পলিথিন নয়, মানুষের হাতে থাকবে সোনালি ব্যাগ : বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী 
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, সোনালি ব্যাগের জন্য প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরা বড় বাধা হলেও আমরা জয়ী হব। পলিথিন নয়, মানুষের হাতে থাকবে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ। এ জন্য দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। জুলাইয়ে ১০০ কোটি টাকা অর্থ ছাড় হলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এজন্য বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। বুধবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস প্রাঙ্গণে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মোবারক  আহমদ খান উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ উৎপাদন কারখানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় বিজ্ঞানী ড. মোবারক  আহমদ খান ছাড়াও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ, বিজেএমসির চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মদ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে প্লাস্টিক বা পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি বিপদসংকুল পরিবেশে পতিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খানকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন। প্লাস্টিক বা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আমরা পাট থেকে প্রস্তুত করা এই সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করব। ড. মোবারক আহমদ খানের এই সোনালি ব্যাগ প্রকল্প কোন পর্যায়ে আছে আমরা তা সচক্ষে আজকে দেখতে এসেছি। আমি মনে করি, বাঙালি জাতি অনেক সৃষ্টিশীল। আমরা এই জায়গায় অনেক এগিয়ে যাব। ড. মোবারক একজন কেমিস্ট হয়েও নিজেই কাস্টমাইজ করে মেশিনারিজ তৈরি করায় মন্ত্রী তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। মন্ত্রী বলেন,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রয়োজনীয় পুঁজিসহ একটি প্রকল্প দিয়েছেন। প্রায় ১০০ কোটি টাকার। এ ব্যাপারে যতরকম সহযোগিতা দরকার আমরা করব। আমরা সামনে পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করব তার আগে জনসাধারণের হাতে বিকল্প তুলে দিতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগকে উৎপাদনে এনে ব্যাপকভাবে মানুষের হাতে তুলে দিতে। ঈদের পরে কোনো পাটকল চালু হচ্ছে কিনা- সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ঠিক ঈদের পরেই চালু হবে এমনটা নয়, তবে মিলগুলো তৈরি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে চালু হবে আশা করি। এ সময় বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান বলেন, সোনালি ব্যাগ এমন একটা পণ্য যাতে প্লাস্টিক নাই। আপনারা জানেন, বায়োডিগ্রেডিবল যে প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া যায় সেগুলো গত বছরের ২৮ মে প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কানাডাতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেননা সেগুলো শতভাগ পরিবেশবান্ধব নয়। আমাদের এই সোনালি ব্যাগ বায়ো-ডিগ্রেডেবল এবং শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এটি কার্বন নেগেটিভ পণ্য। পানিতে গলে যাবে কিনা- এ রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ভোক্তার চাহিদা অনুয়ায়ী এটা বানাতে পারি। যেমন শপিং ব্যাগ ৮ ঘণ্টায় পানিতে মিশে যায়। এটাকে ৬ মাস মেয়াদি করতে পারি। ড. মোবারক জানান, এখন প্রতিদিন ২৫০ কেজি পরিমাণ উৎপাদন করছি। আমাদের যে সক্ষমতা আছে তাতে আমরা এখনই  ১ টন উৎপাদন করতে পারব। ১ কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। সোনালি ব্যাগ মানুষ গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, কারণ ভালো যে কোনো কিছু মানুষ গ্রহণ করে। আপনারা দেখবেন এখন একজন রিকশাওয়ালাও মোবাইল ব্যবহার করে, কিনে মিনারেল ওয়াটার খায়। মানুষের সচেতনতা যখন বাড়বে, মানুষ যখন ভালো বোধ করবে তখন প্লাস্টিকের বাধা অতিক্রম করা যাবে। তবে অন্যান্য দেশের মতো প্লাস্টিক ও পলিথিন নিষিদ্ধ করে সরকারকে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
০৩ এপ্রিল, ২০২৪

বিশেষ সাক্ষাৎকারে ড. মোবারক আহমেদ খান / পরিবেশকে বদলে দেবে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ
ড. মোবারক আহমদ খান; বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। তিনি পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও সম্ভাবনা সৃষ্টির লক্ষ্যে নব্বইয়ের দশক থেকে গবেষণা করছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত। তার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার—পাট থেকে উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ, জুটিন নামক ঢেউটিন, হেলমেট ও টাইলস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য এ বছর তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনা, বাণিজ্যিক উৎপাদনসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদুল ইসলাম- কালবেলা: আপনি স্বাধীনতা পদক-২০২৪ অর্জন করেছেন। আপনার অনুভূতি আমাদের বলবেন? ড. মোবারক আহমেদ: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি এটা যখন প্রথম জানতে পারলাম, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না। সংবাদটি শোনার পর আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম একটি ভালো কিছু আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। এত বড় সম্মাননা পাওয়ার বিষয়টি আমি যখন আমার স্ত্রীর সঙ্গে শেয়ার করছিলাম তখন আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। আমার কাজের স্বীকৃতি পেলাম, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। কালবেলা: পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ। এটা একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। সোনালি ব্যাগ কতটা পরিবেশবান্ধব? ড. মোবারক আহমেদ: পাট থেকে তৈরি সোনালি ব্যাগ ১০০ শতাংশই পরিবেশবান্ধব। এটা পানিতে গলে যায়। এটা পচে যায় এবং মাটিতে মিশে যায়। শুধু মাটিতে মিশে যায় তাই নয়, বরং এটা মাটিতে মিশে গাছের জন্য খাবার তৈরি হয়। এটা পানিতে গলে মাছের খাবার তৈরি হয়। এটি সম্পূর্ণভাবেই পরিবেশবান্ধব, এমনকি কোনো মানুষ এটি খেয়ে ফেললেও কোনো ক্ষতি নেই। আমরা প্রতিনিয়ত যে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি এর মধ্যে যে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক রয়েছে তার সঠিক বিকল্প হলো সোনালি ব্যাগ। পলিথিনের জায়গায় যখন সোনালি ব্যাগ ব্যবহৃত হবে তখন আবর্জনা যেমন কমবে, একই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কালবেলা: পাট পলিথিনের বিকল্প হতে পারে—এ চিন্তাটা আপনি কীভাবে পেলেন? ড. মোবারক আহমেদ: আমরা প্রথমে প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজতে চেয়েছিলাম। আমরা ভাতের মাড়, আটা, ভুট্টাসহ বিভিন্ন কিছু দিয়ে বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের মতো ব্যবহার্য পদার্থ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। এ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছি। ভুট্টার উপাদান দিয়ে তৈরি বায়ো-ডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক এখন বাজারে পাওয়া যায়। একটা পর্যায়ে আমাদের মনে হলো, খাবার জিনিস দিয়ে যে প্লাস্টিক তৈরি করছি সেটা সম্পূর্ণরূপে প্লাস্টিক ফ্রি হচ্ছে না। কারণ এর মধ্যে প্লাস্টিক মেশানোর প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া খাবার জিনিস ব্যবহারের বিকল্প কিছু পাওয়া যায় কি না, সেটাও আমাদের চিন্তায় আসে। তখন আমরা ভাবি যেহেতু পাট আমাদের দেশে অ্যাভেইলেবল রয়েছে সুতরাং এখানে পাটকে কাজে লাগাতে পারলে সেটা অনেক সহজ হবে। এখানে খুব ভালো একটি কেমিস্ট্রি রয়েছে।  পাটের সেলুলোজ এবং ভুট্টার জেস্টার এর কেমিক্যাল স্ট্রাকচার প্রায় একই রকম। এই জায়গাটা থেকে আমরা পাটকে এক ধরনের মোডিফিকেশন এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে এসেছি। এবং আমরা দেখলাম এটা পলিমারাইজড হচ্ছে। ফাইনালি আমরা সফল হলাম। অর্থাৎ সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটকে ব্যবহার করা যাবে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে আমরা যখন এই ফর্মুলাটা বের করতে পারি তখন তা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। বর্তমানে পাট থেকে সোনালী ব্যাগ তৈরির যে ফর্মুলা সেটা প্রথম পর্যায় থেকে অনেক অনেক মোডিফায়েড।  কালবেলা: ২০১৫ সালে সোনালি ব্যাগ আবিষ্কারের ঘোষণা আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশ-বিদেশে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়। আমরা ভেবেছিলাম এটা খুব শিগগিরই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছবে। কিন্তু এমনটা ঘটেনি কেন? ড. মোবারক আহমেদ: একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার হয় ল্যাবরেটরিতে। এরপর সেটা পাইলট স্কেল প্রোডাকশনে যায়। তারপর হয় প্রাক-বাণিজ্যিকীকরণ। সবশেষ আসে বাণিজ্যিকীকরণ। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পাট থেকে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের বিকল্প অর্থাৎ সোনালি ব্যাগ তৈরির ফর্মুলাটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা এবং এটি তৈরি করতে যে মেশিনারিজ প্রয়োজন সেটা কোথাও নেই। কারণ এ মেশিনারিজ পৃথিবীতে আগে কেউ তৈরি করে রাখেনি। যে মেশিন দিয়ে প্লাস্টিক তৈরি করা হয় সেই মেশিন এখানে কার্যকর নয়। সোনালি ব্যাগ তৈরির জন্য যে মেশিন এবং যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা সম্পূর্ণভাবে আমাদেরই তৈরি করতে হয়েছে। আমাদের এ মেশিনারিজ বা পদ্ধতি খুঁজতে হয়েছে। খুঁজে না পেয়ে স্থানীয়ভাবে আমাদের নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে আমাদের গ্রুপের অর্থাৎ আমার কলিগরা সবাই মিলে এ নতুন মেশিন ডেভেলপ করেছি। এর মাঝে দুই থেকে আড়াই বছর করোনাকালীন সময় চলে গেছে। সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিক পরিসরে তৈরির প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০২১-২২ সালে। গত তিন-চার বছরে আমরা যে পর্যন্ত এসেছি তাতে দৈনিক এক টন প্রোডাকশনের ক্যাপাবিলিটি তৈরি হয়েছে আমাদের। সুতরাং আমি মনে করি না আমরা খুব বেশি পিছিয়ে রয়েছি। যখন আমরা পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প তৈরির ঘোষণা করেছিলাম, তখন দেশ এবং বিদেশে খুব দ্রুত এটা আগ্রহ তৈরি করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কারিগরি দিক থেকে ঠিক ততটা দ্রুত এগিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা ছিল এবং এখনো রয়েছে। নতুন ধরনের মেশিন তৈরি করা আমাদের জন্য সময়সাপেক্ষ ছিল এবং এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল, মানুষের মধ্যে অ্যাওয়ারনেনের অভাবও রয়েছে। পলিথিনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ ব্যবহার কেন করতে হবে সেই সচেতনতা তৈরির ঘাটতি রয়েছে। এ প্রজেক্টে অর্থায়নের সংকট ছিল। সব মিলিয়ে সোনালি ব্যাগ বাজারে আসতে সময় লাগছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এখন সোনালি ব্যাগ প্রজেক্টে প্রাক-বাণিজ্যিকীকরণের জন্য অর্থায়ন করছেন। এ অর্থায়নের পর আমরা এ প্রজেক্টকে আরও দ্রুততার সঙ্গে সামনে এগিয়ে নিতে পারব বলে মনে করি। কালবেলা: বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সোনালী ব্যাগের মতো একটি প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসছেন না কেন?  ড. মোবারক আহমেদ: সোনালী ব্যাগ এখন অটোমেটিক মেশিনে তৈরি হচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব ছিল ল্যাবরেটরীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এটা প্রোডাকশন স্টেজে পৌঁছে দেওয়া এবং আমরা সেটা করেছি। আমরা নিজেরাই মেশিনপত্র তৈরি করে প্রোডাকশনে গিয়েছি কিন্তু তবুও এই জায়গাটায় আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আমরা এখনো কনফিডেন্স গ্রো করাতে পারিনি। পলিথিনের বিকল্প এই প্রজেক্টে তারা নতুন করে ইনভেস্ট করতে সাহস করে উঠতে পারেননি। সোনালী ব্যাগ প্রোডাক্ট নিয়ে কারো কোন আপত্তি নেই। এটা ভালো নাকি মন্দ সেটা নিয়েও কারো কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে নতুন করে ইনভেস্ট করতে এবং নতুন মার্কেট খোঁজা এই জায়গাটায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের সংকোচ ছিল।  আমি মনে করি না সোনালী ব্যাগ প্রোডাক্ট অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই আবিষ্কারের সংবাদটি যত দ্রুত সাড়া ফেলেছিল আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। তবে সারা বিশ্বব্যাপী এখন এটি পেটেন্ট হয়েছে। আমরা যদি খুব দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারি তাহলে এটি খুব দ্রুত মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে। এমনকি আমরা যদি মিলিয়ন টনও উৎপাদন করি তবুও সারা বিশ্ব এটি কিনে নেবে। আমরা অনেক বেশি পিছিয়ে আছি বলে মনে করি না। তবে আমাদের ম্যানেজমেন্ট এর কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং অর্থায়নের সংকট রয়েছে। এই সংকট গুলো অতিক্রম করে আমরা এগোচ্ছি।  কালবেলা: সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ ছয় বছরেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি। এমনটা কেন হল? ড. মোবারক আহমেদ: যদি সকল ম্যানেজমেন্ট ঠিক থাকতো তাহলে হয়তো আমরা আরো দ্রুত সামনে এগোতে পারতাম। আমরা আমাদের ম্যানেজমেন্টের জায়গা থেকে সেটা দিতে পারিনি। এই প্রজেক্ট এবং এই পাট সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় ওউন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর সঙ্গে অন্যান্য প্রশাসনিক কাঠামো গুলোও সম্পর্কিত। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সর্ব পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকলে আমরা আরো দ্রুত এগোতে পারতাম।  কালবেলা: সোনালি ব্যাগ তৈরিতে কী ধরনের উপাদান লাগে? এর উপাদানগুলো কি সহজলভ্য নয়? ড. মোবারক আহমেদ: সোনালি ব্যাগ তৈরির মূল উপাদান পাট, যা আমাদের দেশীয় উৎপাদিত একটি কৃষিপণ্য। দুটি কেমিক্যাল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দুটিই খুবই সস্তা কেমিক্যাল। এ কেমিক্যাল পরিমাণে খুবই কম লাগে এবং এটি রিসাইকেল করা যায়। পাট থেকে আমরা যে সেলুলোজ আহরণ করি সেটাও আমাদের নিজস্ব মেথডে। সুতরাং যে উপাদানগুলোর প্রয়োজন হয় তার প্রায় সবই আমাদের লোকাল এবং উপাদানগুলো খুবই সহজলভ্য। কালবেলা: সোনালি ব্যাগের বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি? আমরা কবে নাগাদ সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণ দেখতে পাব? ড. মোবারক আহমেদ: একটু বড় পরিসরে একটি কমার্শিয়াল প্লান্ট তৈরি করার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল ৪৫০ কোটি টাকা। তবে সরকার প্রথমেই কমার্শিয়াল প্লান্টের কথা চিন্তা না করে প্রাক-বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য আমরা প্রথমে মিডিয়াম পরিসরের একটি প্লান্ট তৈরির কথা চিন্তা করছি। পর্যাপ্ত অর্থায়ন হলে বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে কোনো বাধা নেই। সোনালি ব্যাগ প্রজেক্টে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এডিবির প্রজেক্টের মাধ্যমে এ অর্থায়ন করা হবে। এই অর্থ যদি ছাড় হয় তাহলে আমরা টাকাটি হাতে পাব। এই টাকা পেলে আমরা পাঁচ থেকে দশ টন উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করব। সরকারের কথা অনুযায়ী, যদি আগামী জুলাই মাসে এই অর্থ ছাড় হয় তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ অথবা আগামী বছরের শুরুতেই একটু বড়সড় প্রোডাকশন লাইনআপ তৈরি করতে পারব। কালবেলা: পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে কার্যকরী পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বিনিয়োগ কেন পাওয়া যাচ্ছে না? ড. মোবারক আহমেদ: বেসরকারি অর্থায়ন হতে পারত, তবে তারা এগিয়ে আসেনি। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এ প্রজেক্টের বিনিয়োগের ব্যাপারে মিটিংও করেছিলেন, বিদেশিরাও এসেছিলেন। কিন্তু প্রথমত তারা হয়তো বিনিয়োগ করার কনফিডেন্স পাননি, আমরা হয়তো সেই কনফিডেন্সটা তাদের মধ্যে তৈরি করে দিতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, এ দেশের ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। পলিথিন বা প্লাস্টিকজাত পণ্য যারা তৈরি করছেন তাদের সরকার থেকে একটি ভর্তুকি দেওয়া হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী যারা প্লাস্টিক ব্যবসা করেন তাদের ব্যবসা অনেক শক্ত এবং প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বে শুধু সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের ব্যবসার পরিমাণ ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার প্রতি বছর। সুতরাং সে জায়গাটায় আমার সোনালি ব্যাগ প্রবেশ করাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। সোনালি ব্যাগকে এ প্লাস্টিকের এত বিশাল মার্কেটের সঙ্গে ফাইট করতে হবে। তারা কোনোভাবেই চায় না পলিথিনের বিকল্প কোনো কিছু বাজারে আসুক। এটাই সব থেকে বড় বাধা। কালবেলা: সোনালি ব্যাগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কীভাবে এগোতে চান? ড. মোবারক আহমেদ: সোনালি ব্যাগ নিয়ে আমি অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব একটি জিনিস ব্যবহার করা যাচ্ছে এটা অনেক বড় একটি সফলতা। শুধু পলিথিন নয়, বরং যত জায়গায়, যত প্রকার সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় প্রত্যেকটা জায়গায় পাট থেকে তৈরি সোনালি ব্যাগ বিকল্প হিসেবে দাঁড়াবে। সোনালি ব্যাগ দ্রুত বাণিজ্যিকীকরণে গেলে দেশের পাটচাষিরাও উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। দেশে পাট চাষ বৃদ্ধি পাবে। বড় স্কেলে সোনালি ব্যাগের উৎপাদন বিদেশে রপ্তানির দরজা খুলে দেবে। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। সোনালি ব্যাগের উৎপাদন খরচ পলিথিনের থেকে মাত্র দেড়গুণ বেশি। সুতরাং দাম নিয়ে কোনো দেশ চিন্তা করবে না। সোনালি ব্যাগের ব্যাপক প্রোডাকশনে যাওয়া আমাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি মনে করি সোনালি ব্যাগ দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব। কালবেলা: নতুন কোনো গবেষণা করছেন? বর্তমানে সেই গবেষণা কোন পর্যায়ে রয়েছে? ড. মোবারক আহমেদ: আমার নতুন গবেষণাগুলোও পাটভিত্তিক। আমরা পাট থেকে উৎপাদিত একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করেছি। যার তিনটি লেয়ারের মধ্যে সবই পাট থেকে তৈরি করা। এটি বায়ো-ডিগ্রেডেবল এবং ওয়াটার সেলিবল। এটির সবচেয়ে নতুন দিক হলো, এটি ব্যবহার করে ওয়াশরুমের কমোডে ছেড়ে দিলে এটি ফ্ল্যাশের সঙ্গে চলে যাবে। এই প্রোডাক্টটির জন্য আমরা পেটেন্ট অফিসে অ্যাপ্লাই করেছি। পেটেন্ট সম্পন্ন হলে আমরা সেটা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারব। কালবেলা: সরকারের উদ্দেশে কিছু বলবেন কি? মানুষের উদ্দেশে আপনার আহ্বান কী থাকবে? ড. মোবারক আহমেদ: আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম আমাকে ল্যাব এবং প্রোডাকশন প্লান্ট তৈরির জন্য ৩০০ কোটি টাকা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এই ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে আসার একটি পথ তৈরি করতে হবে। আমি একটি ল্যাবরেটরি করতে চাই যেখান থেকে পাটভিত্তিক আরও নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করার এবং আরও অনেক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। আর মানুষের উদ্দেশে বলব—আমি একটি স্লোগান এখনো দিই, স্লোগানটি হলো—প্লাস্টিক পলিউশন, সোনালি ব্যাগ ইজ দ্য সলিউশন। সোনালি ব্যাগটিকে অনেক বেশি মিডিয়ায় নিয়ে যেতে হবে, দেশের মানুষের সামনে এটি তুলে ধরতে হবে। দেশের মানুষ সচেতন হোক, সোনালি ব্যাগ ব্যবহারের গুরুত্ব উপলব্ধি করুক। সর্বোপরি যতটা সম্ভব মানুষ দেশ, পরিবেশ ও পৃথিবীর ক্ষতি এড়িয়ে চলুক। মানুষ পরিবেশবান্ধব হোক, এটাই মানুষের কাছে আমার আহ্বান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম
০১ এপ্রিল, ২০২৪
X