দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভারী যন্ত্রপাতি সচল আছে কি না, তা জানতে একটি সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে ব্যয় হবে ২৯ কোটি টাকা। আগেও প্রায় সমপরিমাণ ব্যয়ে বিদেশি অর্থায়নে এ ধরনের সফটওয়্যার সংযুক্ত ছিল, কিন্তু সেটির যথাযথ ব্যবহার কখনো হয়নি। নতুন সফটওয়্যারটি সংযুক্ত করতে গিয়ে পুরোনোটি অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ ধরনের ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আদৌ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তারা জানান, আগে ইউএসএআইডি একটি সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিল। আমদানিকৃত প্রতিটি যন্ত্রে কিউআর কোড লাগালে সেটির আপডেট তথ্য পাওয়া যেত। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোর দায়িত্বে থাকলেও কাজটি বাস্তবায়ন হয়নি। যন্ত্র বিকল হওয়ার তথ্য জানা গেলেও ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়নি। ফলে ব্যয়বহুল সফটওয়্যারও কোনো কাজে আসেনি। এ কারণে নতুন করে ব্যয় করাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইউএসএআইডি ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ তৈরি করে দেয়। এতে ৪০টির বেশি জেলা যুক্ত করা হয়। ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর ডিএলআই (ডিসবার্সমেন্ট লিংকড ইনডিকেটর) সফলভাবে সম্পন্ন হয়। সফটওয়্যারটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হস্তান্তরও করা হয়েছিল, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন করা যায়।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘নিমিউ অ্যান্ড টিসি’-র চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজারকে একটি চিঠি দেয়। এতে সরকারি হাসপাতালে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি যেমন এমআরআই, সিটি স্ক্যান, কোবাল্ট, ৫০০ এমএ বা তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন এক্স-রে, লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর, ব্র্যাকিথেরাপি, কোবাল্ট-৬০ সিমুলেটর ইত্যাদি সার্বক্ষণিক সচল রাখা ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ইনফরমেশন অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেম’ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। জেলার সদর হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় এ সিস্টেম বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর আগে নিমিউ অ্যান্ড টিসির পক্ষ থেকে সফটওয়্যারটি তৈরি ও স্থাপনের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ কোটি ৫৮ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫০ টাকা (১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৭ শতাংশ এআইটি সহ)। পরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৯ কোটি টাকায়।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, এ ধরনের প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার ব্যয় যৌক্তিক। নিমিউর প্রস্তাবিত ২০ কোটি টাকাও তুলনামূলক বেশি ছিল, কিন্তু অজানা কারণে সেটি ২৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলেও তারা মনে করেন।
জানা গেছে, এ পদ্ধতিতে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রতিটি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি একটি ম্যানেজেবল সুইচ দিয়ে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এর ফলে যন্ত্র বিকল হলেই তাৎক্ষণিকভাবে একাধিক স্থানে নোটিফিকেশন পাঠানো যাবে, যাতে দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া যায়। কিন্তু দেশে ১৫টি উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্র থাকলেও মাত্র ৭টি সিএমসি (কম্প্রিহেনসিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট) করা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে পূর্ণ সুফল পেতে হলে সব হাসপাতালের যন্ত্র সিএমসির আওতায় আনতে হবে।
মজার বিষয় হলো—প্রযুক্তিটি ব্যবহার করবে নিমিউ অ্যান্ড টিসি, আবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের। ফলে কোনো যন্ত্র নষ্ট হলে তার বিষয়ে সিদ্ধান্তও তারাই নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট যন্ত্র বিকল হলেই নোটিফিকেশন পাওয়া যাবে। ইউরোপের ছয়টি দেশে এটি ব্যবহার হয়, কারণ সেখানে স্বাস্থ্য খাতের সব যন্ত্রই লাইফটাইম সিএমসির আওতায় থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ যন্ত্রেই সিএমসি নেই। ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হলে প্রযুক্তির কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ে। কারণ, মেরামতের দায়িত্বও নিমিউ অ্যান্ড টিসির।
তারা আরও বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দেশের ১১৪টি সরকারি হাসপাতালের ৩০০টি যন্ত্রপাতিকে ‘মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ইনফরমেশন অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেম’-এর আওতায় আনা হবে। ক্যানসারসহ গুরুতর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সাত ধরনের যন্ত্রপাতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে ও রেডিওথেরাপি যন্ত্র।
বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০০ সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্বে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান নিমিউ অ্যান্ড টিসি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, বর্তমানে পাঁচ শতাধিক যন্ত্রপাতি মেরামতের আবেদন ঝুলে আছে। এর মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রও রয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক হাসপাতালে আবেদন পৌঁছাতেই বিলম্ব হয়।
এ বিষয়ে নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ৪১৫টি যন্ত্র মেরামতের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে এবং বাকি যন্ত্রগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করতে পরিদর্শন চলছে। জনবল স্বল্পতার কারণে পুরো প্রক্রিয়ায় সময় বেশি লাগছে। কারণ ৯৫টি পদের মধ্যে ৫৮টি শূন্য রয়েছে। ১৯ জন সহকারী প্রকৌশলীসহ মোট ৫৫ জন কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৮ আগস্ট নিমিউ অ্যান্ড টিসিকে চিঠি দিয়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম মনিটরিংয়ের জন্য একটি সিস্টেম প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘আগে এ ধরনের কোনো সফটওয়্যার ছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় এখনো সফটওয়্যারটি স্বাস্থ্য বিভাগের যন্ত্রে স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।’
মন্তব্য করুন