বলছি শোনো / শিক্ষকতা এক ধরনের শিল্প
বোর্ড, চক, চেয়ার-টেবিল, বই-খাতা—এ সবকিছুর বাইরে গিয়েও যে একজন শিক্ষার্থীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষকতা কীভাবে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে, সেটা নিয়েই কথা বলেছেন লিটারেসি কনসালট্যান্ট ও শিক্ষক ব্রায়ান জনসন। অনুলিখন: সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি
অনেক বছর শিক্ষকতার সঙ্গে থাকার পর অবশেষে ‘লিটারেসি কনসালট্যান্ট’ হিসেবে নিউইয়র্কের এক স্থানীয় ছোট্ট বিদ্যালয়ে পাঠানো হলো আমাকে। প্রথমদিন স্কুলে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি। যতটা না প্রযুক্তির অভাব দেখে অবাক হলাম, তারচেয়ে বেশি অবাক হলাম মানুষের অভাব দেখে। নিজের মনেই বিড়বিড় করলাম, শিক্ষার্থীরা সব কোথায়? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটা মাথায় এলো আমার যে, স্কুলের শিক্ষকরাই বা কোথায়?
একটু পরই পেছন থেকে ডাক এলো। আমার পরিচয় জেনে বলল, চলুন, আপনাকে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে যাই। প্রিন্সিপালের কাছে? প্রিন্সিপালের অফিসে না? অনেক গলি-ঘুপচি পেরিয়ে প্রিন্সিপালের সামনে যাওয়ার পর বুঝলাম, শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের কোনো ফোন কল যেন ধরতে না হয় সেজন্য প্রিন্সিপাল নিজেই স্কুল থেকে দূরে ঘাঁটি গেড়েছেন।
কয়েক সপ্তাহ ছিলাম আমি ওখানে। আর এ অল্প সময়েই বুঝে গিয়েছিলাম যে ,এর চেয়ে নীরসভাবে পড়ানো সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীরা শুধু যে পড়াশোনার দিক দিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছিল তা নয়, পেছাচ্ছিল সামাজিক দিক দিয়েও। আর এটা শুধু ওই একটা স্কুলে নয়, আমাদের প্রায় প্রতিটি স্কুলেরই বাস্তব চিত্র।
দেশে আর দেশের বাইরে কর্মসূত্রে বহু শিক্ষক ও নেতৃত্বের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। আর সেখান থেকে আমি এই পুরো শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে, শিক্ষার্থীদের সামাজিক-মানসিক উন্নয়নে তিনটি পদ্ধতির ব্যাপারে চিন্তা করেছি।
যার প্রথমটি হলো, শিক্ষার্থীদের প্রতি ইতিবাচক থাকা। তাদের নিজেদের নিজস্বতাকে গ্রহণ করতে সাহায্য করা। ছোটবেলায় আমার প্রয়োজন ছিল এ ইতিবাচক মনোভাবের। আর সেটা আমি পেয়েছিলাম আমার থার্ড গ্রেডে, মিসেস ফিলকারের কাছ থেকে। আমার মতো তিনিও কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন। একবার মিসেস ফিলকার আমাদের সবাইকে নিজেদের ছবি আঁকতে বললেন। আমি আঁকলাম। উনি বললেন, ছবিটা তো সম্পূর্ণ হয়নি।
আমি নিজের দুটি কান, দুটি চোখ, একটি নাক, একটি মুখ—সবকিছু হাত দিয়ে গুনলাম আবার। নাহ! সব তো ঠিকই দিয়েছি। মিসেস ফিলকার বললেন, কিন্তু তুমি তো তোমার গায়ের রং দাওনি। ছোট্ট আমি অনেক কান্না করেছিলাম সেদিন। এর আগ পর্যন্ত আমি শুধু আমার চারপাশে সাদা চামড়ার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, নিজের সত্তাটাকে আগলেই ধরিনি কখনো। বরং হীনমন্যতায় ভুগেছি। মিসেস ফিলকার আমাকে আমার কাছে নতুন করে তুলে ধরেছিলেন। আর এই যে ইতিবাচক মনোভাবটা, এটা দরকার আছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব শিক্ষার্থীকে নিজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সত্তাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে শেখানো হয়েছে, তাদের শিক্ষাগত উন্নয়নটাও ভালো হয়েছে। কত ভালো একটা ব্যাপার হবে তাই না; যদি প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী নিজেদের যে অংশগুলো নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে, সেগুলো ঝেড়ে ফেলে দিতে পারত?
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের মতো করে ক্লাসরুম কালচার বা সংস্কৃতি গড়ে তোলা। একটা শ্রেণিকক্ষ কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা শিক্ষার্থীদেরই ঠিক করা উচিত। এমন একটা সময় এসেছিল যে, আমি গণিতের ক্লাস নিচ্ছি, অথচ শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড দৌড়াদৌড়ি করছে। যেন আমি গণিত নয়, জিম ক্লাসের শিক্ষক। ওদের আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী চাও। ক্লাসে ঠিক কী করতে চাও। ওরা কথা বলার জন্য, নিজের মতো গণিত নিয়ে কাটানোর জন্য বাড়তি সময় চাইল, আর সঙ্গে নাশতাও চেয়ে নিল। নাশতা আমি দিতে পারিনি ওদের, তবে সময় দিতে পেরেছি। খুব দ্রুতই আমার গণিতের ক্লাসটা ঠিক গণিত ক্লাসরুমেই পরিণত হলো!
তৃতীয় ও সর্বশেষ পদ্ধতিটি হলো, শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষে ‘ফিজিক্যাল এনভারমেন্ট’ বা আক্ষরিক একটা আনন্দের জগৎ বানানো। সেখানে থাকতে পারে শিক্ষার্থীদের ছবি, তাদের পরিচিত মানুষ বা সংস্কৃতির ছবি। স্কুল মানেই বাঁধাধরা ক্লাস আর টেবিল চেয়ার নয়। আমি আমার ক্লাসটাকে আমার পছন্দের মতো করে বানিয়ে নিয়েছিলাম। যার মূল থিম ছিল—নাচ। সেখানে গান বাজত, শিক্ষার্থীরা গান শুনতে চাইতে পারত। ওরা নাচত। কারও কাজ শেষ হওয়া মানেই সে নাচতে চলে যেতে পারছে। যেন অ্যাসাইনমেন্টটাই আনন্দ করার একটা টিকিট।
আমার মতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত শিক্ষার্থীকে সামাজিক ও একাডেমিক—দুটি ব্যাপারেই গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকতা শিল্পের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ধরণ; যেটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, বিশেষ করে প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব।
২৮ এপ্রিল, ২০২৪