আরিফুর রহমানের নিবন্ধ / ঈদের আনন্দ প্রকাশ
ঈদের দিনের গোসল ও সাজসজ্জা ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা সুন্নত। কারণ এদিন নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানরা ঈদগাহে একত্র হয়ে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)। এদিন উত্তম জামাকাপড় পরাও সুন্নত। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরা, অন্যথায় নিজের পরিষ্কার উত্তম পোশাক পরা। হজরত নাফে (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। অতঃপর নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২) ঈদগাহে যাতায়াতে তাকবির বলা ঈদমাঠে এক পথ দিয়ে যাওয়া ও অন্য পথ দিয়ে ফেরা সুন্নত। সম্ভব হলে ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়াও সুন্নত। যাওয়া-আসার সময় তাকবির বলা। তাকবির হলো—‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহ আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ বাক্যটি উচ্চৈঃস্বরে পড়া। পুরুষরা এ তাকবির উঁচু আওয়াজে পাঠ করবে, মেয়েরা নীরবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন।’ (মুসতাদরাক: ১১০৬)। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর এ তাকবির একবার পাঠ করা ওয়াজিব। (ফাতহুল বারি : ২/৫৮৯) ঈদের নামাজ আদায় ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। ঈদের নামাজের মাধ্যমেই ঈদের প্রকৃত আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঈদের সব প্রস্তুতি মূলত আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যে শুকরিয়াস্বরূপ দুই রাকাত নামাজ পড়ার মাধ্যমে। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম। ঈদের নামাজে আজান ও ইকামত নেই। দুই রাকাত নামাজে অতিরিক্ত ছয় তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা ও ছানা পড়ার পর সুরা ফাতেহার আগে অতিরিক্ত তিন তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। তারপর যথারীতি প্রথম রাকাত সম্পন্ন করে দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহা ও কেরাত পড়ার পর রুকুর আগে তিন তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। তারপর যথারীতি নামাজ সম্পন্ন করতে হয়। নামাজ শেষে খুতবা শোনা। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন—১. হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামরা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অন্যকে বলতেন—‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ—আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। ২. ঈদ মোবারক ইনশাআল্লাহ। ৩. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। ঈদে খাবার গ্রহণ ও অভাবীদের খাওয়ানো ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে বের হতেন না আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের আগে খেতেন না।’ (তিরমিজি: ৫৪৫)। ঈদের দিন এতিম-অভাবীদের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এটা ইমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহার: ৮) আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া ঈদের সময় আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। পাশাপাশি প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নেওয়া। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ (সুরা নিসা: ৩৬) মনোমালিন্য দূরীকরণ জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে, দেখা-সাক্ষাৎ হলে একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মধ্যে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ (মুসলিম: ৬৬৯৭) ঈদের আনন্দ প্রকাশ ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে সুষ্ঠু বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে এলেন, তখন আমার কাছে দুটি ছোট মেয়ে গান গাচ্ছিল বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। এরই মধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি: ৯৫২) পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ঈদুল আজহায় পশুর রক্ত, আবর্জনা ও হাড় থেকে যেন পরিবেশ দূষিত না হয়, সেদিকে প্রত্যেকের সতর্ক হওয়া উচিত। কোরবানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত, আবর্জনা ও হাড় নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য এবং ইবাদত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিদের ভালোবাসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতাকে বেশি ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ১০৮)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক।’ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার প্রতি তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই কোরবানির পশুর রক্ত-আবর্জনা পরিষ্কার করা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্বও। লেখক: সাংবাদকর্মী
১০ মে, ২০২৪

সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করুন : প্রধানমন্ত্রী
দেশবাসীকে সুখী, আনন্দময় ও নিরাপদ ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (১০ এপ্রিল) এক ভিডিও বার্তায় এ শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী। ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আবার আমাদের মধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর এসেছে। ঈদ মানে আনন্দ। আসুন আমরা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করি।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ঈদুল ফিতর আমাদের সবার জীবনে বয়ে আনুক সীমাহীন আনন্দ, সুখ ও শান্তি। ‘আপনারা সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন ও নিরাপদে থাকুন। ঈদ মোবারক।’ এ কথা বলে শেখ হাসিনা ঈদের বার্তা শেষ করেন। মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় শাওয়ালের চাঁদ দেখা না যাওয়ায় বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে।
১০ এপ্রিল, ২০২৪

ওদের ঘরে নেই ঈদের আনন্দ / গ্রামে সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে চেয়েছিলেন লামিসা
‘রমজান শেষে সবার ঈদ উদযাপন হবে ফরিদপুরে। দাদু, মামনি (বড় চাচি), ছোট চাচা, চাচি আর সব ভাইবোন মিলে হবে ঈদের আনন্দ। ভাইয়া এবার ঈদে আমরা সবাই বাড়িতে যাব।’ মৃত্যুর এক দিন আগে ঈদ উদযাপন নিয়ে এভাবেই হয়েছিল চাচাতো ভাই প্রীতমের সঙ্গে লামিসার শেষ কথা। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় গিয়ে অগ্নিকাণ্ডে লামিসার মৃত্যু হয়। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের আর অ্যান্ড সিপি বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি নাসিরুল ইসলাম শামীমের বড় মেয়ে। বুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ফরিদপুর দক্ষিণ ঝিলটুলী এলাকার স্বর্ণলতার বাড়ির স্তব্ধতায় শোকে মুহ্যমান গোটা মহল্লাবাসী। প্রতিবেশী থেকে সবাই কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যায় বাড়িটির সামনে এলে। বাড়ির কলিংবেল চাপ দিতেই এক ভদ্র মহিলা (লামিসার চাচি) বের হয়ে আসেন। চোখে-মুখে যেন এখনো একরাশ বেদনার ছাপ। লামিসাদের বাড়ি কি না জানতেই নীরবে চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। চোখ ভেজা, ভাঙা কণ্ঠে তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর আরেক যুবক বের হয়ে এসে পরিচয় দেন তিনি লামিসার বড় চাচা ছেলে মীর সাফায়েত রফিক প্রীতম। প্রীতম বলেন, এবার ঈদে সব ভাইবোন মিলে ঈদ করার কথা ছিল আমাদের। লামিসা বলেছিল এবার ঈদে আমরা সবাই একসঙ্গে আনন্দ করব। কিন্তু সব কেমন পাল্টে গেল।’ প্রীতম বলেন, ‘আমরা যৌথ পরিবার। আমাদের বাড়ির বড় মেয়ে ছিল লামিসা। অগ্নিকাণ্ডে ওর মৃত্যুর পর কোনোভাবেই আমার চাচাসহ (লামিসার বাবা) আমাদের পরিবারের কেউ শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। আমাদের কোনো ঈদ আনন্দ নেই। ঈদ উপলক্ষে কোনো কেনাকাটা আমরা কীভাবে করি!’ ২০১৮ সালে লামিসার মা আফরিনা মাহমুদ মিতুর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে বাবা ও ছোট বোন রাহিসার সঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অফিসার্স ক্লাবে বসবাস করছিলেন লামিসা।
০৮ এপ্রিল, ২০২৪

ওদের ঘরে নেই ঈদের আনন্দ / ঈদের আনন্দ নেই জিম্মি নাবিকদের পরিবারে
সোমালি জলদস্যুদের হাতে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ জিম্মিদশার ২৭ দিন পেরিয়ে গেছে এরই মধ্যে। ভারত মহাসাগর থেকে ১২ মার্চ ২৩ নাবিকসহ এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজ জিম্মি করে সোমালিয়ার দস্যুরা। জাহাজটি এখন সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূল থেকে দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করে রেখেছে দস্যুরা। জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে জলদস্যুদের সঙ্গে জাহাজ মালিকপক্ষের আলোচনাও এগিয়েছে অনেকদূর। মুক্তিপণ নিয়ে সমঝোতাও চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ঈদের আগে তাদের দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই অবস্থায় জিম্মি নাবিকদের পরিবারেরও ঈদের আনন্দ নেই। তারা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে তাদের প্রিয়জন এই বন্দিদশা থেকে বাড়িতে আসবে। চট্টগ্রামের তিন নাবিকের পরিবারে শুধুই কান্না এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে অয়েলার হিসেবে কর্মরত আইনুল হক অভি। বন্দি ২৩ নাবিকের একজন তিনি। তার পরিবার থাকে চট্টগ্রাম আতিকুল্লাহ খানের মতো জিম্মি ২৩ নাবিকের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মধ্যেও নেই ঈদ আনন্দ উৎসবের কোনো আয়োজন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অজানা শঙ্কায় এবার তাদের সব আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। কিন্তু জিম্মি নাবিকদের পরিবারে নেই কেনাকাটার আয়োজন। খুশির বদলে ভর করেছে অজানা আতঙ্ক। কবে তারা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাবেন, পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবেন সেই প্রত্যাশায় ক্ষণ গুনছেন তারা। অপহৃত হওয়ার পর থেকেই ছেলের মুক্তির অপেক্ষায় কেঁদে কেঁদে সময় পার করছেন হক অভির বৃদ্ধ মা-বাবা। সন্তানকে সুস্থ শরীরে ফিরে পেতে নামাজ আদায় করছেন। মাঝেমধ্যেই একবার ছেলের ছবির দিকে, আরেকবার মোবাইল ফোনের দিকে তাকাচ্ছেন কোনো ভালো সংবাদ এলো কি না। চেয়েছিলেন ঈদের আগেই যেন ছেলে মুক্তি পায়। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর শেষই হচ্ছে না। ঈদের প্রস্তুতি কিংবা কেনাকাটা কোনোটিই হয়নি তার পরিবারে। মো. শামসুদ্দিন নামের অন্য এক নাবিকের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের ঈদের আনন্দও ম্লান। অন্যবারের মতো খুশি নেই। আছে হতাশা আর শঙ্কা। অয়েলার পদে কর্মরত শামসুদ্দিনের বাসা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কাফকো-সংলগ্ন সেন্টার এলাকায়। তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেজো মেয়ে ক্লাস ওয়ানে এবং ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। তাদের এবার ঈদ কাটবে নিরানন্দে। জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদের বাড়ি নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন গোসাইলডাঙ্গা এলাকার। তার বাবা মো. আবদুল গনির কালবেলাকে বলেন, মোবাইল ফোনটা সবসময় কাছেই রাখি। কখন শুনতে পাব আমার ছেলে মুক্তি পেয়েছে। ছেলের একটি ফোনের আশায় এখন দিন কাটছে। এবার ঈদে আমাদের ছেলের বাড়িতে আসার কথা ছিল। বলেছিল, মা ঈদে বাড়ি যাব। ছুটি নিয়ে সবাই মিলে ঈদ করব একসঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, ছেলে আমার হাজার-হাজার মাইল দূরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। বাড়িতে নেই ঈদের আনন্দ। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছি। জাহাজের সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলায়। তার বাবা মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের মধ্যে ঈদের আনন্দ নেই। ছেলেকে দ্রুত ফিরে পেতে চাই। সরকার যেন দ্রুত ঈদের আগেই আমার ছেলেসহ অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়, সেই দাবি ও অনুরোধ করছি। ছেলেকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগছে না। কবে ফিরবে আমার বুকের ধন?’ ছেলে সাব্বির কবে আসবে, সেই অপেক্ষায় মা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সহবতপুর ইউনিয়নের ডাঙা ধলাপাড়া গ্রামের হারুন অর রশিদের ছেলে সাব্বিরের বাড়িতে নেই ঈদের প্রস্তুতি। গত বছরও পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করেছেন সাব্বির। কিন্তু এ বছর জাহাজ ছিনতাই হওয়ার পর সাব্বিরের ভাগ্যে কী ঘটছে, সেই শঙ্কায় ঈদের আনন্দ নেই তার পরিবারে। সাব্বিরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর ছেলেই ঈদের কেনাকাটা করলেও এবার কিছুই হয়নি তাদের। ছেলে নিরাপদে ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন তার বাবা-মা। জলদস্যুরা কথায় কথায় মাথায় বন্দুক ধরে, জাহাজে খাবার সংকট, পানি সংকটসহ এমন নানা দুশ্চিন্তায় আরও ভেঙে পড়েছেন তারা। সন্তানের ভালো সংবাদের অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না তাদের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাব্বিরের মা সালেহা বেগম বলেন, গতবার ছেলে আমাদের সঙ্গে ঈদ করেছিল। এবার পারবে কি না জানি না। তিনি বলেন, আমরা কিছু চাই না, শুধু আমার ছেলেকে চাই। আমরা ছেলের সঙ্গে ঈদ করতে চাই। ছেলে বাড়ি না এলে আমাদেরও ঈদ করা হবে না। সরকারের কাছে আবেদন, ঈদের আগেই যেন আমার ছেলেসহ সবাইকে ছাড়িয়ে আনে। সাব্বিরের বাবা হারুন অর রশিদ বলেন, জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর এক দিন ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারপর আর কথা হয়নি। আমি ও আমার স্ত্রী ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি কখন সাব্বির কল দিয়ে বলবে ভালো আছি, চিন্তা করো না তোমরা। আমার ছেলের সঙ্গে গতবছর একসঙ্গে ঈদ করেছি। এবারও আশায় আছি, জানি না করতে পারব কি না। সরকারের কাছে দাবি, দ্রুত আমার ছেলেসহ সবাই বাবা-মায়ের কোলে ফিরে আসুক। নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, সাব্বিরের পরিবারের সব সময় খোঁজখবর রাখছি। ঈদ উপলক্ষে তাদের বাড়িতে ঈদ উপহার পাঠানো হবে। ‘আমাদের দেখার কেউ নেই’ ‘গত কোরবানির ঈদে নাজমুলকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের দিন কেটেছে। সেই ঈদে নাজমুল গরু কোরবানি দিয়েছিল। কত আনন্দই না করেছিল আমার ছেলে। এই ঈদে আমার নাজমুল আমার কাছে নেই। আমি কী করে ছেলেকে ছাড়া ঈদের দিন কাটাব।’ এভাবেই আহাজারি করছিলেন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের নাজমুলের মা নার্গিস খাতুন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জলদস্যুরা যেদিন আমার ছেলেসহ ২৩ জনকে আটক করে ওই সময়ই সরকারি লোক এবং চেয়ারম্যান এসেছিল আমাদের খোঁজখবর নিতে। এর পর থেকে কেউই আমাদের খোঁজখবর নেয়নি। শুধু শিপিং অফিস থেকে মাঝে মধ্যে কল করে বলে চিন্তা করিয়েন না, নাজমুল ভালো আছে। ছেলের চিন্তা করতে করতে আমি এবং ওর বাপও দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। আমরা নাজমুলকে ছাড়া কীভাবে দিন পার করছি কেউ খোঁজ নেয় না।’ নাজমুলের বাবা বলেন, ছেলের আয়ের ওপরই এখন সংসার। একমাত্র ছেলে আমার ওই ভাঙা ঘরে থাকে। এবার ১০ মাসের জন্য গেছে। ফিরে এসে ওর জন্য হাফওয়াল ঘর দেওয়ার কথা বলেছি। জানি না, ছেলেকে আর দেখতে পাব কি না। ওর কিছু হলে আমরা শেষ হয়ে যাব।’ ইউএনও শাহীন সুলতানা বলেন, ‘নাজমুলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ আমাকে কেউ জানায়নি কিংবা উনারাও আমার কাছে আসেনি। এসিল্যান্ড প্রথম দিন গিয়েছিল। আমি ব্যস্ত থাকায় এতদিন যেতে পারিনি। কিছু ঈদ উপহার সামগ্রী নিয়ে যাব নাজমুলের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে যদি আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারেকুলের বাড়িতে সুনসান নীরবতা ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকড়িকান্দি গ্রামে তারেকুল ইসলামের বাড়িতে গতকাল গিয়ে দেখা গেছে পুরো বাড়িতে কবরের নীরবতা। বাড়িতে কেউ এলেই তারেকুলের মা ভাবেন, এই মনে হয় তার ছেলের কোনো সুসংবাদ এলো। বৃদ্ধ দাদি এগিয়ে আসেন তার নাতির খোঁজ জানতে আর তারেকুলের ১৪ মাস বয়সী একমাত্র কন্যা তানজিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে দাদার কোলে বসে। তারেকুল দস্যুদের হাতে জিম্মি থাকায় পরিবারে নেই ঈদের আমেজ। এবার কোনো কেনাকাটাও করেননি তারা। নেই ভালো কিছু রান্নার প্রস্তুতিও নেই। তারেকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, সরকার ও জাহাজ কোম্পানির কাছে আমার অনুরোধ আমার ছেলেকে নিরাপদে যেন উদ্ধার করে। তারেকুলের মা হাসিনা বেগম জানান, প্রতিবছর ছেলেরাই ঈদের কেনাকাটা করে। এবার কিছুই হয়নি তাদের। ছেলের সুস্থতা আর নিরাপদের ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। তিনি বলেন, গতবার ঈদের নামাজ জাহাজে পড়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। ঈদের দিন ফোনে সবার সঙ্গে কথা বলেছে। বাড়িতে ঈদ করতে না পারলে ভিডিও কলের মাধ্যমে জাহাজে ঈদের নামাজের গল্প শোনাতো তাকে। সরকারে কাছে আবেদন তার ছেলেসহ সবাইকে যেন ঈদের আগেই ছাড়িয়ে আনে। সাইদুজ্জামানের বাড়িতে জেলা প্রশাসক এমভি আব্দুল্লাহ হাজাজের প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামানের বাড়ি নওগাঁ শহরের আরজি নওগাঁর শাহি মসজিদ এলাকায়। স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছেন স্ত্রী মান্না তাহরিন শতধা। আর শিশু সন্তান মেহেরিমা সাফরিন জামান ছটফট করছে তার বাবার বুকে যাওয়ার জন্য। ফলে বাড়িতে নীরবতা, নেই ঈদের আনন্দ। গত মঙ্গলবার উপহার সামগ্রী নিয়ে সাইদুজ্জামানের পরিবারে সাক্ষাৎ করেছেন নওগাঁ জেলা প্রশাসক গোলাম মওলা। এ সময় সাইদুজ্জামানের শিশুকন্যার জন্য ঈদের নতুন জামা উপহার দেন তিনি। এ ছাড়া রমজানে পরিবারে খাদ্য সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক। সাইদুজ্জামানের বাবা সাবেক অধ্যক্ষ ও নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমার ছেলে এবার ঈদে বাড়িতে আসার কথা ছিল। বলছিল ছুটি নিয়ে সবাই মিলে ঈদ করব একসঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস ছেলে আমার হাজার হাজার মাইল দূরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। মাঝে মধ্যে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। জলদস্যুরা কোনো বাধা দিচ্ছে না। আর জাহাজ কোম্পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা চেষ্টা করছে ফিরিয়ে আনার। সাইদুজ্জামানের স্ত্রী মান্না তাহরিন শতধা বলেন, ঈদের আনন্দের চেয়ে বড় আনন্দ হবে যদি দ্রুত স্বামীকে ফিরে পেতাম। সরকার যেন দ্রুত উদ্যোগ নেয়। এমন রমজান কখনো আসেনি সালেহর পরিবারে জিম্মি জাহাজের ইঞ্জিন ফিটার সালেহ আহমেদের পরিবারের রমজান কাটছে দুশ্চিন্তা আর শঙ্কায়। এমন রমজান তাদের জীবনে এর আগে কখনো আসেনি। সালেহ নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা ইউনিয়নের সিংবাহুড়া গ্রামের মুন্সিবাড়ির মৃত সাখাওয়াত উল্লাহর ছেলে। তার স্ত্রী তানিয়া আক্তারের সঙ্গে গত শুক্রবার সর্বশেষ কথা হয়েছিল সালেহর। তিনি জানিয়েছেন, তারা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। জলদস্যুরাও তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করছেন। মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে বলেও তিনি তার স্ত্রীকে জানিয়েছেন। স্ত্রী তানিয়া আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘জাহাজের কোম্পানির লোকজন প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন, আপডেট দিচ্ছেন, তাতে আমাদের চিন্তা ও শঙ্কা কিছুটা কমছে। এতদিন ভাবছি ঈদের আগে আমার স্বামী বাড়ি ফিরবে। তবে এখন মনে হচ্ছে ঈদ একাই করা লাগবে। তবুও আমরা আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি তারা মুক্ত হয়ে ফিরবেন।’ ঈদের আগেই সন্তানের মুক্তি চান রাজুর বাবা-মা জলদস্যুদের হাতে জিম্মি আনোয়ারুল হক রাজু নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুর গ্রামের আজিজুল হক মাস্টারের ছেলে। রাজুর বাবা আজিজুল হক মাস্টার বলেন, রাজু বাড়িতে এসে ঈদ করার কথা ছিল। ঈদের আগেই যেন আমার সন্তানসহ সব নাবিকের মুক্তির ব্যবস্থা করে সরকার সেই দাবি করছি। রাজুর মা দৌলত আরা বেগম বলেন, আমরা খুবই কষ্টে দিন অতিবাহিত করছি। প্রধানমন্ত্রী ঈদের আগেই যেন আমার ছেলেসহ জিম্মি সবাইকে ছাড়িয়ে আনে। ছেলে ছাড়া আমাদের কোনো ঈদ আনন্দ নেই। (প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন সাইদুল ইসলাম ও নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম ব্যুরো; টাঙ্গাইল প্রতিনিধি আবু জুবায়ের উজ্জল, কামারখন্দ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি আমিরুল ইসলাম, ফরিদপুর প্রতিনিধি তন্ময় উদ্দৌলা, নওগাঁ প্রতিনিধি বিকাশ চন্দ্র প্রামানিক, নোয়াখালী প্রতিনিধি মোজাম্মেল হোসেন ও চাটখিল প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ।)
০৮ এপ্রিল, ২০২৪

ঈদের আনন্দ কেমন ছিল প্রিয় নবীজির
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদকে ঘিরে মোমিনের হৃদয়ে বয়ে যায় আনন্দণ্ডখুশির স্নিগ্ধ সমীরণ। মহান স্রষ্টার দরবারে পরম কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে আনুগত্যের শির। এ আনন্দ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুনির্ধারিত মাধ্যম হলো ঈদ। ঈদ আনন্দও একটি ইবাদত। তাই একজন মোমিনের ঈদ আনন্দ পালন কেমন হবে, তা দেখিয়েছেন প্রিয় নবীজি (সা.)। বিভিন্ন হাদিসে নবীজি (সা.)-এর ঈদযাপনের নানা চিত্র উঠে এসেছে। একজন অনুগত মোমিন হিসেবে নিজের জীবনে সে সুমহান আদর্শের বাস্তবায়ন করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। ঈদের আনন্দ প্রকাশ: নবীজি (সা.) ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশে উৎসাহিত করেছেন। শরিয়তসিদ্ধ আনন্দ প্রকাশের বহু মাধ্যম রয়েছে, তা গ্রহণ করে আনন্দ প্রকাশ করা বৈধ। তবে আনন্দ বিনোদনের নামে ইসলামে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা অনুগত মোমিনের জন্য শোভা পায় না। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন। তখন আমার কাছে দুটি বাচ্চা মেয়ে বুআস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে গান করছিল। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। এর মধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে ঢুকে আমাকে ধমকাতে লাগলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর ঘরে শয়তানের বাঁশি?’ রাসুল (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর আজ আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি : ৯৫২)। অন্য এক হাদিসে এসেছে- আয়েশা (রা.) বলেন, এক ঈদের দিন ক’জন হাবশি লাঠি নিয়ে খেলা করছিল। রাসুল (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আয়েশা! তুমি কি লাঠিখেলা দেখতে চাও?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। তিনি তখন আমাকে তার পেছনে দাঁড় করান। আমি আমার গাল তার গালের ওপর রেখে লাঠিখেলা দেখতে লাগলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘হে বনি আরফেদা! লাঠি শক্ত করে ধরো।’ আমি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তিনি তখন বললেন, ‘তোমার দেখা হয়েছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘তাহলে এবার যাও।’ (বোখারি : ৯৫০)। উত্তম পোশাক পরিধান: আলী (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঈদের দিন আমাদের সবচেয়ে উত্তম পোশাকটি পরিধান করতে বলেছেন।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৭৫৬০)। বিখ্যাত ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তার একটি বিশেষ পোশাক ছিল, যা তিনি দুই ঈদ ও জুমায় পরতেন।’ (যাদুল মাআদ : ৪২৫/১)। সকালে খেজুর খাওয়া: ঈদুল ফিতরের দিনে কিছু না খেয়ে বেরুতেন না। আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের আগে কিছু খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কোরবানির গোশত দিয়ে আহার করতেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৪২২)। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বেরুতেন না। আর খেজুর খেতেন বিজোড় সংখ্যায়।’ (বোখারি : ৯০০)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসুল (সা.)  ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়া: রাসুল (সা.) সবসময় ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তেন। মসজিদে আদায় করতেন না। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় (নামাজের জন্য) ঈদগাহে যেতেন।’ (বোখারি : ৯৫৬)। হেঁটে ঈদগাহে গমন: নবীজি (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার সময় কোনো বাহনে আরোহণ করতেন না; হেঁটে যেতেন, আবার হেঁটে ফিরে আসতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং হেঁটেই ফিরে আসতেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১২৯৫)। নবীজি (সা.)-এর অভ্যাস ছিল, যে রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যেতেন, সে রাস্তা দিয়ে ফিরতেন না; বরং অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ঈদগাহ থেকে ফেরার ক্ষেত্রে রাস্তা বদলাতেন।’ (বোখারি : ৯৮৬)।    
৩১ মার্চ, ২০২৪

বৈষম্যের দেয়াল পেরিয়ে ঈদের আনন্দ
ঈদকে বলা হয় সাম্যের উৎসব। ধনী-দরিদ্র এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের খবর কী, যারা বড় বড় মসজিদের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকে ধনীদের অনুকম্পার আশায়। খুব একটা যে পায় তা নয়, তবু আসে, আশায় আশায় থাকে। অনেকে প্রাইভেটকারে করে ঈদের জামাতে আসে, গাড়ির ড্রাইভাররাও শামিল হয়, কিন্তু ওইটুকু পর্যন্তই, জামাত হওয়ামাত্র ড্রাইভার যায় তার জায়গায়, মালিক বসেন আসনে। জামাতে ইমাম সাহেব বলেন, ঈদ হচ্ছে একতার উৎসব। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন। মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে সেই বাণী। কিন্তু বাইরে আসামাত্র দিবালোকের মতো যে সত্যের মুখোমুখি হতে হয় সেটা হলো অনৈক্য নয়, বিচ্ছিন্নতা। ঈদ এখন যে-সত্যটিকে উন্মোচিত করে দেয় সেটা হলো সমাজে বিদ্যমান অসাম্য। ব্যাপারটা এমন স্পষ্ট করে কম সময়েই এসে আমাদের ধাক্কা দেয়। মধ্যবিত্তের একাংশ ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বৃহদাংশ দেশের বাড়িতে ছোটে আপনজনের সান্নিধ্য পাবে বলে। গরিব মানুষ কী করবে ভেবে পায় না, নিতান্তই অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে তাদের চালচলনের দিকে। ঈদ আসলে বিত্তবানদেরই। কিন্তু তারাও ঈদে সামাজিক থাকে না, বিচ্ছিন্নই রয়ে যায়।  কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দাশ একদা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ জীবিত থাকলে ওই আক্ষেপোক্তি তাকে প্রত্যাহার করে নিতে হতো বৈকি; কারণ আমাদের ছেলেরা এখন কেবল কথায় নয় কাজেও যথেষ্ট সেয়ানা হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই। দুর্নীতিতে এবং বসবাসের অযোগ্য রাজধানী সৃষ্টিতে আমরা সাধারণত বিশ্বে শীর্ষস্থানের আশপাশেই থাকি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট বানিয়ে একেক সময় একেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী করে তোলে; এমনকি নিরীহ যে ছাপার ও লেখার কাগজ তাকেও মায়া করে না, তার দামও আকাশমুখো করে ছাড়ে।  একদা আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ব বলে আওয়াজ দিয়েছিলাম, সেটা ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রণধ্বনির অংশ; তারপর আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ দূরে থাক, গণতান্ত্রিক বাংলাও গড়ে তুলতে পারিনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আসা-যাওয়া করেছেন, নিজেদের তারা নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলেই জেনেছেন এবং জানিয়েছেনও; কিন্তু তাদের তৎপরতার কারণেই ওই স্বপ্নটা এখন আর নেই। এখন আমরা আধুনিক বাংলা গড়ার তালে আছি, ডিজিটাল স্তর পার হয়ে স্মার্ট স্তরে উন্নীত হতে আমাদের চেষ্টা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের এইসব বাংলার আসল ব্যাপারটা কী? সেটা তো এই যে, বাংলাদেশ পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে, আগে যেমন ছিল। এবং আগামীতে যে আরও অধিক পরিমাণেই পুঁজিবাদী ও অগণতান্ত্রিক হবে, সেটাও নিশ্চিত।  ঈদের ছুটিতে ধনীরা মফস্বলে যায় না এটা ঠিক, তবে পুরোনো এই শহরে যে থাকতে পছন্দ করে, তাও নয়। কেউ যায় সমুদ্রসৈকতে, কেউ খোঁজে রিভার রিসোর্ট, আরও যারা বিত্তবান তারা চলে যায় বিদেশে। কিন্তু আমরা যারা এসব কথা বলছি তারা কী চাই? আকাঙ্ক্ষাটা কী? না, আমরা বড় কিছু চাই না, চাই সামাজিকীকরণ। যেমন যানবাহনের তেমনি ঈদের মতো উৎসবেরও। আমরা চাই গ্রাম যেন মানুষকে আশ্রয়স্থল থেকে উৎপাটিত করে শহরের দিকে ঠেলে না দেয়। তার জন্য প্রয়োজন হবে কর্মসংস্থানের, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের। ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলা দরকার। নদী ও জলাশয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার চাই। চাই ফসলি বৃক্ষের সাহায্যে সামাজিক বনায়ন। চাইব আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি, যাতে গ্রামে থাকাটা বিপজ্জনক বলে ধারণা না হয়। দরকার মফস্বলে উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। চিকিৎসার উন্নয়নের জন্য আয়োজন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের। আমরা চাইব গ্রামকে শহরের দিকে টেনে না এনে শহর নিজেই গ্রামের দিকে রওনা দিক। এসব কাজ মোটেই ছোট নয়। অত্যন্ত বড় ও কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যে বিকেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলোর একটি। উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু উপজেলা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। কারণ ক্ষমতা কার কাছে কতটা থাকবে, ঠিক করা যায়নি। ক্ষমতা তো যাবে সাধারণ মানুষের কাছে, তা যাচ্ছে না। এমপিরা বিকেন্দ্রীকরণে সাহায্য করবেন কী, উল্টোটা ঘটাচ্ছেন। বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনকর্তা যে শাসকশ্রেণি তারা তো কিছুতেই চাইবে না যে, ক্ষমতা তাদের হাত থেকে জনগণের হাত চলে যাক। তাদের চেষ্টা ক্ষমতা যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে। ফেরিওয়ালা তার সম্পত্তি মাথায় করে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, সম্পত্তিবানরা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে চিন্তা দিয়ে মাথাভর্তি করে রাখবে।  এমন হাজার হাজার, লাখ লাখ নরনারী রয়েছে এই শহরে, যাদের জীবনে কোনো ছুটি নেই, ঈদ নেই। ছুটি নিলেই অনাহার। এরা পুঁজি যেটুকু আছে আঁকড়ে ধরে রাখে। কেননা জানে, যে কোনো মুহূর্তে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। গ্রামে যদি আশ্রয় থাকত তাহলে জীবন বিপন্ন করে হলেও সেখানে ছুটত, যেমন লাখ লাখ মানুষ ছুটেছে। কেননা গ্রামের ওই আশ্রয়ে জীবন আছে বলে তারা মনে করত। ছুটিতে ছুটতে ছুটতে পড়ি তো মরি হয়ে যারা দেশের বাড়িতে গেছে তাদের আবার ঠিক ওইভাবেই ফিরে আসতে হয়। সেই ঠেলাঠেলি ঠাসাঠাসি ধাক্কাধাক্কি—বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে। সেই ওষ্ঠাগত প্রাণ। সময়মতো না ফিরতে পারলে চাকরি যাবে। শহর থেকে বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছেছে আপনজন তখন ঈদের চাঁদ পেয়েছে হাতে। সুবাতাস বয়ে গেছে খুশির। কিন্তু তারাই, ওই আপনজনরাই আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যদি দেখে প্রিয়জনটির তাড়া নেই ঢাকায় ফিরবার। তাহলে কি চাকরি নেই? কোনো সর্বনাশ কি ঘটে গেছে, যে জন্য বাড়িতে ফিরে এসেছে, ফেরত যাবার জন্য উশখুশ করছে না? এবং তারা স্বস্তি পায় যখন দেখে প্রিয়জনটি আবার রওনা হয়েছে বান্ধবহীন সেই মরুভূমিতে, রাজধানীর সেই অনিশ্চিত শহরে। কিন্তু কেন এমটা ঘটল? ঘটার প্রধান করাণ হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের উন্নতি, যাতে একজন ফুলেফেঁপে ফুঁড়ে ফাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে খাড়াখাড়ি উঠে যায় ওপরের দিকে, আর অন্য দশজন সেই উন্নতির বোঝা বহন করতে গিয়ে নানা মাত্রায় অবনত হতে থাকে। এত লোক চলে যাবে, তবু রাজধানীতে যে লোকের অভাব হবে না, তার অর্থ ওই যে টেনে নেওয়া এবং ঠেলে বের করে দেওয়া এ ব্যাপারটা, পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এখন আওয়াজ উঠেছে যে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, তাতেও সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে ওই আমলাতন্ত্রেরই। আমলারা মনে করে তারাই সবচেয়ে স্মার্ট। রাজনীতিকদের তুলনায় তো অবশ্যই, ব্যবসায়ীদের তুলনাতেও। ওই স্মার্টরাই যদি ক্ষমতাধর ও আদর্শস্থানীয় হয় তাহলে অবস্থা যে আরও খারাপ হবে সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্তের সম্পাদক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি  
২৮ জুন, ২০২৩
X