গোলটেবিল বৈঠক / জলবায়ু পরিবর্তন দেশের জন্য অস্তিত্বের সংকট
ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র (ডর্প), হেলভেটাস বাংলাদেশ ও কালবেলার যৌথ উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয় ছিল ‘জলবায়ু পরিবর্তনে পানি ও স্যানিটেশন’। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে এ ক্রোড়পত্র
সুপারিশ
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ন্যায্যতাভিত্তিক বাজেট বৃদ্ধি ও অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা।
টেকসই, লাগসই প্রযুক্তি এবং নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
আর্থিক প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা এবং মুজিব জলবায়ু প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় পানি ও স্যানিটেশনের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব আরোপ এবং সঠিকভাবে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা।
উপকূলীয় ১৯টি জেলায় বিশেষ করে লবণাক্ত অঞ্চলগুলোতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিরাপদ পানির জন্য বাজেট বৃদ্ধি এবং এসডিজি ৬ এবং ১৩ বাস্তবায়নে স্থানীয় পরিকল্পনা অগ্রাধিকার দিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প গ্রহণ করা।
প্রধান অতিথি
সাবের হোসেন চৌধুরী
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী
চলতি অর্থবছরে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জলবায়ু খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ নম্বর খাত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য। ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে শুধু এই জায়গায়। এখন এই বরাদ্দগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। কারণ আমরা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা জানি। আমাদের যে স্বাস্থ্য বাজেট রয়েছে, আমরা তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারি না। সুতরাং বাজেট বাড়ানোর থেকে যে বাজেট রয়েছে সেটা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোটাই বেশি জরুরি। আমাদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ, আমরা বাজেটের হিসাব করি শুধু কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো এবং কত টাকা আমরা খরচ করলাম এটুকুর মধ্যে। কিন্তু সেই খরচ করে তার ফলাফলটা কী, সেই অ্যাসেসমেন্ট আমরা করি না। আমরা যে খরচ করলাম, সেই খরচ অনুযায়ী আমাদের টার্গেট পূরণ হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখি না। সুতরাং আমাদের কোয়ানটিটিভ বাজেটে নয়, বরং কোয়ালিটিটিভ বাজেটে যেতে হবে। আমাদের ফলাফল মূল্যায়ন করতে হবে। ওয়াশ দিয়ে যদি আমরা সেই মূল্যায়নটা শুরু করতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের অনেক কাজে আসবে।
সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদের প্রায়োরিটি নিজেদেরই আইডেন্টিফাই করতে হবে। যদি আমাদের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শূন্যতা থাকে, তখন ডেভেলপমেন্ট পার্টনার বা কোম্পানিগুলো তাদের চিন্তাগুলো এখানে পুশ করবে। আমরা সেরকমটা চাই না। আমরা এডিবির বা বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প শুনতে চাই না। আমরা শুনতে চাই বাংলাদেশের প্রকল্প, যেখানে উন্নয়ন সহযোগীরা সহযোগিতা করছে। এটাই মূল বিষয় হওয়া উচিত।
আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০% কমিয়ে ফেলার টার্গেট করেছি। আপনারা বেনিফিট কস্ট রেশিওর বিষয়টি দেখতে পারেন। আমি যদি ওয়াশের জন্য ইনভেস্ট না করি, তাহলে কী দাঁড়াবে এবং আমি ইনভেস্ট করার পরে কী দাঁড়াবে। আমরা এখন পর্যন্ত ওয়াশের ক্ষেত্রে কোনো বেনিফিট কস্ট রেশিও করিনি।
আমাদের ৩৭ হাজার কোটি টাকা জলবায়ু বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার পানির উৎসগুলোকে এই অবকাঠামোর মধ্যে আনা যায় কি না, সেটা চিন্তা করতে হবে। আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাজেট বরাদ্দ রেখেছি ২.৫ হাজার কোটি টাকা। সেখানেও যদি আমরা এই অবকাঠামোর মধ্য নিয়ে আসতে পারি তাহলেও আমাদের জন্য একটি বড় প্লাস পয়েন্ট। এ ছাড়া অপারেশন এবং মেইনটেন্যান্স একটি বড় সমস্যা। এই বিষয়টাও আপনারা আপনাদের প্রস্তাবনার মধ্যে আনতে পারেন।
বিশেষ অতিথি
ফেরদৌস আহমেদ
সংসদ সদস্য
এদেশে পানি নিয়ে সমস্যা হবে, সেটা খুবই বিস্ময়কর একটি ব্যাপার। তার পরও এই সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে এবং এই সমস্যাটা আমরাই তৈরি করেছি। বাংলাদেশে কখনো আমরা ভাবতে পারিনি, আমরা ট্যাপ ওয়াটার খেতে পারব। ছোটবেলা থেকে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার অভ্যাস ছিল আমাদের। এর ফলে কী পরিমাণ গ্যাস নষ্ট হয়েছে সেই হিসাবও আমরা রাখিনি। বছরের পর বছর মাকে দেখেছি একটা আলাদা পাতিলের মধ্যে পানি সিদ্ধ করতে। অথচ আমরা যখন গ্রামে যেতাম তখন গভীর নলকূপের পানি খেতে ফোটানোর প্রয়োজন হতো না। এই বিষয়টা আমার কাছে খুবই অবাক লাগত।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যতটা সম্ভব বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা এবং যতটা সম্ভব ভূগর্ভস্থ পানি নষ্ট না করা। আমি মনে করি এটি অল্প সময়ের কাজ নয়, বরং একটি দীর্ঘ সময়ের এবং অভ্যাসের কাজ। যারা নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন বিষয়ে কাজ করছেন তাদের এই নিরলস কাজের ফলে আমরা আশা করি আমাদের সামনে একদিন সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।
ঢাকায় পানি ও স্যানিটেশনের সমস্যা বর্ষাকালে অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। বর্ষায় রাস্তায় পানি জমবে, পানি নিষ্কাশন না হয়ে আবদ্ধ থাকবে। অনেক জায়গায় খবর পাওয়া যাবে ওয়াশার পানির সঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশনের পানি মিশে গিয়ে বাড়িতে ব্যবহারের পানির ট্যাঙ্কে মিশে যাচ্ছে। ফলে নিরাপদ ট্যাপ ওয়াটারের নিশ্চয়তাও আমরা পাব না।
তুষার মোহন সাধু খাঁ
প্রধান প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
আমরা আমাদের পানিসম্পদের খুব সামান্য অংশই খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করি। ভূ-গর্ভ থেকে যে পানি উত্তোলন করে আমরা ব্যবহার করি, তার ৮০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষি এবং শিল্প খাতে। অথচ আমরা এই বিষয়টাকে উপেক্ষা করছি। আমরা শুধু বাসা-বাড়িতে ব্যবহারের এবং খাওয়ার পানি নিয়ে আলোচনা করি। আমি মনে করি, কৃষি এবং শিল্প খাতে যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানেও যাতে অপচয় না হয় সেই বিষয়টাকে নিশ্চিত করতে হবে। আর এর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব কেমন হয়, সেটা আমরা সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনা, বাগেরহাটসহ অন্যান্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় দেখেছি। সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ১৯ শতাংশ জায়গা ওয়াটার স্ট্রেস এরিয়া। এই ওয়াটার স্ট্রেস এরিয়াগুলো নিয়ে আলাদা একটি প্রকল্প নেওয়া রয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য আলাদা, চা-বাগান এলাকার জন্য আলাদা এবং আর্সেনিক এলাকাগুলোতে আলাদাভাবে এই প্রকল্পের আওতায় কাজ করা হচ্ছে। এর বাইরেও যেসব এলাকা রয়েছে সেসব এলাকায় শুধু খাওয়ার পানির জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এসব প্রকল্পের আওতায় আমরা কাজ করছি। আমাদের কাজের লক্ষ্য প্রতিটি বাড়িতে নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করা।
হাসিন জাহান
কান্ট্রি ডিরেক্টর
ওয়াটারএইড বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে পানির ওপর। আমরা জানি পানি একটি সীমিত সম্পদ। সুতরাং আমি মনে করি, পানিসম্পদ রক্ষা করা একটা বড় বিষয়। দুটি উপায়ে পানিসম্পদ রক্ষা করা যাবে। প্রথমত পানির অপচয় কমিয়ে। আর দ্বিতীয়ত পানির দূষণ কমিয়ে। এই দুটি বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সবার প্রথমে সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং বাজারে প্রবেশ বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ পানির উৎস নষ্ট করার জন্য সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি দায়ী। আমাদের কারখানাগুলো ঢালাওভাবে ইটিপি ব্যবহার করছে। এভাবে ঢালাওভাবে ইটিপি ব্যবহারের রাশ টেনে ধরা জরুরি। আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছি। ডিজিটালি এই বিষয়গুলো মনিটরিং করা খুবই সহজ। কারখানাগুলোতে ইটিপির ব্যবহার যদি রিয়েল টাইম মনিটরিং করা হয়, তাহলে ডিজিটালি আমরা বিষয়টাকে সমাধান করতে পারি।
মাহবুবুর রহমান
প্রকল্প সমন্বয়ক আইসিডিডিআর,বি
পানি দূষণ ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে হাইপারটেনশন, গর্ভাবস্থাজনিত জটিলতা, কলেরাসহ অন্যান্য রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে প্রতি এক মিনিটে দুজন রোগী ভর্তি হয়েছিল আইসিডিডিআর,বি কলেরা হসপিটালে। অথচ একটা সময় আমাদের দেশে কলেরা অনেক কমে গিয়েছিল। পানি দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য ডিপার্টমেন্টকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হবে। আমরা অনেকেই এখনো বুঝি না জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু কী, এর ক্ষতি কী এবং এর প্রভাব কীভাবে কমানো যাবে। আমরা জলবায়ু সম্পর্কিত অনেক পাইলট পলিসি এবং মিটিগেশন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছি। সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে কোন বিষয়গুলো ভালো কাজ করে সেগুলো স্কেলআপ করতে হবে এবং সর্বোপরি জনগণকে জলবায়ুর প্রভাব প্রশমনে কাজে লাগাতে হবে।
সন্তোষ শর্মা
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক কালবেলা
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, অবস্থান ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের সম্পদ ও পরিষেবার প্রচুর ক্ষতি হয়ে থাকে, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার মাধ্যমে তাদের এক ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন রকম প্রভাবের কারণে তাদের এই দুর্দশার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধরা হয়ে থাকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব যেসব দেশে ইতোমধ্যে পড়া শুরু হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দুর্যোগের কারণে যেসব অবকাঠামোর ক্ষতি হয় এর মধ্যে পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো বা সরবরাহ ব্যবস্থাগুলো অন্যতম। দেখা যায়, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে কোনো এলাকার টিউবওয়েলগুলো পানিতে তলিয়ে যায় কিংবা বন্যার পানিতে টিউবওয়েল বা পুকুরের পানি দূষিত হয়ে পড়ে, যার ফলে মানুষ অনিরাপদ পানি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ ল্যাট্রিন দুর্বল ও নিচুভাবে তৈরি হওয়ায় এগুলো খুব সহজেই ভেঙে পড়ে। এতে জনসাধারণ খোলা জায়গায় পয়ঃনিষ্কাশন করতে বাধ্য হয়।
ড. মাহফুজ কবির
গবেষণা পরিচালক বিআইআইএসএস
এসডিজি ৬ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে দুই বিলিয়নের বেশি মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। এবং তিন বিলিয়নের বেশি মানুষ সেফলি ম্যানেজ স্যানিটেশন থেকে বঞ্চিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘটা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানটা প্রায় একই রকম। এসব ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন প্রবেশগম্যতার এর ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হন প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ।
এর পাশাপাশি রয়েছে সোলো একটিং ডিজাস্টার। লবণাক্ততা এবং খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকায়ও মানুষ নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত।
একইসাথে হাত ধোয়ার বিষয়টিও পানি ও পয় পরিচ্ছন্নতার সাথে খুবই গুরুত্ব রয়েছে। এই বিষয়ে শহর অঞ্চলের থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে প্রায় সাত কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই হাত ধোয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যে সকল এলাকাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সে সকল জায়গায় নিরাপদ ব্যবস্থাকৃত পানির সুবিধা অনেকটা কম।
আমাদের আগামী বছরের বাজেট আসন্ন। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ একটি সময়ের দাবি। এবং বরাদ্দের ক্ষেত্রেও নিশ্চিত হওয়া দরকার যাতে এসডিজি বাস্তবায়ন সফল হয়।
ড. তানভীর আহমেদ
অধ্যাপক, বুয়েট
আমরা যখন বাজেটের ব্যয় নির্ধারণ করি সেখানে বড় শহর অর্থাৎ ধনীদের বসবাসের স্থানেই বাজেটের অধিকাংশ বরাদ্দ চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাজেটের বেশিরভাগ অংশ ধনীদের পেছনে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এর একটি কারণ হতে পারে বড় শহরগুলোর অবকাঠামো তৈরির খরচ গ্রামাঞ্চলের থেকে অনেক বেশি। পাশাপাশি আমাদের দেখতে হবে, শহরের অবকাঠামোগুলো প্রত্যন্ত এলাকার অবকাঠামোগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি জলবায়ু টেকসই হয়। আমার পরামর্শ থাকবে, আমরা যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জায়গায় ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন ডিজাইন করতে যাব, তখন যাতে এই অবকাঠামোটি জলবায়ু সহিষ্ণু অবকাঠামো হিসেবে ডিজাইন করা হয়। আমরা সব সময় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখি অবকাঠামোর ওপর। আমরা দেখি জলবায়ু পরিবর্তন ওয়াটার স্যানিটাইজেশনের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু এর বিপরীতমুখী দিকও রয়েছে। ওয়াটার স্যানিটাইজেশন জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, সেটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না।
মো. মাহমুদুল হাসান
পানি, খাদ্য ও জলবায়ুবিষয়ক ডোমেইন কো-অর্ডিনেটর, হেলভেটাস বাংলাদেশ
বাংলাদেশে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সমস্যার সব সমাধান এক রকম হবে না। দুটি হটস্পটে সমাধান দুই ধরনের হতে পারে। আমি যদি নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরকে উদাহরণ হিসেবে ধরি—দুই জায়গাতেই নিরাপদ বা সুপেয় পানির এবং স্যানিটেশন সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এই দুই জায়গার সমাধান ভিন্ন রকমের। গ্রামের দরিদ্র মানুষ টাকা দিয়ে পানি কিনে খাবে, এটা তাদের জন্য কঠিন। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় খাবার পানির সংকট প্রখর। পানি পাব কি না, সেটাই মানুষের দুশ্চিন্তা। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এখনো একটা পরিবারে দিনে এক কলসি খাবার পানি দিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হয়। পরের দিন গিয়ে আরেক কলসি পানি পাবে সেই পরিবার। নিরাপদ পানি পাওয়া সবার অধিকার। সেই জায়গা থেকে আমাদের অবশ্যই একটি কাস্টমাইজড ওয়াটার ক্যালেন্ডার থাকা দরকার। একই সঙ্গে আমরা যারা জলবায়ু নিয়ে কাজ করছি আমাদের ক্লাইমেট রেজিলেন্স নিয়েও ভাবতে হবে।
ড. মো. মুজিবুর রহমান
অধ্যাপক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আমরা সেফলি ম্যানেজ ওয়াটার অর্জন করেছি ৫৯ শতাংশ। ৩১-৩৯ শতাংশ পর্যন্ত অর্জন করেছি সেফলি ম্যানেজ সানিটেশন। কিন্তু আমরা যদি সেফলি ম্যানেজ ওয়াটার বা সেফলি ম্যানেজ স্যানিটেশনের ডেফিনেশন দেখি, তবে তার সঙ্গে আমাদের এই অর্জন কতটুকু যায়, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আমাদের প্রগ্রেস আসলে কতটুকু সেটা সত্যিকার অর্থে যাচাই করতে হবে। তা না হলে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। সেফলি ম্যানেজ স্যানিটেশন হলো পানির সব ধরনের অপচয় বোধ করা। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটা করতে পারিনি। তাহলে আমাদের সেফলি ম্যানেজ স্যানিটেশনটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে সেফলি ম্যানেজ ওয়াটার অর্থাৎ পানি সব ধরনের কেমিক্যাল থেকে মুক্ত থাকতে হবে। অথচ আমাদের দেশের নদীগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীর থেকে হয়তো সব থেকে বেশি দূষণ হয়। আমরা পানির প্রাপ্তি বা বাজেট অ্যালোকেশনের বিষয়ে যে বৈষম্যের কথা বলছি সেখানে মূল বিষয়টি হলো পানির প্রাপ্যতা। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে পানির প্রাপ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত তেমনি আমাদের ব্যবহার শৈলী ও ব্যাপকভাবে আমাদের এই পানির প্রাপ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এএইচএম নোমান
সিইও, ডর্প
জলবায়ু পরিবর্তনে পানি ও স্যানিটেশন শীর্ষক গোলটেবিলে আলোচনায় সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। ডরপ, হেলভেটাস ও কালবেলার যৌথ এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মূল্যবান সময় দেওয়ায় তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদকেও স্বাগত জানাই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রবন্ধ উপস্থাপক, সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তরসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার যেসব কর্মকর্তা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আলোচনায় উপস্থিত হয়েছেন তাদেরও জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
পার্থ হেফাজ সেখ
ডিরেক্টর, প্রোগ্রামস অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি ওয়াটারএইড বাংলাদেশ
ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ১০-১২ বছর ধরে বাজেট নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ জাতীয় বাজেটে ওয়াটার স্যানিটেশন এবং হাইজিনের জন্য কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করি। আমরা এখানে ডিস-ইনভেস্টমেন্ট বলব না, তবে গত ১০ বছরে এখানে ধারাবাহিকভাবে কম বিনিয়োগ দেখেছি। সরকারের ওয়াশ বাজেটের মাত্র ১-১.১ শতাংশ পৌঁছায় দুর্গম এলাকায়। আমরা সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো ন্যাশনাল ওয়াশ অ্যাকাউন্টস তৈরি করেছি। এখানে স্পষ্ট হয় বাংলাদেশের সব জনগণ মিলে এক বছরে কী পরিমাণ অর্থ ওয়াটার স্যানিটেশন এবং হাইজিনে খরচ করেছি। এই বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি, একজন ধনী মানুষ তার মাসিক আয়ের যে পরিমাণ অংশ পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিনে ব্যয় করেন, একজন দরিদ্র মানুষ তার থেকে বেশি রেশিওতে ব্যয় করেন। উদাহরণস্বরূপ একজন ধনী মানুষ তার আয়ের ৪ শতাংশের মতো ব্যয় করেন এখানে। অন্যদিকে একজন দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে এটা তার আয়ের ৭-৮ এমনকি ৯ শতাংশেও চলে যায়।
মোস্তাফিজুর রহমান
প্রোগ্রাম অফিসার, জলবায়ু ও পরিবেশ, সুইডিশ দূতাবাস
আমরা এখানে বাজেটের কথা বলছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের পানি যে একটি রিসোর্স, সেটাকে আমরা এখনো স্বীকার করি না। আমরা যারা পানি ব্যবহার করি, সবাইকে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। মূল্য পরিশোধ ছাড়া পানি পাওয়া যাবে না এই সেন্সটি তৈরি হওয়া দরকার। ওয়াশ ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে আমাদের এক ধরনের ইনোভেশনের দরকার রয়েছে। সারফেস ওয়াটার এবং অন্যান্য উৎসে আমরা কী ধরনের টেকনোলজি ব্যবহার করছি সেগুলো আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কতটা সঠিক সেখানেও কাজের সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের অবকাঠামো তৈরি কিন্তু সবাই সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। সেখানে প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়। এই দিকগুলো আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
ড. আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ
চিফ অপারেটিং অফিসার সিডব্লিউআইএস-এফএসএম সাপোর্ট সেল, ডিপিএইচই
আমরা খাওয়া এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উঠিয়ে ফেলছি। অনেক বেশি পরিমাণে পানি উঠিয়ে ফেলার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন মাটির যে গভীরে পানি পাওয়া যায় আর কয়েক বছর পর হয়তো এই গভীরতায় পানি পাওয়া যাবে না। এটাই বাস্তবতা। আমরা নদীর পানি ট্রিটমেন্ট করে খাওয়া এবং ব্যবহার উপযোগী করছি, কিন্তু বিপরীতে সেই লবণ উপাদান আবারও পার্শ্ববর্তী খাল বা নদীতেই ফেলছি। ফলে আদতে কোনো লাভ হচ্ছে না। আমি মনে করি বাজেট বাড়ানোই একমাত্র সল্যুশন নয়। আমরা স্যানিটেশনের জায়গায় একটি বিষয় মিস করে যাই। আমরা স্যানিটেশন টেকনোলজি চিন্তা করি ক্লাইমেট ফ্রেন্ডলি টেকনোলজি টয়লেটের দিকে রেখে। ফ্লাশ করা হোক বা পানি ব্যবহার করা হোক এখানে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল পরিষদ ডিপিএইচই মিউনিসিপালিটিতে যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়, সমন্বিতভাবে সেখানে এক টন সলিড ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট করলে প্রায় সাড়ে সাতশ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইডের এমিশন রোধ করতে পারি আমরা।
ড. মো. লিয়াকত আলী
পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, ব্র্যাক
আমরা যখন ওয়াটার স্যানিটেশনের প্রকল্পের কথা বলি বা আমাদের সফলতার কথা বলি, তখন শুধু পানির প্রজেক্টের কথা বলি। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের স্যানিটেশনের প্রজেক্ট নেই বললেই চলে। আমাদের চিন্তা করতে হবে ওয়াটার স্যানিটেশনের যে প্রজেক্টগুলো আসবে সেগুলো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত তা প্রমাণ করা। এটা প্রমাণ করা না গেলে বৈশ্বিক তহবিলের অর্থ প্রাপ্তি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। ওয়াটার স্যানিটেশন বিষয়টি অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকবে। কিন্তু অবশ্যই আমাদের লিংক করতে হবে কীভাবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমনে প্রথম যেটা প্রয়োজন, তা হলো ওয়াটার স্যানিটেশন। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমরা যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করি তারা স্টেটিক চিন্তা করব না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের হটস্পটগুলোতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্ট্রেস বৃদ্ধি পাচ্ছে, খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গ্রাউন্ড ওয়াটার শুকিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাকে সব ফিউচার প্রজেকশনগুলো মাথায় নিয়ে তারপর চিন্তা করতে হবে। পানিতে যদি ভর্তুকি দিতে হয়, তবে সেটা ওই স্ট্রেস এলাকায় দিতে হবে যেখানে ঢাকা শহরের থেকে ২০০ গুণ বেশি দামে মানুষকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান
উপনির্বাহী পরিচালক, ডর্প
পানি ও স্যানিটেশনকে জুলাই ২০১০ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এসডিজি-৬ এর টার্গেট অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল, বন্যা ও খরাপ্রবণ এলাকা এবং চর এলাকার মানুষ পানি ও স্যানিটেশন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। লবণাক্ততা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসডিজি অর্জনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সবা স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার ওপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় আমাদের আরও বেশি বাজেট বরাদ্দ, নীতিগত পরিবর্তন এবং কার্যকর প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজন।
রাবেয়া বেগম
নির্বাহী পরিচালক, এসডিএস
আমরা শরীয়তপুরে দেখেছি, একজন মানুষ তার বয়সের মধ্যে ১২-১৪ বার বাড়ি থেকে ডিসপ্লেসড হচ্ছে। ডিসপ্লেসড হয়ে যে এরিয়াগুলোতে তারা যাচ্ছে, সেখানে ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা পায় না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে এই ওয়াটার স্যানিটেশন এবং হাইজিন কোনো ধরনের সুবিধাই সেখানে থাকে না। চর এরিয়ায় বসবাসের জন্য সেখানে যে ধরনের ফেসিলিটিস থাকার কথা সেগুলো সেখানে থাকে না। এমনকি সরকারের ফিল্ড ওয়ার্কাররাও সেখানে নিয়মিত যান না। চর এবং কোস্টাল এলাকার মানুষের জন্য সরকারের সেফটিনের জন্য যে প্রোগ্রামগুলো থাকে সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। যারা নদীভাঙনের কারণে ডিসপ্লেসড হয়ে অন্য এরিয়াতে চলে যান, তারা নতুন এলাকার সেফটিনের সাপোর্টগুলোও পান না। এর কারণ তারা নতুন এলাকার ভোটার নন।
মো. সামছুদ্দোহা
প্রধান নির্বাহী, সিপিআরডি
আমাদের যে ডেভেলপমেন্ট স্ট্রেস রয়েছে সেটাও পানির ওপর বড় ধরনের ইম্প্যাক্ট তৈরি করছে। আমরা গ্রাউন্ড ওয়াটারকে অনেক বেশি ব্যবহার করছি। এর ফলে আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল কমে যাচ্ছে। কৃষি চাহিদা বাড়ছে এবং এর ফলে আমাদের পানির উৎস এবং সহজলভ্যতা কমে যাচ্ছে। আমরা কারখানার দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, যার ফলে পানির বিরাট উৎস নষ্ট হচ্ছে। আমরা শিল্প খাতে পানির টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি যে কারণে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি পরিমাণ পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। পানিকে শুধু এসডিজির টার্গেট হিসেবে না দেখে জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডেভেলপমেন্ট স্ট্রেস পানির যে সংকট তৈরি করবে সেটাকে দেখা। আমরা শুধু এটাকে এসডিজির মধ্যে রেখে দিলে চলবে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের পারসপেক্টিভকে বিশ্লেষণ করে আমাদের কিছু সলিড ইন্ডিকেটর প্রপোজ করতে হবে। ইন্ডিকেটরসগুলো কেমন হওয়া উচিত, তা আমরা ক্লাইমেট জাস্টিস অ্যালায়েন্স এবং নেটওয়ার্ক অব নেটওয়ার্ক থেকে একটি ধারণা প্রণয়ন করব।
অলোক মজুমদার
কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ ওয়াশ অ্যালায়েন্স
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত অত্যন্ত ভয়াবহ এবং আমাদের সবারই উচিত এটা নিয়ে চিন্তা করা। এসডিজি ৬.১ এ দেখা যায়, আমরা এখন পর্যন্ত নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন অর্জন করতে পেরেছি মাত্র ৫৯ শতাংশ। ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর আমাদের অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। সেই হিসাবে নিরাপদ পানির লক্ষ্য অর্জন করতে আমাদের এখনো ৪১ বছর সময় লাগবে। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন পৌঁছানোর লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনে আমাদের দরকার গতানুগতিক বলয় থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্নভাবে এগোনো। আর এখানে একটি বড় বিষয় হলো ফাইন্যান্সিং।
মোহাম্মদ মনিরুল আলম
ওয়াশ স্পেশালিস্ট
ইউনিসেফ বাংলাদেশ
আমাদের আলোচনায় বাজেটের কথা এসেছে। ২০১১-২০২৫ পর্যন্ত আমাদের একটি সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান রয়েছে। সেখানে একটি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানও রয়েছে। আর ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে উল্লেখ রয়েছে বাজেটের বিষয়টি। এরপর আমরা মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬-২০৪১ পর্যন্ত একটি প্ল্যান করছি। এটাকে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স প্ল্যান হিসেবে তৈরি করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা আইটি এবং বুয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশ যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা প্রশমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বরাদ্দ থাকছে। কৃষি, শিল্পসহ দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্যও আমরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছি। ওয়াটার স্যানিটেশনে কাজ করছে স্থানীয় সরকার। এসব কিছুর একটি সমন্বিত গভর্নেন্স দরকার।
শামীম আরেফিন
নির্বাহী পরিচালক, অ্যাওসেড, খুলনা
পানির জন্য আমরা বাজেট বরাদ্দের বিষয় নিয়ে কথা বলছি। বিগত দিনেও বাজেট বরাদ্দের কথাই বলেছি। টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে, নতুন টেকনোলজি আবিষ্কার হচ্ছে; কিন্তু আমরা পেরে উঠছি না। প্রশ্ন হলো এত টাকা খরচ করার পরও সংকট কেন তৈরি হলো? আমাদের যে বিষয়গুলো মাথায় নিতে হবে তা হলো পানি ও প্রতিবেশকে সুরক্ষা করা প্রয়োজন। এর জন্য আমাদের ট্রান্স বাউন্ডারি ইস্যুতে আমাদের নদী কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। উজানে মিঠাপানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় পানি সম্পর্কিত আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষিজমি আর অধিগ্রহণ করা যাবে না। উন্নয়নের নামে অধিগ্রহণ কমাতে হবে। চতুর্থত, আমাদের সব সারফেস ওয়াটারকে সংরক্ষণ করতে হবে। এই জায়গাগুলোতে আমরা যদি নজর দিতে না পারি তাহলে দেশের পানিব্যবস্থা ভেঙে পড়বেই।
আজহার আলী প্রামাণিক
পিকেএসএফ
দুর্যোগ, পরিবেশের যে ক্ষতি করে তার ফলে পানির মূল উৎস স্থায়ীভাবে নষ্ট বা দূষিত হয়ে যেতে পারে। ২০০৯ সালে আইলার জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের যে পানি ঢুকেছিল, তাতে বিরাট এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানিসহ সব পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। এই পানি এখন মানুষের ব্যবহার উপযোগী নয়। ওই এলাকার জনগোষ্ঠীকে এখন দূরবর্তী এলাকা থেকে পানি আনতে হচ্ছে। নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধিচর্চা মূলত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত। রোগব্যাধির ঝুঁকি থেকে মুক্তজীবন আর টেকসই জীবিকার জন্য এগুলো খুবই জরুরি। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে। তা ছাড়া নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধিচর্চায় ঘাটতি হলে নানাবিধ রোগের বিস্তার ঘটে, অসুখ-বিসুখে মানুষের কষ্ট বাড়ে, চিকিৎসার জন্য খরচ বাড়ে আর উৎপাদন কাজে শ্রম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে।
সার্বিক সহযোগিতায় :মো. আমির খসরু
উপ-পরিচালক, ডর্প
মো. আল জাবেদ সরকার
মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার, ডর্প
শ্রুতিলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম
আলোকচিত্রী : রনি বাউল
২৪ এপ্রিল, ২০২৪