ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু কারও কারও কাছে এটি একটি বিদেশি ভাষা। বাংলা যখন বিদেশি ভাষা, তখন এর নাম হয় বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা (Bangla as Foreign Language)। বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা সম্পর্কে এ দেশে কোনো ধারণাগত কাঠামো গড়ে উঠেনি। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নিজস্ব ধারায় বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহার চলছে এবং বিদেশি জ্ঞানরাজ্যের (academia) একটি ধারণাগত কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি না থাকায় দেশাভ্যন্তরে এর কোনো ধারণাগত কাঠামো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চা চলছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্য অন্যতম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশস্থ বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট, ব্র্যাক ভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানেও বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।  প্রসঙ্গত, বিষয়টি আরেকটু সবিস্তারে আলোচনা করা যাক। কোনো ভাষা স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে ধ্রুপদী ভাষা, জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা, তৃতীয় ভাষা, ঐতিহ্য ভাষা, বিদেশি ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত হতে পারে। পৃথিবীর লাখ লাখ বুলির মধ্যে কিছুসংখ্যক বুলিই এই সবগুলো বিশেষণ লাভ করেছে। বাংলা ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক ভাষা-পরিস্থিতিতে উপরোক্ত সবগুলো অভিধা লাভ করেছে। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা।  আবার এ ভাষা বম, চাক, চাকমা, কোচ, গারো, হাজং, খাসিয়া, খিয়াং, খুমি, লুসাই, মাহাতো, মারমা, মণিপুরী, মুন্ডা, মুরুং, ম্রো, পাহাড়ি, পাংখো, রাজবংশী, রাখাইন, সাঁওতাল, তঞ্চঙ্গ্যা, টিপরা ও ওঁরাও ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা।  অন্যদিকে বিদেশে অভিবাসিত বাংলা ভাষাভাষীদের নতুন প্রজন্মের কাছে এটি একটি ঐতিহ্য ভাষা।  উল্লেখযোগ্য যে, বিপুলসংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের মাধ্যমে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। সেখানে তারা সমাজবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। বিদেশে অভিবাসিত বাংলা ভাষাভাষী সমাজের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের যুব জনগোষ্ঠীর কাছে এটি হলো ঐতিহ্য ভাষা।  অন্যদিকে বাংলা ভাষা বাংলাদেশে জাতীয় ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে বিধায় এটি আন্তর্জাতিক ভাষার অভিধা লাভ করেছে। সম্প্রতি ভারতের বিদ্যোৎসাহী শ্রেণি বাংলা ভাষার সাহিত্য সম্ভার, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবি তুলছে। বাংলাদেশ ও ভারতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ভিন্ন হলেও, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্য বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর রয়েছে।  উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ভাষা শহীদ দিবসের দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়।  এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুন যথাক্রমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভা বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উপস্থাপনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা কর্তৃক একযোগে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে চালু করার দাবির বিষয়টি ইঙ্গিত করে যে-বাংলা ভাষা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠার মতো একটি প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা রয়েছে।  এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলা ভাষা মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার মানদণ্ডে যুগপৎভাবে ধ্রুপদী ভাষা, জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা, তৃতীয় ভাষা, ঐতিহ্য ভাষা, বিদেশি ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষারই একইসঙ্গে এতোগুলো অভিধা জোটেনি। আমাদের আশপাশের দেশের ভাষাগুলো সম্পর্কে এমন উদাহরণ সত্য।  হিন্দি ভাষা ভারতের দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু এটি ভারতের জাতীয় বা রাষ্ট্র ভাষা নয়। আবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণ হিন্দিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিক পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলেও, এটি পাকিস্তানের ভাষা নয়। এটি মূলত ভারতের মুসলমানদের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা। ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার কোনো জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা নেই। এর দাপ্তরিক ভাষা হলো ইন্দনেশীয় ভাষা। ইন্দোনেশীয় ভাষা মূলত: মালয় ভাষারই একটি ভিন্নরূপ। সে হিসাবে এটি ইন্দোনেশিয়ার নানান ভাষাভাষী জনগণের জন্য একটি বহিরাগত ভাষা।  বাংলা ভাষার এতোগুলো অভিধা জুটলেও, খোদ বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ চলছে। কিন্তু বাংলা ভাষার যে প্রচ্ছন্ন শক্তি রয়েছে, সে শক্তিই যেন এই ভাষাকে বিদেশি ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ভাষা বিজ্ঞানী কাই চান (২০১৬) তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কোনো ভাষার বিদেশি ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কয়েকটি সূচকের ওপর। সে সূচকগুল হলো কোনো নির্দিষ্ট ভাষার আঞ্চলিক বিস্তৃতি, অর্থনীতি, সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে কার্যকারিতা, জ্ঞান ও গণমাধ্যমে ভাষা হিসাবে ব্যবহারের বিস্তৃতি ও সেই ভাষা সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা ইত্যাদি। তার প্রস্তাবিত এই সূচকগুলো বিবেচনায় নিলে বাংলা ভাষার যৎসামান্য হলেও ভাষিক সক্ষমতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সে জন্য বিশ্বের নানাদেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও গবেষণা চলছে। তারমধ্যে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো চীনস্থ গুয়াংঝু বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানস্থ টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন চলছে।   যে কোনো দেশই তার জাতীয় ভাষাকে ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতিরূপস্বরূপ বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সেই উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। এমনকি জাতীয় এই ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেই। আবার ভারতের পক্ষে এই ভাষাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়। কারণ, ভারতে বাংলাদেশের মতো বাংলা ভাষার মর্যাদা সমান নয়। কারণ ভারত প্রজাতন্ত্র যুক্তরাজ্যীয় ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্র, যার দাপ্তরিক ভাষা হলো ইংরেজি ও হিন্দি। কাজেই লক্ষণীয় যে, ভারতের ভাষা-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার চেয়ে নিম্নে।  সুতরাং বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ সরকারের ওপর। এই দায়িত্বকে অবহেলা করা মানে বাংলা ভাষাকেই অবহেলা করা। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের দায় ও দায়িত্ব হবে, বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট প্রণয়ন করা। উদ্দিষ্ট এই ভাষানীতি বাস্তবায়নে যেসব ভাষা-পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন তা হলো:  ১)বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ নামক একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। ২)বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে (উদাহরণস্বরূপ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট) বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের সুবিধার্থে গবেষক (research fellow) ও অভ্যাগত অধ্যাপক (visiting professor) পদ সৃষ্টি করে তাদের বৃত্তিসহ আমন্ত্রণ জানানো।  ৩)বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে বাংলা ভাষা শিক্ষা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪) বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শীত ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির সাথে মিল রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা ভাষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য তিন সপ্তাহব্যাপী শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন আবাসিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।  ৫) বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা হলে, তা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা।  লেখক: অধ্যাপক ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির, পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;  ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়  ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
২৬ এপ্রিল, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম / বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন
গত ১ জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। এই বাজেটে শিক্ষা খাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এই অর্থের বেশিরভাগই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মূলধারার শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা—এই ধারার শিক্ষায় ব্যয় করা হবে।  শিক্ষা খাতে ব্যয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশে যুগোপযোগী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক মানবসম্পদ বা মানবিক পুঁজি গড়ে তোলা। কারণ দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেমন আর্থিক পুঁজি প্রয়োজন; ঠিক তেমনিভাবে মানবিক পুঁজিরও প্রয়োজন। অর্থাৎ যতই আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ করা হোক না কেন, কোনো বাণিজ্যিক, শিল্প বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যদি জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানবিক সম্পদ কাজ না করে তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আর্থিক পুঁজি বিনিয়োগ থেকে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অভীষ্ট সুফল পাওয়া যায়? উত্তর হলো—না। কারণ জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগকৃত অর্থের অধিকাংশই অপব্যয় ও অপচয় হয়ে থাকে। এই অপব্যয় ও অপচয় সবচেয়ে বেশি হয়ে থেকে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায়। এর প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে নীতিবিবর্জিত শিক্ষানীতি, ভুল ইংরেজি শিক্ষা পরিকল্পনা ও শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রশাসনের বিমুখতা এবং ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়োজিত শিক্ষক-প্রশিক্ষকদের সঠিক শিক্ষাদানে অদক্ষতা ও অনীহা। কিন্তু দেশে মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক একটি সুষ্ঠু ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা পরিকল্পনা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা মেরামতে হাত দিতে হবে। আর মানবিক পুঁজি গঠনে সহায়ক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে দেশে কথিত অন্যান্য ভাষা শিক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এসব ভাষার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষা। কারণ একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভাষিক উন্নয়ন অপরিহার্য। যে কারণে ভাষা বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও ফার্সি ইত্যাদি ধ্রুপদি ভাষা, ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগত ভাষার ভাষিক উন্নয়নকে বাদ দিয়ে শুধু ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের সার্বিক ভাষিক উন্নয়নের জন্য একটি সর্বাত্মক ভাষানীতি প্রয়োজন। বিদেশি ভাষার ভাষিক উন্নয়নেও ভাষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। সে জন্য বিদেশি ভাষার বাস্তব প্রায়োগিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে সাময়িকভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।   বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে প্রথমেই প্রশ্ন আসবে, কোন ভাষাগুলো বিদেশি এবং বিদেশি ভাষার মধ্যে কোনগুলোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সমসাময়িককালে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রজোটের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিবেচনায় বিদেশি ভাষা শিক্ষার এই সুযোগ সৃষ্টি করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশ স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং জনশক্তি রপ্তানিতে তৎপর রয়েছে। এই কাজে সরাসরি যুক্ত রয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শিল্পোন্নত ও বিত্তশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দ্বিপক্ষীয় সভায় সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে নিয়মিত দেনদরবার করে থাকে। বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আরব ভাষাভাষী অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, পূর্ব এশিয়ার জাপান ও কোরিয়া এবং ইউরোপের ইতালি ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করছে। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করতে আগ্রহী দেশসমূহে অদক্ষ থেকে শুরু করে অর্ধদক্ষ ও দাপ্তরিক কাজে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের কর্মীদেরই ভাষাগত দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ভাষাগত দক্ষতা মানবিক পুঁজির নিয়ামক বিশেষ। জনশক্তি আমদানিকারক দেশসমূহের চাহিদা বিবেচনায় এখন দেশে যেসব বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তার অন্যতম হলো আরবি, মালয়, জাপানি, কোরীয় ও ইতালীয় ইত্যাদি। উল্লিখিত বিদেশি ভাষাগুলো ছাড়াও আরও কিছু বিদেশি ভাষা শিক্ষার চাহিদা রয়েছে। কারণ দেশের যুবসমাজ এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। সেসব দেশে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সংজ্ঞাপনে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া দেশেও কোনো কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বিদেশে ও দেশে কর্মসংস্থানের জন্য আর যেসব বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো চীনা, ফরাসি, স্পেনীয়, তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও গ্রিক ইত্যাদি। এটি এখন বাস্তবতা যে, দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে দেশজুড়ে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এই শিক্ষার অনিয়মিত ও অপরিকল্পিত বিস্তার ঘটছে। যার ফলে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, যার অন্যতম হলো : i) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসমূহ ii) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ (যেখানে ১/২টি কোর্সের মাধ্যমে সীমিত পর্যায়ে বিদেশি ভাষার পাঠদান করা হয়) iii) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়াধীন একাডেমিসমূহ iv) শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ v) জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ vi) বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মিশন পরিচালিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহে vii) English Medium School সমূহ viii) বিভিন্ন শহরে বা বাজারে অবস্থিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ  বৈদেশিক কর্মসংস্থানের কারণে দেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা উপরোল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিপূরণ হচ্ছে না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সঠিক নয়। কিন্তু বিদেশে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা বেশি এবং তদানুসারেও মাসিক বেতন-ভাতাও বেশি হয়ে থাকে। প্রত্যেক বিদেশগামী কর্মীর ভেতন-ভাতা যথেষ্ট হলে, তার অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফেরত আসে। দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় এবং বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অবদান বিবেচনায় দেশে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষার সুযোগ ও সুবিধা বৃদ্ধি করতে হলে ওই বিদেশি শিক্ষাকার্যক্রমে ব্যাপৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এই উন্নয়নে অর্থ প্রয়োজন। এই দেশব্যাপী পরিব্যাপ্ত শিক্ষাকার্যক্রমের অর্থের জোগান জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই শিক্ষা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয়, কোনো ব্যক্তি ও সংস্থা কর্তৃক মেটানো সম্ভব নয়। জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলে, দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশগামী মানুষ বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরিপ্রাপ্তিতে প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে। তৎপরবর্তী সময়ে বিদেশে কর্মসংস্থান হলে সেসব মানুষ দেশে উচ্চহারে রেমিট্যান্স পাঠাতে সক্ষম হবে। ফলে জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থের কয়েক গুণ লাভ হিসেবে ফিরে আসবে। দেশের সার্বিক জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ঘটবে। এভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রচুর লাভ হিসেবে দেশের মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। কাজেই চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় শিক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে দেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষা উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির : অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ। পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট। ভূতপূর্ব অভ্যাগত শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়
২৪ জুন, ২০২৩
X