বৈষম্যের দেয়াল পেরিয়ে ঈদের আনন্দ
ঈদকে বলা হয় সাম্যের উৎসব। ধনী-দরিদ্র এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের খবর কী, যারা বড় বড় মসজিদের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকে ধনীদের অনুকম্পার আশায়। খুব একটা যে পায় তা নয়, তবু আসে, আশায় আশায় থাকে। অনেকে প্রাইভেটকারে করে ঈদের জামাতে আসে, গাড়ির ড্রাইভাররাও শামিল হয়, কিন্তু ওইটুকু পর্যন্তই, জামাত হওয়ামাত্র ড্রাইভার যায় তার জায়গায়, মালিক বসেন আসনে।
জামাতে ইমাম সাহেব বলেন, ঈদ হচ্ছে একতার উৎসব। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন। মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে সেই বাণী। কিন্তু বাইরে আসামাত্র দিবালোকের মতো যে সত্যের মুখোমুখি হতে হয় সেটা হলো অনৈক্য নয়, বিচ্ছিন্নতা।
ঈদ এখন যে-সত্যটিকে উন্মোচিত করে দেয় সেটা হলো সমাজে বিদ্যমান অসাম্য। ব্যাপারটা এমন স্পষ্ট করে কম সময়েই এসে আমাদের ধাক্কা দেয়। মধ্যবিত্তের একাংশ ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বৃহদাংশ দেশের বাড়িতে ছোটে আপনজনের সান্নিধ্য পাবে বলে। গরিব মানুষ কী করবে ভেবে পায় না, নিতান্তই অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে তাদের চালচলনের দিকে। ঈদ আসলে বিত্তবানদেরই। কিন্তু তারাও ঈদে সামাজিক থাকে না, বিচ্ছিন্নই রয়ে যায়।
কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দাশ একদা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ জীবিত থাকলে ওই আক্ষেপোক্তি তাকে প্রত্যাহার করে নিতে হতো বৈকি; কারণ আমাদের ছেলেরা এখন কেবল কথায় নয় কাজেও যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই। দুর্নীতিতে এবং বসবাসের অযোগ্য রাজধানী সৃষ্টিতে আমরা সাধারণত বিশ্বে শীর্ষস্থানের আশপাশেই থাকি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে একেক সময় একেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে তোলে; এমনকি নিরীহ যে ছাপার ও লেখার কাগজ তাকেও মায়া করে না, তার দামও আকাশমুখো করে ছাড়ে।
একদা আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে আওয়াজ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রণধ্বনির অংশ; তারপর আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ দূরে থাক, গণতান্ত্রিক বাংলাও গড়ে তুলতে পারিনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসা-যাওয়া করেছেন, নিজেদের তারা নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলেই জেনেছেন এবং জানিয়েছেনও; কিন্তু তাদের তৎপরতার কারণেই ওই স্বপ্নটা এখন আর নেই। এখন আমরা আধুনিক বাংলা গড়ার তালে আছি, ডিজিটাল স্তর পার হয়ে স্মার্ট স্তরে উন্নীত হতে আমাদের চেষ্টা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের এইসব বাংলার আসল ব্যাপারটা কী? সেটা তো এই যে, বাংলাদেশ পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে, আগে যেমন ছিল। এবং আগামীতে যে আরও অধিক পরিমাণেই পুঁজিবাদী ও অগণতান্ত্রিক হবে, সেটাও নিশ্চিত।
ঈদের ছুটিতে ধনীরা মফস্বলে যায় না এটা ঠিক, তবে পুরোনো এই শহরে যে থাকতে পছন্দ করে, তাও নয়। কেউ যায় সমুদ্রসৈকতে, কেউ খোঁজে রিভার রিসোর্ট, আরও যারা বিত্তবান তারা চলে যায় বিদেশে।
কিন্তু আমরা যারা এসব কথা বলছি তারা কী চাই? আকাঙ্ক্ষাটা কী? না, আমরা বড় কিছু চাই না, চাই সামাজিকীকরণ। যেমন যানবাহনের তেমনি ঈদের মতো উৎসবেরও। আমরা চাই গ্রাম যেন মানুষকে আশ্রয়স্থল থেকে উৎপাটিত করে শহরের দিকে ঠেলে না দেয়। তার জন্য প্রয়োজন হবে কর্মসংস্থানের, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের। ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলা দরকার। নদী ও জলাশয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার চাই। চাই ফসলি বৃক্ষের সাহায্যে সামাজিক বনায়ন। চাইব আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি, যাতে গ্রামে থাকাটা বিপজ্জনক বলে ধারণা না হয়। দরকার মফস্বলে উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। চিকিৎসার উন্নয়নের জন্য আয়োজন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের। আমরা চাইব গ্রামকে শহরের দিকে টেনে না এনে শহর নিজেই গ্রামের দিকে রওনা দিক।
এসব কাজ মোটেই ছোট নয়। অত্যন্ত বড় ও কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যে বিকেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলোর একটি। উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু উপজেলা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। কারণ ক্ষমতা কার কাছে কতটা থাকবে, ঠিক করা যায়নি। ক্ষমতা তো যাবে সাধারণ মানুষের কাছে, তা যাচ্ছে না। এমপিরা বিকেন্দ্রীকরণে সাহায্য করবেন কী, উল্টোটা ঘটাচ্ছেন। বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনকর্তা যে শাসকশ্রেণি তারা তো কিছুতেই চাইবে না যে, ক্ষমতা তাদের হাত থেকে জনগণের হাত চলে যাক। তাদের চেষ্টা ক্ষমতা যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে। ফেরিওয়ালা তার সম্পত্তি মাথায় করে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, সম্পত্তিবানরা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে চিন্তা দিয়ে মাথাভর্তি করে রাখবে।
এমন হাজার হাজার, লাখ লাখ নরনারী রয়েছে এই শহরে, যাদের জীবনে কোনো ছুটি নেই, ঈদ নেই। ছুটি নিলেই অনাহার। এরা পুঁজি যেটুকু আছে আঁকড়ে ধরে রাখে। কেননা জানে, যে কোনো মুহূর্তে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। গ্রামে যদি আশ্রয় থাকত তাহলে জীবন বিপন্ন করে হলেও সেখানে ছুটত, যেমন লাখ লাখ মানুষ ছুটেছে। কেননা গ্রামের ওই আশ্রয়ে জীবন আছে বলে তারা মনে করত।
ছুটিতে ছুটতে ছুটতে পড়ি তো মরি হয়ে যারা দেশের বাড়িতে গেছে তাদের আবার ঠিক ওইভাবেই ফিরে আসতে হয়। সেই ঠেলাঠেলি ঠাসাঠাসি ধাক্কাধাক্কি—বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে। সেই ওষ্ঠাগত প্রাণ। সময়মতো না ফিরতে পারলে চাকরি যাবে। শহর থেকে বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছেছে আপনজন তখন ঈদের চাঁদ পেয়েছে হাতে। সুবাতাস বয়ে গেছে খুশির। কিন্তু তারাই, ওই আপনজনরাই আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যদি দেখে প্রিয়জনটির তাড়া নেই ঢাকায় ফিরবার। তাহলে কি চাকরি নেই? কোনো সর্বনাশ কি ঘটে গেছে, যে জন্য বাড়িতে ফিরে এসেছে, ফেরত যাবার জন্য উশখুশ করছে না? এবং তারা স্বস্তি পায় যখন দেখে প্রিয়জনটি আবার রওনা হয়েছে বান্ধবহীন সেই মরুভূমিতে, রাজধানীর সেই অনিশ্চিত শহরে। কিন্তু কেন এমটা ঘটল? ঘটার প্রধান করাণ হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের উন্নতি, যাতে একজন ফুলেফেঁপে ফুঁড়ে ফাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে খাড়াখাড়ি উঠে যায় ওপরের দিকে, আর অন্য দশজন সেই উন্নতির বোঝা বহন করতে গিয়ে নানা মাত্রায় অবনত হতে থাকে। এত লোক চলে যাবে, তবু রাজধানীতে যে লোকের অভাব হবে না, তার অর্থ ওই যে টেনে নেওয়া এবং ঠেলে বের করে দেওয়া এ ব্যাপারটা, পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এখন আওয়াজ উঠেছে যে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, তাতেও সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে ওই আমলাতন্ত্রেরই। আমলারা মনে করে তারাই সবচেয়ে স্মার্ট। রাজনীতিকদের তুলনায় তো অবশ্যই, ব্যবসায়ীদের তুলনাতেও। ওই স্মার্টরাই যদি ক্ষমতাধর ও আদর্শস্থানীয় হয় তাহলে অবস্থা যে আরও খারাপ হবে সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের সম্পাদক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি
২৮ জুন, ২০২৩