ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / শিক্ষানৈতিক দীনতাই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধকতা
ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। এ শিক্ষানীতিতে জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার চেয়েও, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উন্নয়নকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ শিক্ষানীতিতে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালুর বিষয়টিকে ইংরেজি শিক্ষার উন্নয়নের নিয়ামক বলে ধরা হয়। সে অনুযায়ী ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে এ ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা ইংরেজি শিক্ষাবিদদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রণয়ন করা হয়। এই ইংরেজি শিক্ষাবিদরা হলেন মূলত ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ দেশ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদ থেকে ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত, যারা বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। তারা দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউনেসকো ও ইউনিসেফ ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তায় এ বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। অর্থাৎ নিজেদের ইংরেজি শিক্ষানীতির দীনতার সঙ্গে ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূ শক্তির চাতুর্য যুক্ত হয়ে বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে।  এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষানৈতিক দীনতাটি বুঝতে হলে, ইংরেজি শিক্ষার নির্ধারিত লক্ষ্য এবং সেসব লক্ষ্য অর্জনে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিটি উদঘাটন করতে হবে। এ পর্যায়ে আমাদের জানা দরকার ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়।  ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষক, ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষার পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সহায়ক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে বোঝায়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার উন্নয়ন, যেন একজন শিক্ষার্থী এই ইংরেজি ভাষায় অর্জিত দক্ষতাটি জ্ঞান অর্জন বা পারস্পরিক সংজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত জ্ঞান দ্বারা প্রণীত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ঈপ্সিত ইংরেজি ভাষা দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষাবিদদের মূল গবেষণার বিষয় হলো ইংরেজি ভাষার শিক্ষাদান পদ্ধতি, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নয়। যে কারণে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতিতে বিবৃত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে বিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যয়িত জাতীয় শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্থ, যার পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, তার অধিকাংশই অপচয় হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে এ ব্যর্থতার মূল কারণ হলো ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দৈন্যদশা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা বলতে বোঝায় ইংরেজি ভাষার শব্দ সংখ্যা ও ব্যাকরণে দখল, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী তার শ্রবণ, বাচন, লিখন ও পঠনগত দক্ষতাকে প্রকাশ করে থাকে। এ দক্ষতার প্রারম্ভিক, প্রাথমিক, প্রাক-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর—এ ছয়টি ধাপ রয়েছে। অথচ ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার এ ছয়টি ধাপকে বিবেচনায় না নিয়েই বর্তমান ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে। ভাষাগত দক্ষতার ধাপকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ হলো, তাদের বিজাতীয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং জাতীয় ভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অসক্ষমতা। অথচ ইংরেজি ভাষা শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষা শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য জানা অপরিহার্য। ইংরেজি ভাষা হলো মূলত বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম। তার বিপরীতে বাংলা ভাষা শুধু বৈদেশিক জ্ঞান অর্জন এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যম নয়। বরং সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম। তা ছাড়া এ ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতার প্রতীক। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষা হলো বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক। কিন্তু ইংরেজি ভাষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয়। শিক্ষানৈতিক আদর্শ অনুযায়ী বুনিয়াদি শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পাঠ্যক্রমে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা বুনিয়াদি শিক্ষার নিয়ামক নয় বিধায় এই ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। বরং ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়ে ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমে বাংলা ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তবে এ ভাষায় সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম হিসেবে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা যেহেতু সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর বাঙালি সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম নয়, শিক্ষাক্রমে এ ভাষায় পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ইংরেজি শিক্ষাক্রম দ্বারা ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত না হলে, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বি-সামাজিকীকরণ ও বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। বস্তুত বাংলাদেশে তেমনটাই ঘটছে। যা ঘটছে তা হলো, বর্তমান প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ঈপ্সিত ভাষাগত দক্ষতা অর্জিত হচ্ছে না, তার বিপরীতে শিক্ষার্থীরা বি-বাঙালিআয়ন প্রক্রিয়ার ঝুঁকিতে নিপতিত রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ভাষাগত দক্ষতা না থাকায় শিক্ষা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং জ্ঞান অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। অধিকন্তু ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাবে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে, তা সমাজ জীবনে বাংলিশ বিস্তৃতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। ইংরেজি শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতা সঞ্জাত ওই ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন, যেখানে ইংরেজি ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি, বাংলা ভাষার পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ভিন্নতর হবে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা পাঠ্যক্রম ও ইংরেজি ভাষা পাঠ্যক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি হবে যথাক্রমে কৃতিভিত্তিক ও দক্ষতাভিত্তিক। সে হিসেবে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থী ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও, শুধু ইংরেজি ভাষা দক্ষতা পরীক্ষা পাস সাপেক্ষে একজন শিক্ষার্থী ছয় ধাপভিত্তিক ওপরের দক্ষতা সম্পন্ন ক্লাসে উত্তীর্ণের সুযোগ পাবে। এ দক্ষতাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী যে শ্রেণির শিক্ষার্থীই হোক না কেন, ইংরেজি ভাষার ক্লাসের তার অন্তর্ভুক্তি হবে ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতার ধাপ অনুযায়ী। সে হিসেবে একটি দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্তর্ভুক্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ—একজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী—এ তিনজন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীর ভাষাগত দক্ষতা যদি উচ্চমাধ্যমিক ধাপের হয়, তাহলে তারা সবাই একই ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রস্তাবিত দক্ষতাভিত্তিক এই ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় ধাপভিত্তিক পর্যায়ক্রমিক ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে, একটি জাতীয় ভাষাগত দক্ষতা পরিমাপক অভীক্ষা চালু করতে হবে। এই অভীক্ষা চালু করা হলে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্তযুক্ত করা যাবে। তা ছাড়া ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও ইংরেজি ভাষায় ভাষাগত দক্ষতাকে শর্ত যুক্ত করা যাবে। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজ ভাষা শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে, ভাষিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানীয় কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাবিদদের শিক্ষানৈতিক দীনতামুক্ত ইংরেজি ভাষা শিক্ষা উন্নয়ন সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।  ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো; জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
X