ব্রাহ্মণপাড়ায় বিলুপ্তির পথে ঔষধি উদ্ভিদ তিতবেগুন
আদিকাল থেকেই মানুষের নানা রোগ নিরাময়ে সুখ্যাতি পাওয়া ভেষজ উদ্ভিদ তিতবেগুন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় বিলুপ্তির পথে। একসময় এই জনপদের সড়কের পাশে, পুকুরপাড়ে ও ঝোপঝাড়ে অহরহ দেখা গেলেও এখন আর উদ্ভিদটি তেমন একটা চোখেই পড়ে না। স্থানীয়রা মনে করছেন আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিকতার হাত ধরে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রসার ঘটায় ও ইউনানি চিকিৎসা থেকে মানুষ পিছিয়ে পড়ায় বিলুপ্ত হতে চলেছে ভেষজগুণ সমৃদ্ধ অন্যান্য উদ্ভিদের মতো এই উদ্ভিদটিও। জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নানা অসুখ-বিসুখে ভেষজ গাছ, উদ্ভিদ ও লতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ভেষজগুণ সমৃদ্ধ উদ্ভিদ তিতবেগুন। তিতবেগুন বা কাকমাচি সোলানাম গণের একটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ভেষজ এই উদ্ভিদটি মানবদেহের নানা রোগ নিরাময়ে আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এতে আদিকালের চিকিৎসাব্যবস্থায় পড়েছে ভাটা। যার ফলে ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ উদ্ভিদ তিতবেগুনসহ অন্যান্য ওষুধি উদ্ভিদ, গাছ ও লতা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে।  অথচ ইউনানি চিকিৎসকরা বলছেন গাছগাছালির মাধ্যমে দেওয়া চিকিৎসা ব্যবস্থাও এক ধরনের বিজ্ঞান। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এ চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে আধুনিক যুগের মানুষ দূরে সরে পড়ছে। যার ফলে প্রকৃতি থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ভেষজ উপকরণ। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে তিতবেগুন বা কাকমাচি মানবদেহের নানা রোগের উপশম দিতে সক্ষম। তিতবেগুনে রয়েছে প্রচুর পরমাণে ঔষধিগুণ। এই বেগুন কাঁচা বা রান্না করে খাওয়া যায়। শুধু এর ফল নয়, এই উদ্ভিদের সবুজ পাতা, ফল, বীজ ও শিকড় এবং ছাল সবকিছুতে রয়েছে ঔষধি গুণাগুণ। এটির পাতা ও গাছ কাঁটাযুক্ত। এর পাতা হালকা সবুজ সবুজ রঙের হয়ে থাকে। এটি সাধারণত ১থেকে ২মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল গফুর মুনসী কালবেলাকে বলেন, একসময় বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়ে, সড়কের পাশে ও পুকুর খালের ধারে তিতবেগুন গাছ সচরাচর দেখা যেত। বর্তমান সময়ে এই ঔষধি গাছটির তেমন একটা দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের মা-চাচিরা সে সময় আমাদের অসুখ-বিসুখ হলে তিতবেগুনসহ অন্যান্য ঔষধি গাছ ও তার পাতা ব্যবহার করে আমাদের সুস্থ করে তুলতো। তখনকার সময় আধুনিক চিকিৎসা এতটা সহজলভ্য ছিল না। বনাজি ওষুধের মাধ্যমেই নানা রোগের চিকিৎসা হতো। উপজেলার সদর ইউনিয়নের নন্দীপাড়া এলাকার কবিরাজ হরিপদ আচার্য কালবেলাকে বলেন, পূর্বপুরুষের হাত ধরে এ পেশায় এসেছি। আমি বংশপরম্পরায় পাওয়া এই পেশা এখনো আঁকড়ে ধরে রাখলেও আমার পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আগ্রহী নয়। আমার ছেলেবেলায় দেখেছি আমার বাবার কাছে অনেক রোগী আসত। এখন আর আগের মতো বনাজি চিকিৎসা নেওয়ার মতো রোগীও নেই। বনাজি ওষুধ তৈরি করার জন্য ঔষধি গাছেরও এখন স্বল্পতা। তবে আমার কিছু রোগী আছে যারা আমার কাছ থেকে নানা সমস্যায় চিকিৎসা নেয়। আমিও ওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা কালবেলাকে জানান, তিতবেগুন ভেষজ উদ্ভিদগুলোর অন্যতম একটি। এই উদ্ভিদটির কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। এটি ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত এক প্রকার উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদটির মধ্যে থাকা এ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এই উদ্ভিদটির ভেষজগুণ হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। এটি মানবদেহের আলসার নিরাময়ে কাজ করে। তিনি বলেন, তিতবেগুনের পাতা রস করে খেলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। মানবদেহের কৃমির সমস্যায় তিতবেগুন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নিয়মানুযায়ী এর পাতার রস সেবনে কৃমির বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি মেলে। তিতবেগুন উচ্চরক্তচাপ নিযন্ত্রণে প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে দারুণ কার্যকর। এতে আছে বিভিন্ন ধরনের অন্যন্য যৌগিক অ্যাসিড, ফেরুলিক অ্যাসিড। এতে রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটর। যার ফলে উচ্চরক্তচাপ নিযন্ত্রণ করে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। হাঁপানি (অ্যাজমা) বা শ্বাস কষ্ট রোগে তিতবেগুনের পাতা রস করে নিয়মমাফিক সেবন করলে এসব সমস্যা হতে উপশম মেলে। এ ছাড়া যৌন সমস্যায় এই উদ্ভিদের পাতা ও শেকড়ের রস নিয়মমতো সেবন করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, আমাদের চারপাশে নানারকম গাছ, উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম রয়েছে, এগুলোর মধ্যে ঔষধিগুণসম্পন্ন গাছ, উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম রয়েছে। ঔষধি গাছগুলো সাধারণ গাছ থেকে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে মূলত এদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, ভিটামিন, গ্লাইকোসাইড, ট্যানিল বা উদ্বায়ী পদার্থের উপস্থিতির কারণে। এসব ভেষজ উদ্ভিদ, লতা ও গাছ আমাদের শরীরের নানা রোগ নিরাময়ে আদিকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক সময়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসার অভূতপূর্ব প্রসারের ফলে আদিকাল থেকে চলে আসা ইউনানি চিকিৎসা থেকে মানুষ পিছিয়ে পড়েছে। যে কারণে আগের মতো এখন আর মানুষ ভেষজ উদ্ভিদ ও গাছের চারা রোপণ করে না, এমনকি এমনি এমনিতেই গজানো ভেষজ উদ্ভিদের পরিচর্যাও করে না। যার ফলে প্রকৃতি থেকে দিন দিন ভেষজ উপকরণ হারিয়ে যাচ্ছে।  ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন কালবেলাকে বলেন, এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থাও একটি ফলপ্রসূ চিকিৎসা ব্যবস্থা। যা বহুকাল আগে থেকেই এই অঞ্চল তথা সারাদেশে চলে আসছে।  তিনি বলেন, সরকারও ইউনানি চিকিৎসাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইউনানি চিকিৎসক ও ওষুধ সরবরাহ করেছে। এতে করে ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থাও এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো সমভাবে সমাদৃত হবে। তিনি আরও বলেন, আশার আলো হচ্ছে বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের ঔষধি গাছের সুষ্ঠু প্রয়োগ। দেশের শীর্ষ ওষুধ কোম্পানিগুলোও  ভেষজ ওষুধ উৎপন্ন করছে।
১৫ মার্চ, ২০২৪

বিলুপ্তির পথে ঔষধি উদ্ভিদ থানকুনি
প্রকৃতির সৃষ্টি নানা উদ্ভিদ ও গাছেই আছে বিভিন্ন রোগের ওষুধ। সেই আদিকাল থেকেই মানুষ এসব ভেষজ উদ্ভিদ ও গাছ ব্যবহার করে সুস্থ হয়েছেন নানা অসুখবিসুখ থেকে। এসব ঔষধি উদ্ভিদের মধ্যে ঔষধি গুণে ভরা থানকুনি পাতা মানবদেহের নানা ধরনের রোগে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। একটা সময় থানকুনি পাতার খুব কদর ছিল। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা এই পাতার খুব গুরুত্ব দিতেন। শরীর সুস্থ রাখতে এই পাতার জুড়ি নেই। নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে এর উপকার বলে শেষ করা যাবে না। অথচ এই আধুনিক চিকিৎসার সময়ে এসে অবহেলায় জর্জড়িত হয়ে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ঔষধি উদ্ভিদ থানকুনি। এটিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশে চাষের আওতায় আনার পরামর্শ স্থানীয় সচেতন মহলের।  ইউনানি চিকিৎসকরা বলছেন, থানকুনি পাতার রস খুবই উপকারী। তবে মধুর সঙ্গে থানকুনি পাতার রস মিশিয়ে খেলে কাশি এবং শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য অসুখ সারাতে সাহায্য করে। তুলসি ও গোল মরিচ দিয়ে থানকুনি পাতা খেলে তা ঠান্ডা এবং জ্বরও নিরাময় করে। গলাব্যথা এবং কাশি নিরাময়ের জন্য, থানকুনি পাতার রসের সঙ্গে সামান্য চিনি মিশিয়ে পান করুন। নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য থানকুনি পাতা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কোনোভাবে চোট পেলে কিংবা কেটে গেলে দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করতে থানকুনি পাতার কোনও জুড়ি নেই। থানকুনি পাতা বেটে কাটা জায়গায় লাগালে ব্যথা কম হবে আর রক্ত পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকের থ্রম্বোসিসের সমস্যা থাকে।  এ ছাড়াও অনেকের দেহেই অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে রক্তপ্রবাহে সমস্যা হয়। থানকুনি পাতার রস খেলে রক্ত শুদ্ধ থাকে। ফলে শরীরের প্রতি কোশে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে যায়। ফলে অনেক সমস্যার উপশম হয়। হাত ফুলে যাওয়া, পা ফুলে যাওয়া এসব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। থানকুনি পাতার মধ্যে থাকে নানা রকম খনিজ উপাদান, যা তাড়াতাড়ি রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। যে কারণে অনেক জটিল রোগ থেকে খুব দ্রুত উপকার পাওয়া যায়। আমাশয় থেকে আলসার সেরে যায় এই পাতার গুণেই। আর নিয়মিত থানকুনি পাতা খেলে হজমের সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। ক্রনিক আমাশয়ের ক্ষেত্রে খুবই ভালো থানকুনি পাতা।  মানসিক সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য খুব ভালো থানকুনি পাতার রস। থানকুনি স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মানসিক চাপ আর অস্থিরতা দুই কমে। এর ফলে অ্যাংজাইটির আশঙ্কাও কমে যায়। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতেও নিয়মিত থানকুনি পাতা খাওয়া শুরু করলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পেন্টাসাক্লিক ট্রিটারপেনস নামের একটি উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যে কারণে ব্রেনসেল ভালোভাবে কাজ করতে পারে। স্মৃতিশক্তির উন্নতি তো ঘটেই, সেই সঙ্গে বুদ্ধির ধারও বাড়ে চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় বাসিন্দা জুনাব আলী (৬৯) বলেন, ছোট বেলায় দেখেছি প্রায়ই থানকুনি পাতা দিয়ে ভর্তা, শাক ও তরকারি রান্না করা হতো। এতে আমাদের অসুখবিসুখ তেমন হতো না। সে সময় পথের ধারে, বাড়ির আঙিনায় ও জমিতে অহরহ থানকুনি গাছ দেখা যেতো। গ্রামীণ জনপদে এখন আর সে রকমভাবে এই ঔষধি গাছটি দেখা যায় না।  ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা কালবেলাকে বলেন, আমাদের দেশ থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ভেষজ এ উদ্ভিদটি। এটা পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। বিলুপ্তির পথে যেসব ভেষজ উদ্ভিদ ও গাছ সেগুলো সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এই সংরক্ষণের দায়িত্বটা আপামর বাঙালির। এই সংরক্ষণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে এবং মানুষের চিকিৎসায় এসব গাছ ও উদ্ভিদ কাজে আসবে। 
২৫ নভেম্বর, ২০২৩
X