মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আপস করা হবে প্রবৃদ্ধিতে
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের মূল লক্ষ্য থাকবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বড় চ্যালেঞ্জ হবে, গত এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ থেকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। এজন্য আসন্ন বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পদক্ষেপে কিছুটা আপস করা হবে। আর মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপের মাধ্যমে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, এভাবেই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল সোমবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেট পদক্ষেপ এবং প্রাথমিক ব্যয়ের একটি খসড়া উপস্থাপন করেন। এ সময় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদষ্টো ড. মসিউর রহমান, অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ অর্থ বিভাগের বাজেট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বাজেট আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী খসড়া বাজেটের বিভিন্ন পদক্ষেপ, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ও বরাদ্দের নানা দিক অবহিত হন। উপস্থাপিত এই খসড়াকে আরও যুগোপযোগী ও কল্যাণমুখী করতে প্রধানমন্ত্রী অর্থ বিভাগকে অন্তত দশ দফা নির্দেশনা দেন। চূড়ান্ত বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনাসংবলিত সুপারিশের সবকটিই বাজেট পদক্ষেপে অন্তর্ভুক্ত করতে আজ মঙ্গলবার থেকেই কাজ শুরু করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি মাসের মধ্যেই খসড়া বাজেট চূড়ান্ত করা হবে, যা আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।
সূত্র মতে, বাজেটের খসড়া প্রস্তাব অবহিত করে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আরও জানানো হয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি বেশ বড় রকমের ছিল। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটকে সংশোধন করে ৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে হয়েছে। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ হলো বাজেটকে বাস্তবসম্মত করার। তাই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার খুব বেশি বড় করতে চায় না অর্থ বিভাগ। সেটি ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার প্রাথমিক প্রাক্কলন সম্পন্ন হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাবে এটি আরও কমতে পারে। তবে বাজেটের আকার যেটাই হোক, ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এর বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য চলতি অর্থবছর থেকে ১৫-১৬ শতাংশ বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে। এক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যয় কম হবে, পরিচালন বাজেট কমবে না। উচ্চসুদবাহী ঋণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে।
সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগ থেকে আসন্ন বাজেটের রূপরেখা জেনে প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন। তবে বাজেটে আরও বেশি কার্যকর করতে এ সময় অর্থ বিভাগের প্রতি প্রধানমন্ত্রী অন্তত ১০ দফা নির্দেশনা রেখেছেন। এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে—জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজেটে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ, সামাজিক সুরক্ষায় ভাতার বাড়াতে পারলে ভালো, তবে যতটা সম্ভব উপকারভোগীর আওতা বাড়িয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় নিয়ে আসা। এর জন্য বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ যৌক্তিক উপায়ে বাড়ানো। একটি গ্রাম একটি শহরের লক্ষ্য বাস্তবায়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান, উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি বৃদ্ধি, অন্যান্য খাতে সেটি যৌক্তিকীকরণ করা।
এ ছাড়া সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন হার বাড়াতে মনিটরিং জোরদার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়ার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ, কর না বাড়িয়ে কর আদায়ের আওতা বাড়ানো এবং নিয়মিত করদাতাদের হয়রানি বন্ধ, আমদানি-রপ্তানিতে বিশেষ নজর। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং এলক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাত এগিয়ে নিতে বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ধীরে ধীরে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট বাস্তবায়ন করা।
বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সামাজিক সুরক্ষা খাতে উপকারভোগীর আওতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কালবেলাকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আসুক দেশের সব মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের চলমান যে সামাজিক সুরক্ষামূলক ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে, তার আওতা বাড়িয়ে বাদ পড়াদের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ভাতার পরিমাণ ৫০০ না ১ হাজার সেটি বড় বিষয় নয়। সমাজে বিভিন্ন স্তরে পিছিয়ে থাকা এসব মানুষকে নিয়ে সরকার যে ভাবে, এই অন্তর্ভুক্তি তার একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান কালবেলাকে জানান, প্রতি বছর বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগে তার সম্ভাব্য রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। কারণ, বাজেটের মাধ্যমেই একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দেওয়া অঙ্গীকার ধারাবাহিকভাবে পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী দেশের সবার। সব নাগরিক যাতে ভালো থাকে, ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পায়, যেভাবে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে, বাজেটে যাতে তার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকে সেই বিষয়ে অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনাগুলোর প্রতিফলন আগামী বাজেটে থাকবে।
এ বিষয়ে মন্তব্য চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, বাজেট পদক্ষেপের সম্ভাব্য যে রূপরেখা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত। কারণ এই মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টার চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্য রাখাই ভালো। বাজেটের আকার ছোট হবে, ঘাটতি কম হবে, রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্য–এগুলো সবই ভালো দিক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলোও যুগোপযোগী। শেষ পর্যন্ত বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটলে নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ভালো বাজেট হতে পারে।
এর আগে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও সম্পদ কমিটির বৈঠক থেকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয়ের আকার প্রাক্কলন করা হয়। এতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। মোট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ, যা জিডিপি অনুপাতে গত এক দশকে এটিই হবে সবচেয়ে ছোট বাজেট। এ ছাড়া আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নামিয়ে আনা হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়।
অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ ধরা হচ্ছে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে লক্ষ্য ধরা হয় ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। তবে উচ্চসুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কারণে সংশোধিত বাজেটে সেটি ১ লাখ ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। তবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধে ব্যয় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি প্রাথমিকভাবে জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছিল। তবে সংশোধিত বাজেট ৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণে ঘাটতি কমে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে।
১৪ মে, ২০২৪