জাতীয় পার্টি গৃহপালিত দল হয়ে গেছে : জিএম কাদের
জাতীয় পার্টি গৃহপালিত রাজনৈতিক দল হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি বলেন, আমরা পরজীবী হতে চাই, গৃহপালিত রাজনৈতিক দল নয়। ধারাবাহিকভাবে পরজীবী থেকে স্বনির্ভরতার দিকে যাব। শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এক অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি। জিএম কাদের বলেন, পরজীবী হয়ে আমরা অনেক কিছু করেছি। আমাদের একটা বড় দেনদরবার করার শক্তি ছিল। ২০১৪ সালের পর থেকে আমরা সেই শক্তি হারিয়েছি। আমরা এখন হয়ে গেছি গৃহপালিত রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনকে একটি বড় পরীক্ষা বলে মনে করছেন জিএম কাদের। এখন অনেকেই নানা কথা বলছেন নানাভাবে মূল্যায়ন করছেন। কিন্তু মূল্যায়নের জন্য এখনো সঠিক সময় আসেনি। অচিরেই মানুষ বুঝতে পারবে কেন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ। তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচনে দেখেছি রাজনীতি কতটা নোংরা হতে পারে। বৈষম্যকে দূর করতেই হয়েছিল ভাষা আন্দোলন কিন্তু বৈষম্য দিনকে দিন বেড়েই চলছে। বৈষম্যের অন্যায় এখনো হচ্ছে। বর্তমান সরকার বৈষম্য তৈরি করেছে আরও বেশি। একুশের চেতনা নিয়ে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে নয় স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করেছি। জিএম কাদের বলেন, আমরা যখনই স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে যাই তখন আমাদের মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়। সরকারই এমন করে। এর জন্য দায়ী আমাদের লোভ-লালসা। সমস্ত দলের নেতাদের জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতে হবে, সরকারি দলের নয়। যারা জাতীয় পার্টিতে থেকে অন্য দলের রাজনীতি করে তাদের বের করে দিতে হবে।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ডাক দিয়ে যাই / সংসদে স্বতন্ত্ররা কি গৃহপালিত থাকবেন
আগামীকাল ৩০ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। ব্যতিক্রমী এবারের সংসদে সবার চোখ থাকবে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ওপর। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। রেকর্ডসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী এবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এত অধিকসংখ্যক স্বতন্ত্র এমপি আগে কখনো নির্বাচিত হননি। যে ৬২ জন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তাদের ৫৮ জনই বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। নৌকা প্রতীক না পেয়ে ঈগল, ট্রাক ইত্যাদি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনের পর তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের পদপদবিতে বহাল আছেন। আওয়ামী লীগও কৌশলগত কারণে এসব বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। যেহেতু বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ নির্বাচন বর্জন করে, তাই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ এ কৌশল গ্রহণ করে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, নির্বাচন যেটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়েছে, তা স্বতন্ত্রদের অবদান। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছাড় না দিলে নির্বাচন হতো আরও একপেশে, বিবর্ণ। তাই ভোটের পরও ক্ষমতাসীনদের কাছে স্বতন্ত্রদের গুরুত্ব কমেনি। ২৮ জানুয়ারি গণভবনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। স্বতন্ত্র এমপি কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? তারা কি মুক্ত স্বাধীন হিসেবে সংসদে জনগণের কণ্ঠস্বর হবেন, নাকি একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগের গৃহপালিত হিসেবে সংসদে শুধু ক্ষমতাসীনদের বন্দনা করবেন; অথবা একটা মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকবেন? সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই পক্ষ থাকে। ট্রেজারি বেঞ্চ বা সরকারি দল এবং বিরোধী দল। সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই সংসদ পায় পূর্ণতা। সংসদে সরকারি দলের চেয়ে বিরোধীদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সংসদ কতটা কার্যকর, প্রাণবন্ত তা নির্ভর করে বিরোধী দল কতটা সক্রিয় তার ওপর। সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা করা বিরোধী দলের প্রধান কাজ। বিরোধী দল যত ভালোভাবে এ কাজটি করতে পারে, গণতন্ত্র তত বিকশিত হয়, শক্তিশালী হয়। বিরোধী দলহীন সংসদ অকার্যকর। এরকম সংসদ সরকারি দলকে বেপরোয়া করে। তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে যায়। এ প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য ভালো নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো গত দুটি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ও হতাশাজনক। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি কাগজে-কলমে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে ছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা ছিল সরকারের বাধ্যগত, গৃহপালিত। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এরশাদের ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দেননি রওশন এরশাদ। বেশ কিছু প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও শেষ পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে থাকে। এরশাদ নিজেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্তি, ব্যতিক্রমী ও বিরল ঘটনা। এ কারণে ২০১৪ সালের সরকারকে সর্বদলীয় জাতীয় সরকারও বলা যায়। নানা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে জাতীয় পার্টির নেতারা সংসদে সরকার বন্দনার প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হতে পারেনি। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পায় জাতীয় পার্টি। এবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে। জাতীয় পার্টি তো নয়ই, ১৪ দলের কোনো শরিককেও মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এ সময় জাতীয় পার্টির পোষা বিরোধী দলের কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা করে। সংসদে বিশেষ করে শেষদিকে তাদের সরকারের সমালোচনায় বেশ তৎপর দেখা যায়। এতে সংসদও খানিকটা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল বটে। কিন্তু তখনো জাতীয় পার্টির কারও কারও মধ্যে সরকারের গুণকীর্তন করে কিছু প্রাপ্তির চেষ্টা ছিল দৃশ্যমান। ফলে সাধারণ জনগণ জাতীয় পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দল ভাবতে পারেনি কখনো, বরং তারা অনুগত বিরোধী দল হিসেবেই পরিচিতি পায়। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ১৯৭৩-এর প্রায় বিরোধী দলশূন্য সংসদও দশম ও একাদশ সংসদের থেকে প্রাণবন্ত ছিল। হাতেগোনা কয়েকজন বিরোধী দলের সদস্যকে অবারিত সমালোচনার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ এবং কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। বিরোধীদের সমালোচনাকে তিনি স্বাগত জানাতেন। এরপর সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান হয়। সামরিক স্বৈরাচাররা সংসদকে রাবার স্ট্যাম্প বানায়। কিন্তু তারপরও ’৭৯ ও ’৮৬-এর সংসদ ছিল প্রাণবন্ত। বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং সক্রিয় অবস্থান ছিল দৃশ্যমান। সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আলোচিত হয়েছিলেন বেশ কজন পার্লামেন্টারিয়ান। কিন্তু ’৮৮ সালের এরশাদের সাজানো নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দল। এ সময় এরশাদ কাছে টানেন জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবকে। রবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ বা কপ। এই বিরোধী দলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’। আ স ম রব এরশাদ বন্দনায় তার নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকেই শুধু সংকটে ফেলেননি, সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাকেও হাস্যকর করেছেন। ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদগুলো ছিল প্রাণবন্ত, উত্তেজনাপূর্ণ। বিশেষ করে ’৯১-এর সংসদ সম্ভবত বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর সংসদ। বিরোধী দলে থেকেও আওয়ামী লীগ কোস্টগার্ড বিল পাস করিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে দেশে কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে প্রধানমন্ত্রীশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত প্রশ্ন, তার একটি বড় কারণ হলো অকার্যকর সংসদ। অনুগত বিরোধী দল। এবারের নির্বাচনে বিএনপি এবং তার মিত্রদের অংশগ্রহণ না করার ফলে আবারও একটি গুরুত্বহীন সংসদ গঠিত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা সংসদে সরকারের ন্যূনতম সমালোচনাও হবে না বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় অনেকেই একটি প্রাণবন্ত সংসদের আশায় বুক বেঁধে আছেন। সংসদে ন্যায্য কথা বলা হবে, দুর্নীতি অর্থ পাচারকারীদের স্বরূপ উন্মোচন হবে, ব্যর্থ এবং অযোগ্য মন্ত্রীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে, এমন প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বলতে শুরু করেছে। এরকম প্রত্যাশার কারণ, স্বতন্ত্রভাবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের কেউ কেউ জাতীয়ভাবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত। রীতিমতো সেলিব্রেটি। ব্যারিস্টার সুমনের কথাই ধরা যাক, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রিয় মুখ। জনগণ যেসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বিরক্ত; সেসব বিষয় নিয়ে তিনি গত কয়েক বছর কথা বলেছেন। অর্থ পাচার, দুর্নীতি নিয়ে তার বক্তব্য যেন সাধারণ মানুষের মনের কথার প্রকাশ। এবার তিনি স্বতন্ত্রভাবে এমপি হয়েছেন। তিনি শুধু তার নির্বাচনী এলাকাতেই পরিচিত মুখ নন, সারা দেশেও জনপ্রিয়। জাতীয় সংসদে এসব বিষয়ে তার শক্তিশালী অবস্থান দেখতে চায় দেশবাসী। এ. কে. আজাদ স্বতন্ত্রভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ব্যবসায়ী নেতা বহু আগেই। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হলেও লুটপাট, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই খোলামেলা কথা বলছেন। সংসদে তিনি এসব কথা বলবেন এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। মুজিবর রহমান চৌধুরী বা নিক্সন চৌধুরীও সরকারের ভেতরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী, দুর্নীতিকারী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এটা জনগণ চায়। এরকম বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব এবার নির্বাচনে নিজেদের জনপ্রিয়তায় জয়ী হয়েছেন। যাদের জনপ্রিয়তা শুধু তাদের নির্বাচনী এলাকায় নয়, সারা দেশে। জনগণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তারা জাতীয় সংসদে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। সংসদে স্বতন্ত্রদের অদ্ভুত এক সুবিধাজনক অবস্থান আছে। সংসদীয় গণতন্ত্র স্বতন্ত্র এমপিদের বলা হয় ‘গ্রে মেম্বার’। সাদা ও কালোর মাঝামাঝি যে অবস্থান তাকে বলা হয় গ্রে বা ধূসর। সেই ধূসর অবস্থানে থেকে স্বতন্ত্রদের যেমন সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারবেন, তেমনি সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা করতে পারবেন। এই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের শৃঙ্খলমুক্ত। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন দলীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য সংসদে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন না। তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। তিনি শৃঙ্খলিত। অথচ একজন ‘স্বতন্ত্র’ সংসদ সদস্য মুক্ত, স্বাধীন। এই স্বাধীনতার কি সঠিক প্রয়োগ করতে পারবেন স্বতন্ত্ররা? আমি জানি, যারা স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মনোনয়ন না পেয়ে নিজেদের যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে তারা নির্বাচন করেছিলেন। তাদের অনেকেরই লক্ষ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা। আগামী নির্বাচনে যেন তারা ‘নৌকা’ প্রতীক পান তা নিশ্চিত করা। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলে তাদের নড়বড়ে অবস্থান সংহত করা। এজন্য অনেকেই সংসদে আওয়ামী লীগেরই অংশ হিসেবে কাজ করতে চাইবেন। নির্বাচনের পর থেকে বেশিরভাগ স্বতন্ত্রের মধ্যে এই প্রবণতা দৃশ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে ‘নৌকা’র প্রতিপক্ষ হিসেবে; আওয়ামী লীগ হিসেবে নয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করেই স্বতন্ত্র জয়ী করেছেন ভোটাররা। তাই স্বতন্ত্ররা যদি আওয়ামী লীগের অনুগত এবং গৃহপালিত হন তাহলে সেটি হবে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। এর ফলে জাতীয় সংসদ হবে স্তাবকদের ক্লাব। অতি স্তুতি, চাটুকারিতা সরকারকে জবাবদিহিতা ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে। জনবিচ্ছিন্ন করবে। সংসদের প্রতিও জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। এই সরকারের বিগত ১৫ বছরে যেমন অনেক ভালো কাজ আছে, তেমনি আছে অনেক ব্যর্থতা। পৃথিবীর কোনো সরকারই সব কাজ ভালো করে না। দেশ চালালে ভালো-মন্দ দুটিই হবে। সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনার সব দরজা বন্ধ হলে তা হবে দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ক্ষমতাসীনদের জন্যও ভালো নয়। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট, খেলাপি ঋণ—এসব বিষয়ে সংসদে কথা বলা না হলে, সংসদ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। হারাবে কার্যকারিতা। আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগে সয়লাব এ সংসদ হবে চাটুকারদের প্রতিযোগিতা মঞ্চ। এর ফলে গণতন্ত্রবিরোধীরা, নির্বাচন বর্জনকারীরা সুযোগ পাবে। রাজনীতি সংসদ থেকে চলে যাবে রাজপথে। অথচ স্বতন্ত্ররা যদি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হন, নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি এবং মেধা দিয়ে পরিচালিত হন, তাহলে এই সংসদ একটি অনবদ্য সংসদ হতে পারে। সংসদ হতে পারে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। যারা স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যও স্বাধীন অবস্থান জরুরি। আমরা তো জানি, এই জাতীয় সংসদ বহু কিংবদন্তি পার্লামেন্টারিয়ান তৈরি করেছে। আসাদুজ্জামান খান, সুধাংশু শেখর হালদার, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রাজাকার সবুর খান, শাহ আজিজরা জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছেন সংসদের মাধ্যমে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে বক্তৃতা দিয়েই তারকা হয়ে ওঠেন আন্দালিব রহমান পার্থ। আর তারা কেউ ট্রেজারি বেঞ্চে থেকে দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হননি। বিরোধী দলে থেকে সরকারের সমালোচনা করেই তারা ‘তারকা’ হয়েছিলেন। এবার যারা স্বতন্ত্র এমপি হয়েছেন তাদের সামনে ‘তারকা’ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। সংসদে সত্য কথা বলে, ন্যায় দাবি তুলেই তারা জনগণের হৃদয় জয় করতে পারেন। তাহলে এই সংসদও হবে প্রাণবন্ত। জনগণের আস্থার প্রতীক। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সাফল্য বড় কৃতিত্ব যেমন স্বতন্ত্রদের, তেমনি এই সংসদ কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের ওপর। বাস্তবতা হলো, এই সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল ছাড়া সংসদ অপূর্ণ। জাতীয় সংসদে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কি এই অপূর্ণতার অন্ধকার ঘোচাবেন? জাতির কণ্ঠস্বর হবেন? এটা যদি তারা সাহস নিয়ে করেন, তাহলে লাভ হবে গণতন্ত্রের, আওয়ামী লীগ সরকারের। কিন্তু তারা যদি অনুগত আচরণ করেন, তাহলে সংকটে পড়বে গণতন্ত্র। লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত [email protected]
২৯ জানুয়ারি, ২০২৪
X