ব্যবাসায়ীদের বাক্সের বাইরে চিন্তার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিকেলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের নেতারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, জাতি হিসেবে মহানুভবতা অর্জনের জন্য বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে হবে। যদি আমরা তরুণদের স্বপ্নকে সত্যি করতে পারি, তাহলে আমরা জাতির স্বপ্নকে সত্যি করতে পারব। এ সময় ব্যবসায়ী নেতারা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার আহ্বান জানান। তারা বলেন, আগের সরকার দেশকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত, রাজস্ব প্রশাসন, শিক্ষা ও শিল্পে গভীর সংস্কার ও পুনর্গঠন প্রয়োজন। আইসিসিবি প্রেসিডেন্ট মাহবুবুর রহমান বলেন, গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে আমরা তার সাক্ষী। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত শতভাগ আপনার সঙ্গে আছে।
এর আগে সকালে নারী নেত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তাদের কথা শোনেন এবং সুপারিশগুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নিহত ও আহতদের পরিবারকে সহায়তার লক্ষ্যে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নারী নেত্রীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের দ্রুত চিকিৎসা এবং আগের ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানান। তারা বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার দাবি জানান।
বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
রিজওয়ানা সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল সবার কথা শোনা এবং আমাদের যে বৃহত্তর সংস্কার পরিকল্পনা রয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের মতামত নেওয়া। অগ্রাধিকার প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এসব পরিবর্তন আনতে না পারলে দলীয় সরকারের অধীনে তা করা কঠিন হতে পারে। এক ঘণ্টার বৈঠকে আমরা সবকিছু চূড়ান্ত করতে পারব না। এগুলো অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। কোনো প্রস্তাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো নেতিবাচক অবস্থান নেই।
তিনি বলেন, আহতদের চিকিৎসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি উদ্যোগ রয়েছে তবে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার প্রস্তাব রয়েছে। এমন একটি ফাউন্ডেশন থাকবে যেখানে মানুষ আর্থিক সহায়তা করতে পারে। তবে ফাউন্ডেশন তৈরির জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য কিছু করার দাবিও ছিল। নারীদের সমস্যাগুলো আলাদাভাবে মোকাবিলা না করে নারী অধিকার কমিশন গঠন করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা বাংলাদেশ তথ্য কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়িত করার প্রস্তাব করেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রসঙ্গে একজন নারী শিক্ষার্থী সমন্বয়ক বলেন, বিগত সরকারের ছাত্র শাখার সদস্যদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। সমাজকে নারীবান্ধব করার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়ে কল্পনা চাকমা, তনু ও নুসরাতের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে।
রিজওয়ানা বলেন, শুধু নারীদের সমস্যা নিয়ে নয়, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য 'বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন'র মাধ্যমে এসব কাজ করা যায় কি না তা দেখার প্রস্তাব রয়েছে। এনজিওগুলো যাতে এনজিও ব্যুরোর হয়রানির শিকার না হয়, সে দাবিও জানান অংশগ্রহণকারীরা। শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম ও ফরিদা আক্তার, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ, শিরিন হক, সামিয়া আফরিন, সীমা দাস সিমু, তাসলিমা আক্তার, রিতু সাত্তার, বিথী ঘোষ, সুলতানা বেগম, নিগার সুলতানা, সুফিয়া রহমান, তাসকিন ফাহমিনা, মেঘনা গুহঠাকুরতা, রানী ইয়ান ইয়ান, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, শাহীন আনাম, নিরূপা দেওয়ান, অধ্যাপক ফাহমিদা খাতুন, শ্যামলী শীল, আইরিন খান ও নাবিলা ইদ্রিস বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।
ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়
এদিকে প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন আইসিসিবি। সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল জানায়, দেশের ব্যবসায়ীরা প্রধান উপদেষ্টার নতুন ভূমিকায় তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তাদের ধন্যবাদ জানান এবং বলেন যে, তার প্রশাসন উত্তরাধিকারসূত্রে অর্থনৈতিক বিপর্যয় পেয়েছে, কিন্তু তিনি নিশ্চিত যে অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। এটি একটি খুব কঠিন পরিস্থিতি যা আমরা এখন রয়েছি। কিন্তু এটাও সবচেয়ে বড় সুযোগ যা আমরা পেতে পারি। আমাদের কাজ কঠিন, কিন্তু অনেক বেশি সম্ভব।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ যদি একটি জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে জগাখিচুড়ি কাটিয়ে উঠতে পারে, তাহলে আমরা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। বিশ্ব আমাদের অনুপ্রেরণার জন্য দেখবে এবং বিশ্ব আমাদের সঙ্গে আরও ব্যবসা করতে চাইবে।
বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম, তপন চৌধুরী, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, এ কে আজাদ, সিমিন রহমান, খন্দকার রফিকুল ইসলাম, নাসের এজাজ বিজয়, ফজলুল হক ও মোহাম্মদ হাতেমসহ সিনিয়র ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রআন্দোলনে হতাহতদের জন্য ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালিন সরকার জুলাই-আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নিহত ও আহতদের পরিবারকে সহায়তার লক্ষ্যে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ফাউন্ডেশনের প্রধান হবেন, যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, ছাত্র প্রতিনিধি এবং নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। খুব শিগগিরই ফাউন্ডেশনের কার্যপ্রণালি ঘোষণা করা হবে। নাগরিক এবং বাংলাদেশি প্রবাসীদের ফাউন্ডেশনে অবদান রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস বলেছেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করার সময় যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং যারা গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন তাদের অবদান আমরা কখনই ভুলতে পারি না। তাদের পাশে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব এবং আমাদের জাতীয় কর্তব্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আহত এবং নিহতদের পরিবারের দেখভালের জন্য যা যা করা দরকার আমরা তা করব। তাদের চিকিৎসা ও পারিবারিক বিভিন্ন প্রয়োজনের ব্যবস্থা করা হবে।
মন্তব্য করুন