তিন স্তরে জাল সনদ বেচতেন শামসুজ্জামান
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রধান কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ (সিস্টেম অ্যানালিস্ট) প্রকৌশলী এ কে এম শামসুজ্জামান জাল সনদ বিক্রি করতে দেশজুড়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে তিন ধরনের লোক জাল সনদ কিনত। শামসুজ্জামান নিজেই বোর্ডের বিশেষ সার্টিফিকেট পেপারে এই সনদ প্রিন্ট দিতেন এবং কম্পিউটারের সার্ভারে আপলোড করতেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে। ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে শামসুজ্জামানের চক্র অন্তত ৫ হাজার জাল সনদ বিক্রি এবং তা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্ভারে আপলোড করেছে। নির্বিঘ্নে এই অপকর্ম করতে অনেকটা কৌশলে কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান (ওএসডি) মো. আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকেও সিন্ডিকেটে ঢোকানো হয়। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার শামসুজ্জামানসহ ৫ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে মাকসুদুর রহমান মামুন ও সরদার গোলাম মোস্তফা গতকাল সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। রিমান্ডে রয়েছেন সেহেলা পারভীন। এদিকে জাল সনদ বিক্রি কান্ডে গোয়েন্দাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানকেও। আজ (মঙ্গলবার) তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। জাল সনদ বিক্রি এবং তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সামনে এলে গত রোববার আলী আকবরকে ওএসডি করা হয়। ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া) মশিউর রহমান বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করতেন। তবে ক্রেতারা দালালদের কাছে ন্যূনতম ২ লাখ টাকায় নিত। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে হাজার হাজার জাল সনদ বিক্রি হয়েছে। পুরো চক্রে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা, পরিচালক ও কর্মচারী রয়েছে। পুরো বিষয়টির তদন্ত চলছে। যারা ছিল জাল সনদ ক্রেতা: ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শামসুজ্জামানের চক্রটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু পরীক্ষা দেয়নি কখনো—এমন লোকজনের কাছে সনদ বিক্রি করত। এ ধরনের প্রতি সনদে অন্তত ২ লাখ টাকা করে নেওয়া হতো। এই চক্রের দ্বিতীয় ক্রেতা ছিল অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী। এরা পরীক্ষায় পাস করলেও সনদে নাম-ঠিকানা ভুল, রোল বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর ভুল ছিল। বৈধভাবে বোর্ড থেকে এসব সমস্যা সমাধানের নিয়ম থাকলেও হয়রানি এড়াতে শামসুজ্জামানের চক্রের কাছে যেত। এরপর টাকার বিনিময়ে এসব সংশোধন করে সার্ভারে আপলোড করতেন শামসুজ্জামান। এই কাজে অপেক্ষাকৃত টাকা কম লাগত। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় ধাপের ক্রেতা ছিল। এরা টাকার বিনিময়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সনদ কিনত। এই ক্রেতাদের মধ্যে অনেকে নিজের সনদের রেজাল্ট বদলে নিয়ে সনদ নিত। তৃতীয় ধাপের ক্রেতারা ছিল চাকরিজীবী। বিভিন্ন জেলা কোটায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে পরীক্ষার্থী ওই জেলার বাসিন্দা পরিচয়ে জাল সনদ বানিয়ে নিত। ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, এসব অপকর্মের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে অসাধু কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি অলিখিত কমিটি ছিল। তাদের এক বৈঠকের আলোচনার অডিও রেকর্ডও উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কাজ নেওয়ার কথা বলা হয়। একই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না নেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। এ সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সরাসরি সনদ কেনা শিক্ষার্থী কম। মূলত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, অধ্যক্ষ, কর্মকর্তা ও পরিচালকরা শিক্ষার্থীদের হয়ে এই কেনাকাটায় জড়িত ছিলেন। যেভাবে জড়ান বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী: কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীন দুদিনের রিমান্ডে রয়েছেন। রিমান্ডের প্রথম দিন ডিবিকে কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, কুষ্টিয়ার ‘গড়াই সার্ভে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের’ পরিচালক সানজিদা আক্তার কলির খপ্পরে পড়েন তিনি। বছরখানেক আগে সানজিদার সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর থেকেই সানজিদা তাকে বুটিকের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসার টোপ দেন। এভাবে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি ৩ লাখ টাকা ধার নেন সানজিদার কাছ থেকে। সেই সুযোগে সানজিদা তাকে বোর্ডের (সিস্টেম অ্যানালিস্ট) প্রকৌশলী এ কে এম শামসুজ্জামানের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখন এই শামসুজ্জামান তাকে টাকা দিয়ে বোর্ড থেকে নানা সুবিধা চান। সেহেলা পারভীনকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গত ১৩ এপ্রিল সেহেলা পারভীনের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের খরচ মেটাতে তিনি পূর্ব পরিচিত সানজিদার কাছে তিন লাখ টাকা ধার নেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন। সেই টাকা শামসুজ্জামান পৌঁছে দেন। এরপর এই ব্যক্তি টাকা দিয়ে তার চাকরির পদোন্নতি ও বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তে মুক্তি পেতে সহযোগিতা চান। সহায়তার আশ্বাসও দেন সেহেলা পারভীন। ওই কর্মকর্তা বলেন, সেহেলার জাল সনদ বিক্রিতে এখনো সরাসরি সম্পৃক্ততা মেলেনি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সনদ বাণিজ্যে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। এ ছাড়া এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে, পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা: এদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রধান সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামানের বয়ানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক ও বর্তমান দুই কর্মকর্তার নাম এসেছে। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে ওই ব্যক্তি দাবি করেছেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক আলী আকবর তাকে নোটিশ দেন ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর পর মামলা থেকে রেহাই পেতে তিনি দুদকের আরেক উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় আবু বকর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করার কথা জানিয়ে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেন। শামসুজ্জামান টাকা দিলে তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে গোলাম মাওলা নামে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পরে ওই তদন্ত কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সময় ১৮ লাখ টাকা নেন তার কাছ থেকে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি প্রতিবেদন দিয়ে গোলাম মাওলা আরও ১০ লাখ টাকা নেন। তবে উপপরিচালক আবু বকরকে ডলারে রূপান্তর করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এই দুই কর্মকর্তার নাম গণমাধ্যমে আসার পর গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়Ñ বিষয়টি কমিশনের গোচরীভূত হয়েছে। সত্যতা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য একজন পরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য ভিন্ন একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদক কর্মকর্তা আবু বকর চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি অবসরে গেছেন। উপপরিচালক গোলাম মাওলা দুদকের পিরোজপুর কার্যালয়ে কর্মরত।
২৩ এপ্রিল, ২০২৪

মেহেরপুরে জাল সনদ দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা
জাল সনদ প্রদানের অভিযোগ তুলে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহা. আলম হুসাইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ইসমোতারা নামে ভুক্তভোগী এক নারী।  সোমবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে মেহেরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে হাজির বাদী ইসমোতারা এ মামলা দায়ের করেন। বাদী ইসমোতারা একই ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রামের বজলুর রহমানের মেয়ে।  মামলার এজাহারে বাদী অভিযোগ করেছেন, কাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এলাকার ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। বাদীর স্বামী মজনুর রহমান কুষ্টিয়া দৌলতপুর উপজেলার গোয়ালগ্রামের আব্দুল্লাহর ছেলে। বিনা অনুমতিতে সুমাইয়া খাতুন নামের আর এক নারীকে দ্বিতীয় বিবাহ করলে বাদী মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি মামলা দায়ের করেন, যা বিচারাধীন। বাদী গত বছরের ২ আগস্ট চেয়ারম্যানে নিকট গিয়ে তালাকের নোটিশ সম্পর্কে অনুসন্ধান করলে চেয়ারম্যান বাদীর স্বামীর কোনো নোটিশ পাননি বলে জানিয়ে একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল নোটিশ পেয়েছেন উল্লেখ করে ২৫ মে একটি জাল, ভুয়া ও পণবিহীন প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। কিন্তু ওই গ্রহণের তারিখের কোনো রেজিস্টারভুক্ত করা হয়নি। ওই নোটিশ বাদীর স্বামী মামলায় ব্যবহার করছেন, ফলে বাদী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাদী আরও অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যানকে জাল, ভুয়া, প্রত্যয়নপত্র দাখিলের কারণ জিজ্ঞাসা করলে আসামি কোনো কারণ ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদীকে অপমান করে কার্যালয় থেকে বের করে দেন।
০৬ নভেম্বর, ২০২৩

জাল সনদ বিক্রি, গ্রেপ্তার ব্যবসায়ী
গাজীপুরে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও শিক্ষা বোর্ডের সনদপত্র তৈরির অভিযোগে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১। গত শনিবার রাতে বাসন থানার চৌরাস্তা এলাকা থেকে সজীবুল আলম (৩০) নামে এ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল রোববার র‌্যাব-১-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. পারভেজ রানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গ্রেপ্তার সজীবুল আলমের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা নাসির সুপার মার্কেটের সাউদা অনলাইন জোন নামের একটি দোকানে কম্পিউটার কম্পোজ, ডিজাইন, কালার প্রিন্ট, ছবি প্রিন্ট ইত্যাদি ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে অবৈধভাবে ডিজিটাল মাধ্যম (কম্পিউটার) ব্যবহার করে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ও জাল শিক্ষা বোর্ডের সনদপত্র তৈরি করে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সরবরাহ করে আসছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ভুয়া এসএসসি পাসের সনদপত্র, সিপিইউ, হার্ড ডিক্স, মনিটর, স্ক্যানার, ইউপিএস উদ্ধার করা হয়।
১৪ আগস্ট, ২০২৩
X