যাদার কর্মকর্তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেনিস কোর্টে ঘোরাফেরা করতে দেওয়ার ঘটনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন হলো, কেন তারা টেনিস কোর্টের চারপাশে ঘোরাফেরা করত, যেখানে জিয়াও খেলতেন এবং কেনই বা জিয়া এই দুজন নিম্ন মর্যাদার অফিসারকে সেখানে প্রতিনিয়ত যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর একমাত্র গ্রহণযোগ্য জবাব হতে পারে এই যে, গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে জিয়ার পক্ষে এই দুজন খুনির সঙ্গে টেনিস কোর্টের আশপাশে খেলার ছলে কথা বলা সহজ ছিল। লেখাটি সাংবাদিক আবেদ খান রচিত ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে উদ্ধৃত। (চলবে)
০৬ আগস্ট, ২০২৩

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী নুরুল ইসলাম মারা গেছেন
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম খান মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। গতকাল বুধবার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান সাবেক এসপি নুরুল ইসলাম। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। নুরুল ইসলাম খানের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাহিদ খান জানান, তার বাবা বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৫০তম এ সাক্ষীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গভীর শোক প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় আহত অবস্থায় ধানমন্ডি থানায় প্রথম জিডি করেন নুরুল ইসলাম খান। পরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাক্ষী হওয়ায় তার ওপর দুবার আক্রমণ চালানো হয়।
০৮ জুন, ২০২৩
X