ড. কামরুল হাসান মামুন / অবন্তিকার আত্মহত্যা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ
অবন্তিকা ও মীমের ঘটনার পরে তো বুঝতে পারছেন শিক্ষক নিয়োগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকের গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে বলেই সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের নানা স্তর থাকে- যার প্রতিটি স্তরেই ফিল্টারিং হয়। সেই সর্বস্তরের কোথাও ভিসি বা প্রোভিসি থাকে না। কেবল থাকে যেই বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হবে সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্র।  একাধিক স্তরের কোনো একটিতে বিভাগের সব শিক্ষক এমনকি ছাত্রদের মতামতও নেওয়া হয়। প্রার্থীদের কাছ থেকে টিচিং ও রিসার্চ স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়, ৩ জন গুণী স্কলারের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার চাওয়া হয়। প্রার্থীদের দিয়ে সেমিনার দেওয়ানো হয়।  কেবল মাত্র একটি মৌখিক পরীক্ষা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়। ১৫/২০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ-ই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র প্রক্রিয়া হতে পারে না। তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের সব প্রভাষক নিয়োগ থেকে শুরু করে অধ্যাপক নিয়োগ বা প্রমোশন হয় ভিসি কিংবা প্রো-ভিসির নেতৃত্বে। যেই নিয়োগ বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি থাকেন সেই নিয়োগ বোর্ডের অন্য সদস্যদের মতামত দেওয়ার কতটা সুযোগ থাকে? আসলে ভিসিরা আগেই একটা হোম ওয়ার্ক করে ফেলেন।  ইন্টারভিউ কেবল সেই হোম ওয়ার্কের ফলাফলকে জায়েজ করার একটা প্রক্রিয়া। এক স্তরের এফেক্টিভলি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়োগ প্রক্রিয়া হওয়ার কারণেই সরকার বুঝে গেছে ভিসি এবং প্রোভিসি নিয়োগটা দলান্ধ কাউকে দিলেই পুরো নিয়োগটাই দলীয়করণ সম্ভব। দলীয়করণ হলে এমন হয় যে নির্যাতক যদি ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক হয় তাহলে তাকে যেভাবেই হউক রক্ষার চেষ্টা হয় আর বিরোধীদলের কেউ হলে যত দ্রুত সম্ভব তার বিচার না শুধু বরং পারলে ফাঁসিয়ে দেওয়ার  চেষ্টা হয়।  বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সত্যিকারের শিক্ষক পাব কীভাবে? ১০০ বছর আগে শিক্ষক নিয়োগের যেই প্রক্রিয়া ছিল আজও সেই প্রক্রিয়া চালু আছে। ইন ফ্যাক্ট, পুরোপুরি সেই প্রক্রিয়া না। বরং সেই ১০০ বছর আগে যেই ভালো নিয়মগুলো ছিল যেমন অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশনের সময় সব প্রার্থীর সব কাগজপত্র একজন বিদেশি বিখ্যাত স্কলারের কাছে পাঠানো হতো। সেটা এখন আর নাই। তখন অরাজনৈতিক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিখ্যাত কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। সেই সময় উপাচার্যের অনেক ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা তারা ধারণও করতে পারত এবং তা যথাযথ ডিসচার্জও করতে পারত। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আশুতোষ মুখার্জি। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারীর মতো। যখন যাকে যোগ্য মনে করতেন তাকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতেন।  কিন্তু কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি তিনি। প্রতিষ্ঠানের ভালোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এখন আমরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই মানের শিক্ষকদের ভিসির দায়িত্ব দেই তাদের অনেকেরই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাই নাই let alone ভিসি। ফলে ভিসিদের ওপর সব ক্ষমতা প্রদান প্রচণ্ড রিস্কি। যার প্রমাণ আজকের বিশ্ববিদ্যালয়।  বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিয়োগ একটা বিরাট ব্যাপার। আমরা এইটাকে খেও বানিয়ে ফেলেছি। শিক্ষক নিয়োগ এখন মাফিয়া তন্ত্রের হাতে বন্দি। প্রতিটা বিভাগে মাফিয়াদের প্রতিনিধি আছে। ছাত্ররাও জানে সেই প্রতিনিধি কে। তারা তার সঙ্গেই থিসিস করতে চায়, তার সঙ্গেই সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সে যাকে অপছন্দ করে ছাত্ররাও সেই শিক্ষকের ধারেকাছেও যায় না। তাহলে আমরা কী আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি? সমাজের কোন পক্ষ কী এইসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলে? ছাত্ররা কী প্রতিবাদ করে? একজন সত্যিকারের শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে আমাদের কি ধারণা আছে? তবে একজন মিথ্যাকার শিক্ষক অনেক ছাত্রের জীবন ধ্বংস করতে পারে সেই উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক আছে। তারপরেও কেউ প্রতিবাদ করে না। বলে না যে এইভাবে চলতে পারে না, এইভাবে চলতে দিতে পারি না।   মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে। তার জন্য এমন বেতন কাঠামো ঠিক করতে হবে যে সারা দেশের বাবা-মায়েরা সন্তান শিক্ষক হবে এই স্বপ্নে বিভোর হবে। আস্তে আস্তে সন্তানরাও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হবে। স্বপ্নবান শিক্ষকরাই কেবল স্বপ্নবান ছাত্র তৈরি করতে পারে। এই লুপ ১০ বছর চললে বাংলাদেশ সৎ, আদর্শবান, আলোকিত মানুষের মাধ্যমে বদলে যাবে।  কীভাবে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানব? তার জন্য গবেষণা করে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রয়োজন নাই। ভারতের আইআইটি বা আইআইএসসি এখন টপ রেঙ্কিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পেরেছে কারণ তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় এমআইটি হার্ভার্ড অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। কীভাবে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া যায় তার পদ্ধতি এখন কোনো সিক্রেট বিষয় না। এই নিয়ম অনুসরণ করেই চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এগিয়েছে। আমাদেরও একই পথ অনুসরণ করতে হবে। (অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুনের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া) ড. কামরুল হাসান মামুন : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়   
২১ মার্চ, ২০২৪
X