গনগনে চুয়াডাঙ্গা তাপের তীব্রতা আরও বাড়বে
টানা তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। সারা দিন রোদ আর প্রচণ্ড গরমে স্থবিরতা নেমে এসেছে কর্মজীবনেও। সূর্যের প্রখরতায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রচণ্ড ঘামে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কাজ করার জন্য দিনের যে সময়টা নির্ধারিত, সে সময়টাতে মানুষকে ঘরে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। কারণ বাইরে বের হলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। তা ছাড়া এই গরমে গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা হচ্ছে, ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে অনেকের গায়ে। বাধ্য হয়ে অনেকেই ঘরে বসে থাকছেন। গতকাল সোমবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিটস্ট্রোকে আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে গনগন করছে চুয়াডাঙ্গা। দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অতি তীব্র তাপপ্রবাহ আরও বাড়তে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা গত বছরের ১৭ এপ্রিলের সমান। ঢাকায় তাপমাত্রার পারদ উঠেছে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এ মৌসুমে ঢাকায় সর্বোচ্চ। এদিন যশোরে ৪২ দশমিক ৮, রাজশাহীতে ৪২ দশমিক ৬, পাবনায় ৪২ দশমিক ৫, খুলনায় ৪১ দশমিক ৮, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরায় ৪১ দশমিক ৫, বাগেরহাটে ৪১ দশমিক ৩, ফরিদপুরে ৪১ দশমিক ২, গোপালগঞ্জে ৪১, টাঙ্গাইলে ৪০ দশমিক ৮, দিনাজপুরে ৪০ দশমিক ১, বগুড়ায় ৪০ দশমিক ৬ ও নওগাঁয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
গত বছরের ১৭ এপ্রিলও পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। তার আগে ১৯৯৫ ও ২০০২ সালেও একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়, যা দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
ঢাকায় এ মৌসুমে গত ২০ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল তাপমাত্রা। আর গত বছরের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়েও চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রার গরম অনুভূত হচ্ছে। যে কারণে সাধারণের অস্বস্তিও বেশি।
আবহাওয়া অফিস জানায়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা ও রাজশাহী জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলাসহ বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া আজ মঙ্গলবার সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তিভাব বিরাজমান থাকতে পারে। আজ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
চলতি মৌসুমে টানা ৩০ দিন ধরে চলা তাপপ্রবাহ আরও কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে জানিয়ে আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, মে মাসের ২ তারিখ বা তার পরে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এলাকা বিশেষ করে ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সে সময় এসব এলাকার চলমান তাপপ্রবাহ প্রশমিত হবে। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে খুলনা, রাজশাহী অঞ্চলের চলমান তাপপ্রবাহ আরও অব্যাহত থাকবে। ৪-৫ তারিখের দিকে এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি জানান, এর আগে ২০১৪ সালে ৫-৩০ এপ্রিল টানা ২৬ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। ২০১৬ সালে ৬-৩০ এপ্রিল টানা ২৫ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। ২০২৩ সালে ১৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে টানা ২৩ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
এবার তাপপ্রবাহের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, সবসময়ই এসব এলাকায় তাপমাত্রা বেশি আসে, বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। কারণ এই এলাকাগুলো ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গের পাশে। ওইসব এলাকায় ৪৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠেছে রোববার, সেটার আঁচ এসে পড়ে এখানে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শেষ তিন দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত ও শীতের দিন কমছে, বছরের বড় অংশজুড়ে গরমের বিস্তার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে এপ্রিল মাস আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
হিটস্ট্রোকে ৬ মৃত্যু: কক্সবাজারের পেকুয়ায় গতকাল দুপুরে হিটস্ট্রোকে মোহাম্মদ কালু (৫০) নামে এক দিনমজুরের মৃত্যু হয়েছে। জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে মারা গেছেন বাবলু হোসেন (৫৫) নামে এক ভ্যানচালক। নরসিংদীর পলাশে ধান কাটার সময় গরমে অসুস্থ হয়ে মানিক মিয়া (৫০) নামে এক দিনমজুরের মৃত্যু হয়েছে। মানিক মিয়া লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বাসিন্দা। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে হিটস্ট্রোকে বাবলু খন্দকার (৪৫) নামে এক ভ্যানচালক মারা গেছেন। মৌলভীবাজারের আটঘর বাজারে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন নুরুল মিয়া (৫০) নামে এক দিনমজুর। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে মাটির রাস্তা সংস্কারের সময় হিটস্ট্রোকে লতিফা বেগম (৪০) নামে এক নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
৩০ এপ্রিল, ২০২৪