২৪ কোটি মানুষ জানেন না তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
এ বছরের স্লোগান হচ্ছে—Diabetes : Know your risk, know your response. বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’। এ প্রতিপাদ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সম্প্রতিক তথ্যমতে, পৃথিবীতে প্রতি দশ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হয় এবং দুজন নতুন রোগী শনাক্ত হয়!
১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হবে। এর আরও একটি কারণ হলো, এই দিনে ফ্রেডরিক ব্যান্টিং জন্মগ্রহণ করেন। যিনি তার সহযোগী চার্লস বেল্টকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপক ম্যাকয়িডের গবেষণাগারে ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণের মহৌষধ ইনসুলিন আবিষ্কার করেন।
ডায়াবেটিক বর্তমানে একটি মহামারি রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এ রোগ সারা জীবনের। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। এ দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিক রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধির হার বেশি। ২০০৩ সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগী ছিল ১৯ কোটি। আগামী ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিদিন যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীদের নানা ধরনের জটিলতা। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিসকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, তা হচ্ছে—দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শারীরিক সক্রিয়তা কম এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ না করা।
ডায়াবেটিক মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগ, যা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার, সেইসঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। আইডিএফ ডায়াবেটিস অ্যাটলাস ডায়াবেটিসের বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায়—২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে ১ জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লাখেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সেই শিশু পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে।
বর্তমানে নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির এ হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে প্রতিবছর অসংখ্য মহিলা এর শিকার হচ্ছেন এবং ডায়াবেটিক নিয়ে শিশু জন্ম দিচ্ছেন অথবা নবজাতকের বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিচ্ছে। প্রতিটি অন্তঃসত্ত্বা মা যদি গর্ভধারণের আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সন্তান জন্ম দিতে পারেন তবে সন্তান সুস্থভাবে জন্ম দিতে পারবেন এবং মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা দিতে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা কেন্দ্র’ খোলা হয়েছে যেখানে নির্ধারিত সময়ে বিনামূল্যে গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ এবং স্বল্পমূল্যে গর্ভধারণসংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রসবকালীন নারী ও শিশুমৃত্যুর হার যেমন কমানো সম্ভব হবে, তেমনি নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে—
l কায়িক পরিশ্রম না করা
l মোটা বা স্থূলকায় হয়ে যাওয়া
l অতিমাত্রায় ফাস্টফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় (সফট ড্রিঙ্কস) পান করা
l অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকা
l ধূমপান করা ও তামাক (জর্দা, গুল, খৈনি, সাদাপাতা) খাওয়া
l গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যা
l যাদের বাবা-মা অথবা রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি তাদের হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই ডায়াবেটিস সমন্ধে তাদের অধিকতর সতর্ক থাকা দরকার।
l বয়স যদি ৪০-এর বেশি হয় এবং ওজন যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় কিংবা বংশে যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তবে অবশ্যই বছরে একবার এর পরীক্ষা করা প্রয়োজন এবং সেইসঙ্গে অন্তঃসত্ত্বারা নিশ্চিত করবেন তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কি না।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিমের অমর বাণী—‘প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগী যদি তিনটি D—Diet, Drug, Discipline অর্থাৎ পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং রক্ত পরীক্ষা ও নিয়মিত ব্যায়াম—এ তিনটি নীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মেনে চলেন, তাহলে তারা অবশ্যই স্বাভাবিকের কাছাকাছি, সামাজিকভাবে উপযোগী, সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন নির্বাহ করতে পারবেন।’
তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে তারা পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে তবে তাদেরও তা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রিন’ হওয়ার সম্ভাবণা পাঁচগুণ বেশি। তা ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’-এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।
যারা (বিশেষত মহিলারা) জর্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহার করেন তাদের মুখের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ঘা হতে পারে, যেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। নিয়মিত জর্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহারে ডায়াবেটিসের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না, ফলে মুখের ভেতরের বিভিন্ন রোগ বিশেষত মাড়ির রোগ ও মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। অতএব, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধে তামাক, জর্দা, গুল, সাদাপাতা এবং সেইসঙ্গে ধূমপান অবশ্যই বর্জন করা প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার হলে তা কখনো সারে না। তবে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারলে একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এজন্য যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের নেই, উভয়কেই প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। আরেকটি কথা, ৫০ শতাংশের বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য। আজ থেকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করুন। কেননা অঙ্গহানি, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। সামান্য উদ্যোগই রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে। প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।
লেখক : অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)
১৪ নভেম্বর, ২০২৩