মো. মশিউর রহমান
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৪, ০৪:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

মূল্যস্ফীতি কি?

অর্থনীতিবিদরা আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি দিয়ে যেটা বোঝা যায় তা হলো, কোন একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে? যেমন ধরুন একটা জিনিসের দাম ২০২৩ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। এভাবে বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।''। কয়েকভাবে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই মূল্য কী ছিল আর এই বছরের ১৫ জুলাই কী মূল্য আছে - এই দুইয়ের শতকরা ব্যবধান। আরেকটি হচ্ছে, এক বছরে জিনিসপত্রের গড় মূল্য আর পরের বছরের ১২ মাসে গড় মূল্যের তুলনা করেও মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।

মূল্যস্ফীতির কারণ:

মূল্যস্ফীতির কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল-

• বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে আমদানি বেশি করতে হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে এখানেও দাম বাড়বে।

• আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আগের মতো থাকলেও কোন কারণে ডলার যদি অবমূল্যায়িত হয়, তাহলেও দেশে মূল্যস্ফীতি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এটাও একটা কারণ।

• আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে স্থানীয় বাজারেও পরিবহণ খরচ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে সেটার কারণে দেশে উৎপাদিত পণ্যর দাম বাড়ে। আবার যখন একটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্যেরও দাম বাড়তে শুরু করে। যেমন তেলের দাম বাড়লে পরিবহণ খরচ বাড়ে, কাঁচামালের দাম বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে।

• কোন পণ্যের চাহিদা বেশি থাকার পরেও প্রাকৃতিক বা অন্য কোন কারণে যোগান কমে গেলে মূল্য বাড়তে পারে।

• দেশে অতিরিক্ত টাকার যোগান তৈরি হলেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তখন মানুষ বেশি টাকা দিয়ে হলেও পণ্য কিনতে শুরু করে।

• অনেক সময় বাজারে কারসাজির মাধ্যমে পণ্য বা সেবার দাম বেড়ে যায়- একে আমরা সিন্ডিকেটের মূল্যস্ফীতি বলতে পারি । উল্লেখ্য সিন্ডিকেটের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক কৌশল কাজে আসে না।

বাংলাদেশে যেভাবে সিন্ডিকেট করে বাজারে কারসাজি করা হয়:

বিবিসি বাংলা ১২ আগস্ট ২০২৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় যার কিছু অংশ নিম্নরূপ –

“এখানে বড়রা সব একজোট। আমরা ছোটোরা এমনকি এই বড়দের কাছ থেকেও আমরা নিজেদের ইচ্ছে মতো পণ্য নিতে পারি না। বরং তারাই আমাদের ঠিক করে দেয় কোন পণ্য আমরা কার কাছ থেকে কত দরে কিনবো। এভাবেই কয়েকজন মিলে সব করায়ত্ত করেছে,” - বলছিলেন চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী।

আমদানির প্রতিটি ধাপ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট:

বাংলাদেশে চিনি, ডাল, তেলসহ সতেরটি পণ্যকে নিত্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব মূল পণ্যগুলো আলাদা করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলোর মার্কেট শেয়ার বড় কয়েকজন আমদানিকারকদের হাতে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে একটি চক্র জরুরি নিত্যপণ্য আমদানি করা থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি ‘ভয়াবহ চিত্র’ পাওয়া গেছে। “বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করছে বলেই আমরা ছোটোরা রেস থেকে ছিটকে গেছি। তাদের অবাধ্য হয়ে কোনো ব্যবসাই আমরা এখানে করতে পারবো না।" বলছিলেন একজন ব্যবসায়ী।

“এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায় না,” - বলেন তিনি।

এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী যে ধারণা দিয়েছেন তা হলো - বড় ভলিউমে পণ্য আমদানি করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে। এখন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ওই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে নিজের ইচ্ছে মতো পণ্য কিনতে পারেন না।

উদাহরণ স্বরূপ - একজন উদ্যোক্তা ভাবলেন, তিনি একশ কোটি টাকার চিনি বা লবণ কিনবেন। সেজন্য বড় ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারাই ঠিক করে দেন যে কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে।

এতে রাজী না হয়ে উদ্যোক্তাটি যদি মনে করেন তিনি ব্রাজিল থেকে একশ কোটি টাকার চিনি আনবেন, সে অনুযায়ী তিনি আমদানি করলেও - বড় গোষ্ঠীরা "তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে চিনি ছেড়ে" তাকে লোকসানের মুখে ফেলে দেবে।

আবার বড় চক্রের বাইরে থেকে কেউ আমদানি করতে এলসি খুলতে চাইলেও ব্যাংক রাজী হবেনা। এমনকি বাধা আসবে কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দফতর থেকে। আর ভয়ংকর ব্যাপার হলো, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোনো পণ্য আনলে সেগুলো বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এমনকি শ্রমিক গোষ্ঠীও এসব পণ্য খালাসে কাজ করতে আগ্রহী হয়না।

ফলে অন্যদের আমদানি করা পণ্য কতদিন সাগরে বা জাহাজে পড়ে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আবার খালাস হলেও কাস্টমস ও কর বিভাগ ছাড়পত্র দেবে কিনা - তা নিয়েও সংশয় থাকে।

“এভাবে প্রতিটি পদে পদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সিন্ডিকেট। টাকা থাকলেও এদের সাথে কেউ পেরে উঠবে না। এমনকি সরকার একটু দাম নির্ধারণ করে দিলে তারা পণ্য হয়ত জাহাজেই রেখে দেবে কিছুদিন - যাতে সংকটে পড়ে সরকারই চাপ দেয় যে দাম যাই হোক, পণ্য আনুন,” বলছিলেন একজন ব্যবসায়ী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কথিত সিন্ডিকেট বলতে যাদের বোঝানো হয় তারা একদিকে যেমন বড় আমদানিকারক, আবার নানা ভাবে ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বেও আছেন তারাই।

আবার সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে খালাসের জন্য ব্যবহৃত লাইটার জাহাজগুলোও তাদের কিংবা তাদের সহযোগীদের। ফলে শ্রমিকরাও মালিকদের বাইরে গিয়ে অন্য কারও জন্য কাজ করতে পারেন না বিপদে পড়ার ভয়ে।

সব কিছুই এই সিন্ডিকেটের হওয়ায় সরকারের রাজস্ব বিভাগের লোকজনও থাকেন চাপের মুখে। “আপনার যত টাকা থাকুক, এদের বাইরে গিয়ে কেউ পণ্য আনার জন্য কোনো ব্যাংকে এলসি খুলতে পারবেন না। কারণ ব্যাংকও তাদের। হাই কানেক্টেড (উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ) না হলে ব্যাংক কারও এলসি খুলবে না,” বলছিলেন ওই ব্যবসায়ী।

আবার কথিত সিন্ডিকেট কোন পণ্য এনে যাদের মাধ্যমে বাজারজাত করবে - সেসব প্রতিষ্ঠানও নামে-বেনামে তাদের পরিবারের লোকজনেরই। এমনকি বড় বড় বাজারগুলোর জন্য এসব পণ্যের ডিলারশিপও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতে।

মজুতদারি ও সিন্ডিকেট নিয়ে আইনে যা আছে:

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে এ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ২(ঙ) ধারায় মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মজুদদারি বলতে বোঝায়, কোনও আইন দ্বারা বা আইনের আওতায় কোনও ব্যক্তি মজুদ বা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করা।’

এ আইনের ২৫ (১) ধারার বিধানে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুদদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আজীবন কারাদণ্ড বা চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুদদার কোনও লাভের জন্য পণ্য মজুদ করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।’

পরিশেষে বলতে হয়, সিন্ডিকেটকেও মজুতদারির মত ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে আইনের মাধ্যমে ঘোষণা করা একান্ত প্রয়োজন, একইসাথে মনিটরিং বৃদ্ধির মাধ্যমে আইনের পূর্ণ প্রয়োগ প্রয়োজন। মনিটরিং এর জন্য আধুনিক ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া ব্যবসায়ীদের বর্তমান স্টক, আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলার তারিখ ও বর্তমান অবস্থান বিষয় স্পষ্ট ও ডিজিটাল রিপোর্ট প্রয়োজন।

অন্যদিকে স্থানীয়দের স্টক ব্যবস্থাপনা ও নগদ (ক্যাশ ও ব্যাংক) টাকার পরিমাণ ও কোথায় অবস্থিতি তার উপর ডিজিটাল রিপোর্ট একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনে স্থানীয় প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় ভালো মানের সফটওয়্যার তৈরি ও সেখানে সবার নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এলসির ক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যারে তথ্যের সঠিক ইনপুট বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এভাবে একটি দক্ষ ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। অন্যদিকে সামাজিক নেতাদের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া প্রয়োজন এবং মজুতদারি ও সিন্ডিকেটের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন।

মো. মশিউর রহমান: ব্যাংকার

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হত্যার আশঙ্কায় চেয়ারম্যান প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলন

রাইসির হেলিকপ্টারের যে সমস্যার কথা জানালেন তুর্কি পরিবহনমন্ত্রী

সমর্থকের বাড়িতে নৈশভোজ, চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অর্থদণ্ড

ভোটের আগের রাতে গোপন প্রচারণা, দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রাইভেটকার আটক

বিলাসবহুল গাড়িতে সরকারি লোগো সাঁটিয়ে ৭ লাখ ইয়াবা পাচার

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

বাবার খোঁজে ভারতে যাচ্ছেন এমপি আনারের মেয়ে

ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়া ৯ তরুণকে ছাত্রলীগের শুভেচ্ছা

মোবাইল কিনে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাজার বসিয়ে অবৈধ বিদ্যুতের ব্যবসা

১০

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু, ক্যাম্প কমান্ডারসহ প্রত্যাহার ৪

১১

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৮২ শতাংশ : বিবিএস

১২

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল শিশুর

১৩

জাল স্বাক্ষরে ওষুধ বিতরণের অভিযোগ

১৪

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরবদের মুনাফেকি ও সুপার হিরোদের অবদান

১৫

নোয়াখালীতে ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ

১৬

নিপুনের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

১৭

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

১৮

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৯

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

২০
X