বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ‘তীর’
কলেজ ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে এক দিন ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার এবং ক্যাম্পাসের গাছে গাছে আবাস গড়া পাখিদের নিরাপদ রাখতে একদল শিক্ষার্থী গড়ে তুলেছিলেন ‘তীর’ নামে পরিবেশবাদী এক সংগঠন। বগুড়ার কলেজ ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা সেই সংগঠনটির কাজ গত ১২ বছরে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আটটি জেলায়। ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণী রক্ষা, নদী ও জলাধার রক্ষাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে রূপ নেওয়া ‘টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ (তীর)’ নামের সংগঠনটি এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন স্বর্ণপদক।
গত বছরের ২১ মে ভোর সাড়ে ৫টায় বগুড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যায় স্মরণকালের সর্বোচ্চ গতির ঝড়। ৮৮ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া মাত্র ৪ মিনিটের ঝড়ে ভেঙে পড়ে শত শত গাছপালা। লন্ডভন্ড হয়ে যায় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেঙে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। মানুষের পাশাপাশি সেসময় চরম সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে পাখি ও বন্যপ্রাণী। এ খবর পেয়েই বেরিয়ে পড়েন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের একদল শিক্ষার্থী। তারা বগুড়া শহরের দুটি পৌর পার্কসহ কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বেশকিছু পাখি। সেসব পাখিকে চিকিৎসা দিয়ে পরে অবমুক্ত করা হয় মুক্ত আকাশে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে বগুড়া শহরের যেখানে-সেখানে কাক মরে পড়ে থাকতে দেখে শহরবাসী। বিষয়টি কলেজ শিক্ষার্থীদের নজরে এলে তারা সেই কাকের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে জানা যায় যে, ডাস্টবিনের
বিষাক্ত খাবার খেয়ে মরছে এসব কাক। পরে অনুসন্ধান করে তারা বের করে—শহরের অ্যাডওয়ার্ড পৌর পার্কের পাশের ডাস্টবিনে ফেলা হয়েছিল সেই বিষাক্ত খাবার। স্থানীয়দের মাঝে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালান তারা। এতেই বন্ধ হয়ে যায় কাকের মৃত্যু।
শুধু ঝড়ে পাখি উদ্ধার বা কাকের জীবন বাঁচানোই নয়, গত ১২ বছর ধরে কলেজের শিক্ষার্থীরা পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন। এজন্য তারা গড়ে তুলেছেন ‘তীর’ নামে সেই পরিবেশবাদী সংগঠনটি। এবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি শিক্ষার্থীদের এই কাজের উদ্যমকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। গতবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসে তারা জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সংগঠন হিসেবে পেয়েছে এই ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন-২০২১’ স্বর্ণপদক। ২০২২ সালের ৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে নিবেদিত সংগঠন পর্যায়ে তীরের সাবেক সভাপতি আরাফাত রহমানের হাতে এই পদক তুলে দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।
পরিবেশ আর বন্যপ্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ২০১১ সালে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে গড়ে উঠেছিল সংগঠনটি, সংক্ষেপে ক্যাম্পাসে যা পরিচিত ‘তীর’ নামে। ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হলেও এক সময় সংগঠনের কাজ আর ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সংগঠনের সদস্য শিক্ষার্থীরা আশপাশের আট জেলায় গিয়ে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন আঞ্চলিক কমিটি। পলিথিনমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আন্দোলন দিয়ে শুরু করে এখন তা বন্যপ্রাণী রক্ষা, নদী ও জলাধার রক্ষাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
বিগত ১২ বছর ধরে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সংগঠনটি বগুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ পুরো উত্তরাঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনটি বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা, সেমিনার, বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, শিকারে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি (জাল, ফাঁদ, ধনুক, গুলতি, বাটুল, এয়ারগান) উদ্ধারসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে তীর এ পর্যন্ত অন্তত ২০ প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী ও উভচর বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে। যার সংখ্যা প্রায় ২ হাজার এবং ২০০টি বন্যপ্রাণীকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করে। তাদের উদ্ধারকৃত উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে অজগর সাপ, বালুবোরা সাপ, গন্ধগোকুল, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, সুন্ধিকাছিম, ভুবন চিল, কালিম পাখি, কুড়া ঈগল, নিম পেঁচা, পাতি সরালি পাখি, পাহাড়ি ময়না, শকুন, শামুকখোল পাখি প্রভৃতি।
বগুড়া জেলার বিভিন্ন পাখি কলোনি ও জীব বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাতে—বিশেষ করে যমুনা নদী-সংলগ্ন সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার চরাঞ্চল, শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার পাখি কলোনি, শেরপুর উপজেলার রামনগর পাখি কলোনি, শাজাহানপুর পাখি কলোনি, কাহালু পাখি কলোনি, ধুনট উপজেলার বিলচাপড়ি পাখি কলোনিতে শিকার রোধে প্রচার-প্রচারণা, বিলবোর্ড স্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
যে ক্যাম্পাস নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে শিক্ষার্থীরা, সেই সরকারি আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাসকে প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। তাদের এ ঘোষণার ফলে এখন দিনরাত কলেজ ক্যাম্পাস যেমন মুখর পাখির কলতানে, তেমনি সেখানে বিচরণ করে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। কলেজ চত্বরের শিক্ষার্থীরা জানান, তারা প্রতিনিয়ত সেখানে অন্তত ৭৫ প্রজাতির পাখির বিচরণ দেখেন। এর মধ্যে রয়েছে শামুকখোল, শঙ্খচিল, স্বর্গীয় দুধরাজ, বসন্তবৌরি, মৌটুসী, ভুবনচিল, ফিঙে, শালিক, বক, জলময়ূর, মুনিয়া, ঘুঘ ও কাঠঠোকরা। এ ছাড়া বন্যপ্রাণীর মধ্যে কাঠবিড়ালী, বেজি, শেয়াল, গুইসাপ, ঢোড়া সাপের নিয়মিতই দেখা মেলে এ ক্যাম্পাসে। তারা যে শুধু বন্যপ্রাণীই দেখভাল করেন, তা নয়। প্রকৃতিকে বাঁচাতে তারা সবুজায়নের দিকেও দিয়েছেন নজর। এ পর্যন্ত ‘তীর’র সদস্যরা প্রায় ৫ হাজার গাছ লাগিয়েছেন ওই ক্যাম্পাসে, যার মধ্যে ২ হাজার গাছ টিকে আছে এখনো। ক্যাম্পাসে তাদের লাগানো গাছের মধ্যে টিকে আছে কাঁঠালচাঁপা, তাল, চাপালিশ, কৃষ্ণ ও রাধাচূড়া, জলপাই, আমলকী, পাকুড়, বট, জামরুল. পলাশ ও শিমুল।
তীরের সভাপতি রাকিবুল হাসান জানান, ‘নিজেদের অর্থে ও উদ্যোগে তারা কাজ করছেন। এ পর্যন্ত বগুড়া ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আঞ্চলিক কমিটি গঠন করে সেসব এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার কাজ চলছে।’ সাধারণ সম্পাদক রিফাত হাসান বলেন, ‘সংগঠনের ২১ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ছাড়াও ১৫০ জন নিয়মিত সদস্য এবং তিন শতাধিক সহযোগী সদস্য আছেন। এর আগে কাজের জন্য রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের স্বীকৃতি সনদও পেয়েছে তীর। আর এবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি স্বর্ণপদক জয়ে এ কাজে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা খুবই উচ্ছ্বসিত। এ স্বীকৃতি সব শিক্ষার্থীকে প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উৎসাহ জোগাবে।’
সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শাজাহান আলী জানান, শিক্ষার্থীদের প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করতে ক্যাম্পাসভিত্তিক এ সংগঠনটি যথেষ্ট উদ্যোগী। এ কারণে তারা কলেজ ক্যাম্পাসকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে বললে সেই দাবির সঙ্গে কলেজ প্রশাসন একাত্ম হয়ে সেটি করেছে। তারা কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে বাইরের জেলাতেও একই আদলে সংগঠন গড়ে তুলে প্রকৃতি, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছে। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এমন একটি সংগঠন গড়ে উঠে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিস্বরূপ স্বর্ণপদক পাওয়া গর্বের বিষয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
২৩ অক্টোবর, ২০২৩