বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী (মুজিববর্ষ) উপলক্ষে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দেওয়া ৭৭টি ঘরের মধ্যে প্রায় ৩৫টি ঘরেই উপকারভোগীরা বসবাস করছেন না। কেউ ২০-২২ দিন, কেউবা আবার ১-২ মাস থাকার পরেই ঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন। এমন অভিযোগ উপজেলার ধুলশুড়া ইউনিয়নের আইলকুণ্ডি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দার।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প আশ্রয়ণ-২-এর ৩য় পর্যায়ের ৪র্থ ধাপের আওতায় ২ কোটি ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ৭৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য এই আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ উপকারভোগী ৭৭টি পরিবারের মাঝে ঘরের চাবি, কবুলিয়ত দলিল, নামজারি খতিয়ান, ডিসিআরসহ যাবতীয় কাগজপত্র হস্তান্তর করে উপজেলা প্রশাসন। এর প্রায় দুই-তিন মাস পর থেকে কিছু কিছু পরিবার পর্যায়ক্রমে ঘরে আসতে শুরু করে। তবে বর্তমানে ৭৭টি পরিবারের মধ্যে ৪২টি পরিবার নিয়মিত বসবাস করলেও ৩৫টি পরিবারের জিনিসপত্র ঘরে থাকলেও তারা নিয়মিত বসবাস করছেন না। অনেক পরিবার আছে, তারা কখনই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বসবাস করেনি। আশ্রয়ণে বসবাসকারী বাসিন্দারা তাদের কোনোদিন দেখেননি বলেও জানান সুবিধাভোগী একাধিক বাসিন্দা।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিটি গলিতেই প্রায় ৮-৯টি ঘরে ঝুলছে তালা। কোনো কোনো ঘরের বারান্দায় লাকড়ি কিংবা ছাগল লালনপালনে ব্যবহার করছেন পার্শ্ববর্তী উপকারভোগীরা।
আশ্রয়ণের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই প্রকল্পের এক নম্বর গলির ৯ নম্বর রুমটির মালিক ইউনিয়নের গঙ্গারামপুর গ্রামের মনো। তিনি ঘর বুঝে পাওয়ার এক বছরের অধিক সময়ে এক দিনও এখানে বসবাস করেনি। দীর্ঘদিন ধরেই তার ঘরে তালা ঝুলছে। ১২ নম্বর রুমটির মালিক আফছার উদ্দিন। তার বাড়ি নবাবগঞ্জ উপজেলার শোল্লা এলাকায়। ঘর বুঝে পাওয়ার পর কয়েক দিন থাকলেও বর্তমানে তিনি নিজ গ্রাম শোল্লাতে সপরিবার বসবাস করছেন। তিনি না থাকায় তার ঘরের বিদ্যুতের লাইনটির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
১৫ নম্বর রুমটির মালিক হেনা। তিনি নিয়মিত থাকেন না। তবে মাঝে মাঝে এসে ঘর দেখে যান। ২০ নম্বর রুমের মালিক মোহনপুর গ্রামের হোসনা। তিনি প্রথম দিকে কিছু দিন আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও প্রায় ১০ মাস ধরে তার কোনো খোঁজখবর নেই। ৩নং গলির ৪৩ নম্বর ঘরের মালিক রোজিনা। তিনি ঘর পাওয়ার পর ২০-২২ দিন বসবাস করে থাকলেও ৯ মাস ধরে এখানে আসেন না। বর্তমানে তিনি থাকেন বালিরটেক ভাড়া বাসায়। ৪৫ নম্বর ঘরের মালিক মাকসুদা। ঘর বুঝে পাওয়ার পরে এক মাস বসবাস করার পর তার স্বামী বিদেশে চলে যায়। এরপর থেকেই প্রায় ৭-৮ মাস ধরে তিনিও ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছেন। বর্তমানে তিনি বাবার বাড়িতেই থাকেন। এ ছাড়াও পরে থাকা প্রায় ৭টি ঘরে বসবাস করছেন বরাদ্দবিহীন আশ্রিত কয়েকটি অসহায় পরিবার। তবে অধিকাংশ ঘরে মানুষজন বসবাস না করায় অযত্ন আর অবহেলায় রয়েছে প্রকল্পের ঘরগুলো।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীদের কাছে তাদের সুবিধা অসুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে এই প্রকল্পের বাসিন্দা আছিয়া বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাগো জায়গা দিছে, ঘর দিছে। আমাগো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিছে। এতে আমরা খুবই উপকার পাইছি; কিন্তু বড় সমস্যা হইল আমরা পরিশ্রম কইরা খাই; কিন্তু এখানে আইসা আমরা পরিশ্রম করবার পারতাছি না। আমাগো কাম নাই। ঘরে খাওন থাকে না। এখানে কর্মের অভাবেই আমরা কষ্ট আছি।
সাথী আক্তার নামে আরেকজন জানান, এখানে একটি স্কুল নেই, মাদ্রাসা নেই, একটি মসজিদ নেই। বাচ্চাদের লেখা পড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে আমরা কষ্টে আছি। তাছাড়া এখানে পুরুষ মানুষের কাজ কামে কষ্ট। এখানে কোনো কাম কাইজের ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই এখানে অনেক ঘরে মানুষ আসেনি।
নাজমা বেগম নামে আরেকজন জানান, এখানে মনে হয় আমরা মরুভূমির মধ্যে আছি। এখানে গভীর নলকূপ থাকলেও বিদ্যুৎ গেলে আমরা পানি উঠাইতে পারি না। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তিন দিন বিদ্যুৎ ছিল না। কত কষ্ট করে যে আমরা বাস করছি, তা আল্লাহই জানেন। তাই আমাদের এখানে মাঝে মাঝে কয়েকটা জায়গায় টিউবয়েল দরকার। আর স্কুল মাদ্রাসা না থাকায় পোলাপানরেও পড়াশোনা করাইতে পারছি না।
ইউএনও মো. শাহরিয়ার রহমান কালবেলাকে জানান, আমরা যতটুকু খোঁজখবর নিয়েছি, এখানে তো কাজের জায়গা নেই। তাই এরা চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। এরা নিয়মিত থাকে না তা না। মাঝে মাঝে কাজের জন্য বাইরে যায় আবার চলে আসে। আর কেউ যদি স্থায়ীভাবে না থাকে, তাহলে আমরা পরিবর্তন করে অন্য কাউকে দিয়ে দেব।