খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণের আহ্বান প্রধান বিচারপতির
খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। শুক্রবার (৩ মে) সকাল ১০টায় মৌলভীবাজার জেলা সফরের অংশ হিসেবে শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানে বিলুপ্তপ্রায় খাড়িয়া ভাষায় কথা বলা শেষ দুই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সরকারকে এ আহ্বান জানান তিনি।   প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কিন্তু অনেকের মাতৃভাষা ভিন্ন। ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে আরও জোরারোপ করা প্রয়োজন। ভারতের যেসব  অঞ্চলে এ ভাষার প্রচলন আছে, সেখানে যোগাযোগ স্থাপন করে খাড়িয়া বর্ণমালা প্রচলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এ ভাষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি। খাড়িয়া ভাষায় কথা বলা মাত্র দুই ব্যক্তি অবশিষ্ট আছেন বাংলাদেশে, যারা সম্পর্কে দুই বোন। এদের নাম ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা ও ভেরোনিকা কেরকেট্টা। ভারতের রাঁচি থেকে তাদের বাবা মা বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারতের ঝাড়খণ্ড এবং উড়িষ্যায় খাড়িয়া ভাষার প্রচলন আছে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় কুশিয়ারা আন্তর্জাতিক কনভেনশন হলে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তৃতায়ও খাড়িয়া ভাষা ও নাগরী লিপি সংরক্ষণের আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি।
০৩ মে, ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা
এক শ্রেণির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষার নাম সাদ্রি। তাদের ছেলে-মেয়েরা নিজস্ব ভাষায় তেমন কথা বলতে পারে না। একাডেমিক বা বই পুস্তকের মাধ্যমে শেখা হয় না সেই ভাষা। তাই বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেটুকু শেখা, সেটাই কোনোমতে ধরে রাখার চেষ্টা। ফলে ভুলেই যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব ভাষা। কথা হয় সাদ্রি ভাষায় কথা বলা নওগাঁর বদলগাছীর উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের চার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে। জানা গেছে, কলেজ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর শিক্ষা ভাতা দেওয়া হয়। সেজন্য প্রত্যয়নপত্র নিতে এসেছিলেন উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের চকআলম পুর এলাকার অমৃত ওড়াওয়ের ছেলে অজিত কৃমার ওড়াও, রসুলপুর এলাকার মাধবপাড়ার কিরণ চন্দ্র মিনজীর ছেলে প্রশান্ত মিনজী ও একই এলাকার বৃষ্টি তির্কী। এরা তিনজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ওড়াও সম্প্রদায়ের। আর তাদেরই সহপাঠী শ্যমপাড়ার পংকরী রাণী পাহান সম্প্রদায়ের। তবে এদের মধ্যে আরও মিল রয়েছে, এরা সকলেই বদলগাছী বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করছে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এবং একই বিভাগের শিক্ষার্থী তারা। প্রত্যয়নের জন্য আবেদন জমা দিতে এসেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল তাদের আবেদনের ভূলভ্রান্তি বুঝিয়ে ঠিক করে জমা দিতে বলেন। একাডেমিক বা বই পুস্তকের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ভাষা শিখতে পারছে কিনা, স্কুল-কলেজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের জন্য আলাদা কোনো ভাষার ব্যবস্থা আছে কিনা- এসব নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় কালবেলা প্রতিবেদকের। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুরই ব্যবস্থা নেই। তাই তারা ভুলে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা। তবে জন্মের পর বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেটুকু শেখা যায়। তাও ঠিকমতো আর বলতে পারেন না তারা। ‘আমি বা আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি’ এই বাক্যটি তাদের নিজস্ব ভাষায় জানতে চাওয়া হয়। আমতা আমতা করে অজিত কুমার ওড়াও ও প্রশান্ত মিনজী বলেন, ‘হ্যাম বা হ্যাম্নি বাংলাদেশকে ভালোবাসিলা।’ আর ঝটপট বলল বৃষ্টি তির্কী। তারা সকলেই জানালেন তাদের এই সাদ্রি ভাষা কিছুটা হিন্দি ভাষার আদলে। অজিত ও প্রশান্ত বলেন, ‘আমরা গত বছরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫ হাজার করে টাকা পেয়েছি। তাই এবারও আবেদন করছি। ওই টাকাটা পেলে আমাদের অনেক কাজে দেয়। এই জন্য হ্যাম্নি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাইলা।’ পরিশেষে তারা চারজনই তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার আহ্বান জানান। তাই তারা বললেন, ‘হ্যাম্নিকের ভাষা হ্যাম্নি ধ্যারকে র‌্যাখবেই।’ প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল বলেন, প্রত্যয়নে একটু ভুল থাকলে তাদের জন্যই পরবর্তীতে সমস্যা হবে। তাই ভুলভ্রান্তি ঠিক করে জমা দিতে বললাম। তারা জমা দেওয়া মাত্রই তাদেরকে ইউএনওর স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন দেওয়া হবে। তিনিও শুনছিলেন তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষায় কথা বলা। তিনি আরও বলেন, তাদের ভাষাটা ধরে রাখা উচিত। সেটা যে কোনো উপায়ে হতে পারে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও পাচ্ছেন সুযোগ সুবিধা। আমরা চাই তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারুক। বদলগাছীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সামাজিক সংগঠনের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন পাহান ও সভাপতি বিজয় পাহান কালবেলাকে বলেন, ওড়াও, পাহান, মাহাদীসহ এই উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছি। অন্যদের মতো আমাদের এই সাদ্রি ভাষার প্রচলন হওয়া উচিত। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা সাদ্রি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করুক। সরকার নাকি এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা শুনেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে সাদ্রি ভাষার জন্য বই দিবে। প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই থাকবে। দেওয়া হবে শিক্ষা। আমরা চাই প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আলাদা একজন শিক্ষক থাকবে, তারাই আমাদের এই সাদ্রি ভাষায় ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করাবে। আর এটা দ্রুত কার্যকর করা হোক। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খুশি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা অজানা কাহিনী ও ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে নিয়ে আসা সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক এম এম রাসেল কালবেলাকে বলেন, তাদের সাদ্রি ভাষা সংরক্ষণ করা দায়িত্ব। সেটা যে কোনো উপায়ে হতে পারে। আমার জানা মতে এই ভাষাটি ভারতের ঝাড়খণ্ড-উড়িষ্যা থেকে এই সাদ্রি ভাষা এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষরা কাজ করতো। সেখানে এই ভাষাটি প্রচলন হতো। এদেরই একটা অংশ হয়তো এখানে এসেছে বা বংশ পরম্পরায় আছে। ওড়াও সম্প্রদায় সাদ্রি ভাষাকে তাদের নিজস্ব ভাষা করে নিয়েছে। তাই তাদের পড়াশোনার জন্য নিজস্ব ভাষার বইও থাকা দরকার। এ বিষয়ে নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্যও তিনি অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে আমি আমার এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবো।
২৭ এপ্রিল, ২০২৪

ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকিরের নিবন্ধ / বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু কারও কারও কাছে এটি একটি বিদেশি ভাষা। বাংলা যখন বিদেশি ভাষা, তখন এর নাম হয় বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা (Bangla as Foreign Language)। বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা সম্পর্কে এ দেশে কোনো ধারণাগত কাঠামো গড়ে উঠেনি। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নিজস্ব ধারায় বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহার চলছে এবং বিদেশি জ্ঞানরাজ্যের (academia) একটি ধারণাগত কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি না থাকায় দেশাভ্যন্তরে এর কোনো ধারণাগত কাঠামো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চা চলছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্য অন্যতম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশস্থ বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট, ব্র্যাক ভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানেও বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।  প্রসঙ্গত, বিষয়টি আরেকটু সবিস্তারে আলোচনা করা যাক। কোনো ভাষা স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে ধ্রুপদী ভাষা, জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা, তৃতীয় ভাষা, ঐতিহ্য ভাষা, বিদেশি ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত হতে পারে। পৃথিবীর লাখ লাখ বুলির মধ্যে কিছুসংখ্যক বুলিই এই সবগুলো বিশেষণ লাভ করেছে। বাংলা ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক ভাষা-পরিস্থিতিতে উপরোক্ত সবগুলো অভিধা লাভ করেছে। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা।  আবার এ ভাষা বম, চাক, চাকমা, কোচ, গারো, হাজং, খাসিয়া, খিয়াং, খুমি, লুসাই, মাহাতো, মারমা, মণিপুরী, মুন্ডা, মুরুং, ম্রো, পাহাড়ি, পাংখো, রাজবংশী, রাখাইন, সাঁওতাল, তঞ্চঙ্গ্যা, টিপরা ও ওঁরাও ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা।  অন্যদিকে বিদেশে অভিবাসিত বাংলা ভাষাভাষীদের নতুন প্রজন্মের কাছে এটি একটি ঐতিহ্য ভাষা।  উল্লেখযোগ্য যে, বিপুলসংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের মাধ্যমে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। সেখানে তারা সমাজবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। বিদেশে অভিবাসিত বাংলা ভাষাভাষী সমাজের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের যুব জনগোষ্ঠীর কাছে এটি হলো ঐতিহ্য ভাষা।  অন্যদিকে বাংলা ভাষা বাংলাদেশে জাতীয় ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে বিধায় এটি আন্তর্জাতিক ভাষার অভিধা লাভ করেছে। সম্প্রতি ভারতের বিদ্যোৎসাহী শ্রেণি বাংলা ভাষার সাহিত্য সম্ভার, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবি তুলছে। বাংলাদেশ ও ভারতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ভিন্ন হলেও, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্য বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর রয়েছে।  উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ভাষা শহীদ দিবসের দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়।  এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুন যথাক্রমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভা বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উপস্থাপনের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা কর্তৃক একযোগে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে চালু করার দাবির বিষয়টি ইঙ্গিত করে যে-বাংলা ভাষা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠার মতো একটি প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা রয়েছে।  এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, বাংলা ভাষা মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার মানদণ্ডে যুগপৎভাবে ধ্রুপদী ভাষা, জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা, তৃতীয় ভাষা, ঐতিহ্য ভাষা, বিদেশি ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষারই একইসঙ্গে এতোগুলো অভিধা জোটেনি। আমাদের আশপাশের দেশের ভাষাগুলো সম্পর্কে এমন উদাহরণ সত্য।  হিন্দি ভাষা ভারতের দাপ্তরিক ভাষা। কিন্তু এটি ভারতের জাতীয় বা রাষ্ট্র ভাষা নয়। আবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণ হিন্দিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিক পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলেও, এটি পাকিস্তানের ভাষা নয়। এটি মূলত ভারতের মুসলমানদের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা। ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার কোনো জাতীয় ও রাষ্ট্রভাষা নেই। এর দাপ্তরিক ভাষা হলো ইন্দনেশীয় ভাষা। ইন্দোনেশীয় ভাষা মূলত: মালয় ভাষারই একটি ভিন্নরূপ। সে হিসাবে এটি ইন্দোনেশিয়ার নানান ভাষাভাষী জনগণের জন্য একটি বহিরাগত ভাষা।  বাংলা ভাষার এতোগুলো অভিধা জুটলেও, খোদ বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ চলছে। কিন্তু বাংলা ভাষার যে প্রচ্ছন্ন শক্তি রয়েছে, সে শক্তিই যেন এই ভাষাকে বিদেশি ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ভাষা বিজ্ঞানী কাই চান (২০১৬) তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কোনো ভাষার বিদেশি ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কয়েকটি সূচকের ওপর। সে সূচকগুল হলো কোনো নির্দিষ্ট ভাষার আঞ্চলিক বিস্তৃতি, অর্থনীতি, সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে কার্যকারিতা, জ্ঞান ও গণমাধ্যমে ভাষা হিসাবে ব্যবহারের বিস্তৃতি ও সেই ভাষা সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা ইত্যাদি। তার প্রস্তাবিত এই সূচকগুলো বিবেচনায় নিলে বাংলা ভাষার যৎসামান্য হলেও ভাষিক সক্ষমতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সে জন্য বিশ্বের নানাদেশে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও গবেষণা চলছে। তারমধ্যে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম হলো চীনস্থ গুয়াংঝু বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানস্থ টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন চলছে।   যে কোনো দেশই তার জাতীয় ভাষাকে ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতিরূপস্বরূপ বিদেশি ভাষা হিসেবে প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সেই উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই। এমনকি জাতীয় এই ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেই। আবার ভারতের পক্ষে এই ভাষাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়। কারণ, ভারতে বাংলাদেশের মতো বাংলা ভাষার মর্যাদা সমান নয়। কারণ ভারত প্রজাতন্ত্র যুক্তরাজ্যীয় ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্র, যার দাপ্তরিক ভাষা হলো ইংরেজি ও হিন্দি। কাজেই লক্ষণীয় যে, ভারতের ভাষা-পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার চেয়ে নিম্নে।  সুতরাং বাংলা ভাষাকে বিদেশি ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ সরকারের ওপর। এই দায়িত্বকে অবহেলা করা মানে বাংলা ভাষাকেই অবহেলা করা। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের দায় ও দায়িত্ব হবে, বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট প্রণয়ন করা। উদ্দিষ্ট এই ভাষানীতি বাস্তবায়নে যেসব ভাষা-পরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন তা হলো:  ১)বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ নামক একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। ২)বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে (উদাহরণস্বরূপ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট) বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের সুবিধার্থে গবেষক (research fellow) ও অভ্যাগত অধ্যাপক (visiting professor) পদ সৃষ্টি করে তাদের বৃত্তিসহ আমন্ত্রণ জানানো।  ৩)বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে বাংলা ভাষা শিক্ষা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪) বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শীত ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির সাথে মিল রেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা ভাষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য তিন সপ্তাহব্যাপী শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন আবাসিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।  ৫) বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা হলে, তা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা।  লেখক: অধ্যাপক ডক্টর এ বি এম রেজাউল করিম ফকির, পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;  ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়  ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
২৬ এপ্রিল, ২০২৪

জার্মান ভাষা পারেন না দেখে বায়ার্নে যেতে চান না জিদান
এবারের ফুটবল মৌসুমটা জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের জন্য খারাপ যাচ্ছে বললে ভুল বলা হবে না। টানা এগার মৌসুম ধরে বুন্দেসলিগা ট্রফিকে বলতে গেলে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে রেখে ছিল যে দল সেই ট্রফি এবার গিয়েছে বায়ার লেভারকুসেনের ঘরে। তবে বুন্দেসলিগায় ট্রফি হারানো থেকেও বড় সমস্যার সামনে কেইন-মুলাররা। এই মৌসুমের শেষেই নতুন কোচ খুঁজতে হবে বায়ার্ন মিউনিখকে। এই মৌসুম শেষেই বায়ার্ন কোচ টমাস টুখেল তার দায়িত্ব ছাড়বেন বলে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জিনেদিন জিদান। তবে এই ক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন বায়ার্ন। একে তো ইউরোপের গণমাধ্যমগুলোর দাবি বায়ার্ন নাকি জিদানের সাথে এখনো কোন আলোচনাই করেনি। তবে আলোচনা ছাড়াও জিদানের নিয়োগ নিয়ে আরেকটি সমস্যার সামনে জার্মানির জায়ান্টরা। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ বিজয়ী কোচ জিদান জার্মান ভাষা পারেন না বলে বায়ার্নে যোগদানের বিষয়ে সংশয়ে আছেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ বিজয়ী ফ্রান্স দলের সদস্য জিদানকে নিয়ে বিষয়টি আরও ঘনীভূত হয়েছে জুলিয়ান নাগলসম্যানের জার্মান জাতীয় দলের সঙ্গে চুক্তি নবায়নের পর। তবে চুক্তি নবায়নের আগে বায়ার্নের পরবর্তী কোচ হিসেবে নাগলসম্যানই ছিল বায়ার্নের ক্লাব কর্তাদের প্রথম পছন্দ।   তবে জিদান ছাড়াও বায়ার্নের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে ব্রাইটনের রবার্তো ডি জারবি, অস্ট্রিয়ার রাল্ফ রাগনিক ও স্টুটগার্টের সেবাস্টিয়ান হোয়েনেস। তবে জিদান অবশ্য নিজে মিউনিখে যাবার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নন। বিশেষ করে ভাষাগত সমস্যা তাকে বেশ ভোগাবে বলে তিনি এর বিপক্ষে। তবে বায়ার্নের সামনে এখনও টুখেলকে রেখে দেওয়ার অপশন আছে। তবে সে জন্য টুখেলকে ৩০ এপ্রিলের রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষের সেমিফাইনালে জয় আনতেই হবে।
২১ এপ্রিল, ২০২৪

বাঁকা টিপ প্রতিবাদের ভাষা
নারীর প্রতিবাদের ভাষা এখন বাঁকা টিপ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে নারীর কপালের বাঁকা টিপের সেলফি। এভাবেই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে #OddDotSelfie। বাঙালি নারীর সাজসজ্জায় চিরাচরিত টিপের ব্যবহার হয়ে উঠেছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। কপালের মাঝখান থেকে টিপ একটু সরিয়ে সেলফি তুলে #OddDotSelfie লিখে পোস্ট করে নিজ নিজ ওয়ালে দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নাট্যশিল্পী ও ইনফ্লুয়েন্সাররা। তারা নারীদের আহ্বান জানিয়েছেন সেলফি ও হ্যাশট্যাগসহ প্রতিবাদে যোগ দিতে। এরপর এটি ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী সারা যাকেরের মতে, ‘আমাদের দেশের নারীরা প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদই হচ্ছে না। সবাই মিলে সোচ্চার হওয়ার এখনই সময়। শুধু নিজের জন্য নয়, আশপাশে কোনো নারীকে নির্যাতিত হতে দেখা মাত্র প্রতিবাদ করা উচিত।’ ‘পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়ছে তেমনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে এই হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। যে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে নারীরা বেশিরভাগ সময় তা নীরবে সহ্য করে নেন। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই তা বন্ধ হবে। আমিও এই প্রতিবাদে আওয়াজ তুলেছি বললেন নাট্যকর্মী ফৌজিয়া করিম অনু। ইনফ্লুয়েন্সার নাজিবা নওশিন বলেন, টিপ পরা আমাদের সংস্কৃতি। কপালের সেই টিপ সরিয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
০৪ মার্চ, ২০২৪

কপালের টিপই এবার নারীর প্রতিবাদের ভাষা
চলছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নারীর চিরাচরিত এই টিপই এবার হয়ে উঠেছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা #odddotselfie’ স্লোগানে রেডিও স্বাধীন-এর উদ্যোগে চলছে এই অভিনব প্রতিবাদে সাড়া দিয়েছেন অভিনয় শিল্পী ও ইনফ্লুয়েন্সাররা। ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সেলফি পোস্ট করে এই প্রতিবাদ শুরু করেন তারা। ইনফ্লুয়েন্সার নাজিবা নওশিন বলেন, আমরা নারীরা মন ভালো থাকলে টিপ পরি। এটি আমাদের কালচার। কপালের সেই টিপ সরিয়ে দিয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমারা এবার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ বিষয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী সারা যাকের বলেন, আমাদের দেশের নারীরা প্রতিদিন ঘরে বাইরে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদই হচ্ছে না। সবাই মিলে সোচ্চার হওয়ার এখনই সময়। শুধু নিজের জন্য নয়, আশপাশে কোনো নারীকে নির্যাতিত হতে দেখামাত্র প্রতিবাদ করা উচিত। পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়ছে তেমনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে এই হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে নারীরা বেশিরভাগ সময় তা মুখ বুজে সহ্য করে নেন। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা নারীরা মুখ খুললেই বন্ধ হবে। তাই আমি এই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছি বলে জানান প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী নাট্যকর্মী ফৌজিয়া করিম অনু।
০৩ মার্চ, ২০২৪

কপালের টিপই এবার নারীর প্রতিবাদের ভাষা
সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নারীদের কপালের বাঁকা টিপের সেলফি। না, এটি কোনো ট্রেন্ড নয়। চলছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নারীর চিরাচরিত এই টিপই এবার হয়ে উঠেছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা।  ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা #odddotselfie’ স্লোগানে রেডিও স্বাধীন-এর উদ্যোগে চলছে এই অভিনব প্রতিবাদে সাড়া দিয়েছেন অভিনয় শিল্পী ও ইনফ্লুয়েন্সাররা। ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সেলফি পোস্ট করে এই প্রতিবাদ শুরু করেন তারা।  কপালের মাঝখান থেকে টিপ একটু সরিয়ে সেলফি তুলে হ্যাশট্যাগ odddotselfie দিয়ে পোস্ট করেন নিজ নিজ ওয়ালে। তারা নারীদের আহ্বান জানান সেলফি ও হ্যাশট্যাগসহ প্রতিবাদে যোগ দিতে। অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী সারা যাকের বলেন, আমাদের দেশের নারীরা প্রতিদিন ঘরে বাইরে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে এটা নিয়ে কোনো প্রতিবাদই হচ্ছে না। সবাই মিলে সোচ্চার হওয়ার এখনই সময়। শুধু নিজের জন্য নয়, আশেপাশে কোনো নারীকে নির্যাতিত হতে দেখা মাত্র প্রতিবাদ করা উচিৎ। অভিনেত্রী অপি করিম বলেন, ‘পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়ছে তেমনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে এই হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না।‘যেকোনো নির্যাতনের শিকার হলে নারীরা বেশিরভাগ সময় তা মুখ বুজে সহ্য করে নেন। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা নারীরা মুখ খুললেই বন্ধ হবে। সেই লক্ষ্যেই ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা #odddotselfie’ স্লোগানে চলছে এই প্রতিবাদ। ইনফ্লুয়েন্সাররা বলেন, আমরা নারীরা মন ভালো থাকলে টিপ পরি। এটি আমাদের কালচার। কপালের সেই টিপ সরিয়ে দিয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমারা এবার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে টানা ৭ দিন ‘অড ডট সেলফি’ প্রোগ্রামের আয়োজন করে রেডিও স্বাধীন। প্রোগ্রামে নারী নির্যাতনের শিকার হলে করণীয় এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা হয়। অনেকেই তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। দর্শকরাও কলের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে উক্ত অনুষ্ঠানে। অড ডট সেলফি নামে একটি ওয়েবসাইটও লঞ্চ করে রেডিও স্বাধীন।
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না : আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না। সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেখানে অনেকেই মুক্তভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, সমাজ, রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা যদি রক্ষিত না হয়, তাহলে অশুভ শক্তির বিকাশ দৃশ্য-অদৃশ্য সব স্তরে ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা করে নেয়, যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে এবং সৃষ্টিশীলতার পথ স্বাভাবিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে আত্মবিকাশের প্রশ্ন হয়ে ওঠে সাংঘর্ষিক। এ জন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষের চিন্তার অধিকার রক্ষা করা। মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘ভাষা দিবসের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না। সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাই ছিল ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেসব অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, চিন্তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কথা বলার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং লেখার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন, জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর এবং স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরও আমাদের বাকস্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং ড. আব্দুল মান্নানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, কবি আবদুল হাই শিকদার, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা সিটি কলেজের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নূর নবী মানিক।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

এস. এম. আব্রাহাম লিংকনের নিবন্ধ / ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
আমাদের ভাষার সংগ্রাম একদিনের কোনো ঘটনা ছিল না। ১৯৫২ সালের আগে পরে কয়েকটি মিছিল বা ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাই শুধু ভাষার সংগ্রাম না। তবে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ রফিক, শফিউর, সালাম, বরকত, জব্বারের জীবনদান ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মানুষের চূড়ান্ত ক্ষোভের প্রকাশ ছিল। এই হত্যাকাণ্ড মানুষের মুখে নতুন করে প্রতিবাদের ভাষাও জুড়ে দিয়েছিল। যার প্রভাব পরবর্তীতে সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। এই ক্ষোভকে জ্যোতিষীর মতোন কাজে লাগিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষকে স্বাধীকারমুখী করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথচ তিনি ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে কৃত ভূমিকা বা অবদানের তুলনায় খুব কমই উল্লিখিত হয়েছেন। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনো তাঁর জীবদ্দশায় কারো প্রতি অভিযোগ বা অনুযোগ করেননি। বরং বঙ্গবন্ধু তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে সংশ্লিষ্টদের অবদানকে উদার ও নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা পাকিস্তানি শাসকদের শুরু থেকেই ছিল । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানি ভাবধারার খুনিচক্র মৃত বঙ্গবন্ধুর ওপর এখনো হামলে পড়ে। তারা মৃত বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের পাতা থেকেও তিরোহিত করতে নিরন্তর নির্মম প্রচেষ্টায় ক্রিয়াশীল । যেমনটি তারা অনুপ্রবেশ করাতে চেষ্টা করে ২৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার এক পাঠেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তেমনি শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে যা হয়েছে শুধু সেটি ভাষার লড়াই। ২৭ মার্চ ১৯৭১ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এর কোনটিতে বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না। দু'টি পর্বের দু'টি দিনে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গরাদে বন্দি ছিলেন। এই কারাবাসকে স্বাধীন বিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট। ভাষার সংঘাে আমাদের ভাষা সংগ্রামীরা একেকজন একেক পর্বে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। কি এ কথা দালিলিকভাবে বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন সংগ্রামী যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষার লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন। ভাষা সংগ্রামে শরীরী ও অশরীরী দু'ভাবেই প্রবল সংযুক্তি ছিল তাঁর। আমাদের ভূখণ্ডে ভাষার ওপর আক্রমণ নতুন নয়। পরোক্ষ আক্রম শতাব্দীকাল আগেও হয়েছে। এগুলোর পিছনের কারণই হচ্ছে বাংলার পৃথ সত্তার সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করা। বহুজাতিক ও বহুভাষিক ভারতব যখন ব্রিটিশদের বিদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ, তখন ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ ঐক্যব ভারতকে বিভক্তির নকশা প্রণয়ন করে ঠাণ্ডা মাথায় তা কার্যকর করতে এগুতে থাকে। এজন্য তারা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে তাদের অনুগত ও অনুসারী তৈরি করতে থাকে। একইসঙ্গে ভারতের ভেতরে প্রিন্সলি স্টেটগুলোকেও তারা কাজে লাগাতে থাকে। যে প্রক্রিয়াগুলোর মধ্য দিয়ে অবিভক্ত ভারত অরক্ষণীয় হয়ে ওঠে। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে এ অঞ্চলকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যেখানে অবিভক্ত থাকার সুযোগ ছিল। এ কথাতো অনস্বীকার্য ১৭৫৭ সালে বাংলা বিহার উড়িষ্যা ইংরেজ করতলগত না হলে বা বহিঃশত্রু দ্বারা পরিচালিত না হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম এ দু'জন নেতা ঐক্যবদ্ধ বাংলার (Greater Bengal)-এর পক্ষে ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি স্বাধীন অখণ্ড বাংলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যে উদ্দোগে সামিল ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যেহেতু বাঙালি এবং বাংলা রাজনীতি অর্থনীতি সমাজে সমগ্র ভারতে শীর্ষস্থানীয় ছিল, সঙ্গত কারণে ব্রিটিশ শাসনে বাঙালি নেতৃত্বের বিরুদ্ধ একটি শক্তি বিকাশমান হচ্ছিল। তারা ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে। যদিও আন্দোলনের ফলে সেটি আবার ১৯১১ সালে রদ হয়েছিল। তবে তারা কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়। একইচক্রের ষড়যন্ত্রে সুভাষ বসুও কংগ্রেস থেকে ছিটকে পড়েন। ফলে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগে জিন্নাহ ও জওহরলাল নেহেরু প্রবল ও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন। তারা বিভক্ত ভারত রচনায় নিয়ামক হন। ধর্মের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পাকিস্তান ও ভারত কায়েম হয়। যার মধ্য দিয়ে বাঙালি ও বাংলা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলত ১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বাংলার বিভক্তি বঙ্গবন্ধু মানতে পারেননি। বিষয়টি তাঁর লেখা থেকেই পরিষ্কার হওয়া যায়- 'কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরাম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল । আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম । আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা।' ২ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে এও পরিস্কার হওয়া যায় ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল । স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হলে তারাই ঠিক করতো তারা ভারত না পাকিস্তানের সাথে যাবেন নাকি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অবস্থান করবে। মওলানা আকরাম খাঁ সাহেব ঘোষণা করেছিলেন 'আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে। সোহরাওয়ার্দী আকরাম খাঁ, শরৎ বসু, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমূখের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ : বিভক্ত বাংলা নিয়ে পাকিস্তান কায়েম হয়। স্বপ্নের শহর কলকাতার হাতছাড়া হয়ে যায় । সে সময় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি হয়ে উঠে মুখ্য। পাকিস্তান কায়েমের পর নব্য শাসকরা বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত করতে থাকে। যার অংশ হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর প্রথমেই আঘাত শুর করে। বাংলা ভাষার ওপর ষড়যন্ত্র অবশ্য এর আগেও হয়েছে। ১৮৮৬ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠিত সর্ব ভারতীয় শিক্ষা সম্মেলনে বাঙালি ও অবাঙালি প্রতিনিধিদের মধ্যে বাংলার মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বাহন বাংলা, উর্দু না ফার্সি এ বিতর্ক দেখা যায়। সামাজিক ভিত্তি ন পেলেও ১৯২৬ সালে নবাব সলিমুল্যাহর পুত্র খাজা হাবিবুল্ল্যাহ পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি শিক্ষার্থীদের মাঝে উর্দু প্রসারে অল বেঙ্গল উ এসোসিয়েশন তৈরি হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিখি ভারত মুসলিম লীগের লক্ষ্ণৌ সম্মেলনে দলের কার্য পরিচালনায় দলের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। শেরে বাংল ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলার শতাধিক কাউন্সিলর তার বিরোধিতা করলে সেটি প্রত্যাহার হয়।  পাকিস্তান নামক একটি অসম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই পূর্ব বাংলা কার্যত পাকিস্তানের কলোনি হয়ে পড়ে। এ ভূখণ্ডের নাগরিকরা হয়ে যায় পরাধীন। ফলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র নিজ নাগরিকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র হয়ে পড়ে নাগরিকের জীবনে হয়ে খড়গ। বঙ্গবন্ধুসহ তরুণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন পাকিস্তান একটি ভুল রাষ্ট্র। কমিউনিস্টরা পরিবে পরিস্থিতিকে বিবেচনায় ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভূখা হায় শ্লোগান তুলে নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচারণ করলে শাসক দল জনমানস বিবেচনায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। ফলে ১৯৪৭ সালের অব্যবহিত পরপরই পূর্ব বাংলা কার্যত বিরোধী দল শূন্য হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে শাসকচক্র সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুসলিম লীগের লড়াকু শক্তিটিকে দলের মধ্যে কোণঠাসা করে ফেলে। তারা নিজ দলে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকেন।  একটি রাষ্ট্রের জন্মের পরই সে রাষ্ট্রের শেষ পরিণতি বুঝতে পারা কঠিন দূরদর্শিতার বিষয়। যেটি রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ৪৭'-এ বুঝেছিলেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করেন। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন 'আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও শহিদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান, রাজশাহীর আতাউর রহমান প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একমাসের মধ্যেই ৬-৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ গড়ে তোলেন অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ' ।  নতুন শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অবনত রাখার জন্যই বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত করে। প্রথম আঘাতটাই আসে ১৯৪৭ সালে। ২৭ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৭ শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব গৃহিত হয়। এর প্রতিবাদে খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবনের সামনে ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ মিছিল হয়। যার অগ্রভাগে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন। পরিস্থিতির অনুধাবনে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্রদের সংগঠিত করার সুযোগ তৈরি হয় । ছাত্রলীগ প্রণীত প্রথম পুস্তিকাতেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের সক্রিয় ভূমিকায় সমস্ত জেলায় এক মাসের মধ্যে সংগঠনটির শাখা গঠিত হয় দেশজুড়ে প্রচুর সাড়া পরিলক্ষিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক যেখানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে মুসলিম লীগ নেতারা স হয়ে ওঠে। বিষয়টিতে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মহল বেশ নড়ে-চ ওঠে। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন। যে প্রস্তাব ২৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনসহ শাসকদলের প্রবল বিরোধিতায় বাতিল হয় যায়। এর প্রতিবাদে ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট হয়। এরপর। মার্চ তমুদ্দিন মজলিস ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিভিন্ন হল ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি ও অন্যান্যদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাংল ভাষার ওপর আঘাতকে পুঁজি করে পূর্ব পাকিস্তানে সরকার বিরোধ রাজনীতির শক্ত গোড়াপত্তন হতে শুরু হয়। যার পিছনে তরুণ নেতা শেষ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষণীয়। ২ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হ মুসলিম হলে প্রতিনিধি সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পনগঠিত হয়। যে সভায় বঙ্গবন্ধু ও নঈমুদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় ছাত্রলীগ নেতা শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করা হয়। ১১ মার্চ বাংলা ভাষা দাবি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিবসটি সফল করার জন্য ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান শাসকদের দেয়া ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে যুক্তিসম্মত বক্তব্য তুলে ধরেন। পরদিন ১১ মার্চ পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ অনেককে পিকেটিং করাবস্থায় গ্রেফতার করে। পরে তাঁরা ১৫ মার্চ তারিখ মুক্ত হন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর এ ছিল প্রথম কারাবাস। এই গণগ্রেফতারের খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সারাদেশে বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। শাসকগোষ্ঠী যে অন্যায্য করছে সেটি সম্পর্কে জনমানসে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষের মধ্যে আন্দোলকারীদের পক্ষে সহানুভূতির সৃজন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পরদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে একটি স্মারকলিপি আইনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন নেতারা ভেবেছিল উর্দুকে সহজেই রাষ্ট্রভাষা করতে পারবে। তাদের সে আশায় বাঙালিরা বাধ সাধে জনসমর্থন না পেয়ে তারা ঘাবড়িয়ে গেলেও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেকে বিরত হয়নি। তারা গভর্নর জেনারেল জিন্নাহকে উর্দুর পক্ষে শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। জিন্নাহ ঢাকায় এলে তার মুখ দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলে বাঙালিরা বিষয়টি মেনে নেবে তারা মনে করেছে জিন্নাহ যেহেতু দল মত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় তাই তিনি বললেই কেল্লাফতে। শাসক দলের ভুল ছিল এখানে। জিন্নাহর ঘোষণায় বাঙালি সাড়া দেয়নি। ২১ মার্চ যখন ঘোড়দৌড় মাঠে জিন্নাহ বললেন- ' একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রইভাষা। তারএঘোষণার তাক্ষণিক পতিক্রিয় হয়েছিল माনি ना মানি না বলে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ মার্চের কনভোকেশনে গিয়ে জিন্নাহ একই কথার দ্বিরুক্তি করে বললেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সেখানে ছাত্ররা চিৎকার করে বলেছিল না, না, না। এর পরে জিন্নাহ পাকিস্তানে ফিরে গেলে সাময়িকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে কৌশলগত নীরবতা কিছুদিন দেখা যায়। পাকিস্তানিরা যখন নীরব তখন পূর্ব পাকিস্তানে পৃথকভাবে রাজনৈতিক সংগঠন বিনির্মাণে সচেষ্ট হন। মুসলিম লীগের একটি প্রগতিশীল অংশ যাঁদেরকে পাকিস্তানিরা আমলে নেয়নি এবং রাজনৈতিক স্থান না দিয়ে পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে আখ্যা দিতে থাকে। যাদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, আব্দুস সালাম, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকে । ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। তিনি ডেরা পাতেন ১৫০ মোগলটুলি পার্টি হাউসে। সেখান থেকেই তিনি নিত্যদিন নানা কর্মসূচি নিয়ে এগুতে থাকেন। বউ, সংসার, মা, বাবা দেশে চেয়ে তাঁকে বেশি টানেনি। দেশের টানে তিনি ঢাকায় অবস্থান নি পুরোদস্তুর হোলটাইমার পলিটিশিয়ান হয়ে পড়েন। রাজনীতির কোনো কিছুই তাঁর মাথায় ছিলো না। পিতার পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল আইনে ভর্তি হন বটে। সেখানে যতটা না পড়া তার চেয়ে বেশি ছিল তাঁ অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। তিনি ছাত্রলীগের কর্মীবাহিনীসহ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বছরব্যাি আন্দোলনে। যে আন্দোলন ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৯৪ সালের প্রথমার্ধ অব্দি চলে। শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের নানাবি কাজগুলোকে গভীরভাবে ফলো করতে থাকে। তাঁকে বিরত করার নানামু ষড়যন্ত্রও করতে থাকে । বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৯ মার্চ ১৯৪৮ শেখ মুজি রহমানসহ ২৭ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। ১৫ টা জরিমানা ও মুচলেকা দেয়ার শর্ত পালনে অপরাগতা দেখালে বিশ্ববিদ্যাল কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিষ্কার করে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কে দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হলে ছাত্রদে শাস্তি বাতিল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে ১৮ এপ্রি উপচার্যের বাসভবনে ছাত্র অবস্থান নিলে পরদিন সেখান থেকে ছাত্রনে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি মুক্তি পান ২৬ জুন। তাঁ মুক্তির মাত্র তিনদিন পূর্বে পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে মোড় ঘুরিে আওয়ামী মুসলীম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। যা সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদ হন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ অবস্থায় সেই নবগঠি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন। তিনি সে সময়ের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। কমিটি নির্বাচনকালে তাঁর মত নেয় হয়েছিল। একজন ছাত্রনেতা সরাসরি রাজনৈতিক দলের ৩য় গুরুত্বপ ব্যক্তি হিসেবে কমিটিতে স্থান পান। যা তার গুরুত্ব ও রাজনৈতিক সক্ষমতার বহিপ্রকাশ ছিল। লিয়াকত আলী খান ১৯৪৯ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনায় মনোযোগ দেন। তিনি বলেন ইসলামী আদর্শের ওপর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হবে। এ নিয়ে সংখ্যালঘু ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসীদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। একই সময়ে আবারো বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে তাতে আরবি হরফ বসানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। শেখ মুজিবুর রহমান এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকারি ব্যর্থতার বিরুদ্ধেও সে সময় স্বোচ্চার হন। ফলে তাঁকে আটক রেখে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ক্রিয়াশীল হয় সরকার। সরকার ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে জননিরাপত্তা আইনে। তিনি বন্দি হয়ে পড়েন লম্বা সময়ের জন্য । তাঁর অনুপস্থিতিতে এরপর ১৯৫০ সালের ৭ মার্চ গণপরিষদে উত্থাপিত রিপোর্টে আবারো উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। এতে বাঙালিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১৯৫০ সালের ৪-৫ নভেম্বর গ্রান্ড ন্যাশনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় যেখানে, সেখানে পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আলোকে পূর্ব বাংলার পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন দেবার দাবি তোলা হয়। স্বায়ত্বশাসনের দাবি তোলার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাতন্ত্র্যকে প্রথম ইঙ্গিত করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য ১৯৫১ সালে ভাষা মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৫-২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় ঘোষণা করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এরপর ৩১ জানুয়ারি ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে (বার লাইব্রেরি) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ ৬২টি রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রকেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয়। যার আহ্বায়ক হন কাজী গোলাম মাহাবুব। কারা অভ্যন্তরীণ শেখ মুজিব তখন চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে। তিনি সেখানেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে গোপনে বৈঠকে মিলিত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের নির্দেশ দেন এবং নিজে কারা অভ্য অনির্দিষ্টিকালের জন্য অনশন শুরু করবেন সেটিও তাদের জানিয়ে। এতদবিষয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমান পৃষ্ঠা- ১৯৮ থেকে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতাংশ উল্লেখ করা হলো- 'আমি হাসপাতালে অ সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ।--- আমি ওদের রাত পরে দেখা করতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে বাইরে আইবরা পাহারা দিত। রাত অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছন বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। --- পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে ভাগব না। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম সর্বদ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।' উপর্যুক্ত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হাসপাতালে বন্দি অবস্থাতেই শেখ মুি রহমান শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে নেতা কর্মীদের ভাষা সং করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। হাসপাতালে থেকে বন্দি শেখ মুজি রাজনীতির বিষয়টি গোয়েন্দা চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি ফলশ্রুতিতে ত দ্রুত জেলাখানায় ফিরিয়ে নিয়ে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।  ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রি শফিক, জব্বার, বরকত, সালাহউদ্দিন শহিদ হন, আহত হন অনেকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা ও গ্রেফত পরোয়ানা জারি হয় ৷ গ্রেফতার হয়ে যান মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগী খয়রাত হোসেন, আব্দুর রশিদ, খান সাহেব ওসমান আলী, কাজী গোলাম মাহাবুব, খালেক নেওয়াজ, আব্দুল মতিন, অলি আহ আবুল হাি দেশরক্ষা আইনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি হয়ে যান। বন্দি বঙ্গ নেতাদের দেয়া কথা অনুয়ায়ী টানা দশদিন অনশন করেন, তিনি গুরুত অসুস্থ হয়ে পড়লে সরকার ২৬ মাস পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তাঁকে মু প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার আন্দোলন গড়ে তোলায় নিজেকে বিপুল বেগে যুক্ত করেন। এই সময়ে ২৬ এপ্রিল ১৯৫২ বামপন্থিরা ছাত্র ইউনিয়ন নামক একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে একটা ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেটিকে পরিষ্কার করেন। শাসকদল যাতে সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে নোংরামো করতে না পারে সেজন্য তিনি ১৯৫২ সালের ২১ মে করাচি সফরকালে সোহরাওয়ার্দীর নিকট থেকে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত বিবৃতি আদায় করেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সভা সমাবেশেও সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর দাবিকে সমর্থন করে বক্তব্যও প্রদান করেন। যা বিপুল জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। এর পরে ৩০ মে করাচিতে ও জুনের মাঝামাঝি লাহোরে বঙ্গবন্ধু পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন।  বঙ্গবন্ধু ৭ এপ্রিল রংপুরের জনসভায় উর্দুকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য দেন। ২৭ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি সভায় এবং ২৯ এপ্রিল বিবৃতি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। ২৮ আগস্ট ১৯৫৩ তিনি বিবৃিতি দিয়ে বলেন- সরকার প্রদেশের বিদ্যালয়গুলোতে উর্দুকে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করার চক্রান্ত হইতে বিরত না হলে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে বর্জন করা হবে। ভাষা আন্দোলনকে ধরে সমগ্র পূর্ববঙ্গে দেশের রাজনৈতিক বিকল্প আন্দোলন গড়ায় বঙ্গবন্ধু মনোনিবেশ করেন। তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠায় যেমন ছুটেছেন তেমনি আন্দোলন-সংগঠন-আন্দোলন পদ্ধতিতে এগুতে থাকেন। সমগ্র দেশে ৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের বিষয়টি আমাদের অজানা নয়। জেলায় জেলায় শহিদ মিনার, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি প্রভৃতি কাজও বাঙালি জাতিসত্তাকে বিকশিত করায় বেশ কাজে দেয়। স্বয়ং মওলানা ভাসানী, আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশসহ বঙ্গবন্ধুর নগ্নপদে প্রভাতফেরির সেই বিখ্যাত ছবি সে কথাকেই স্মরণ করিয়ে পাকিস্তানিদের অপশাসন, বায়ান্নর রক্তদান ও ভাষার দাবিকে পুঁতি বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিতভাবে এগুতে থাকেন। পরিকল্পিতভাবে সংগঠন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঝড় তোলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শুধু তিনি নিজেই জিতেননি সমগ্র দেশে মুসলিম লীগের কবরও রচনা কর  যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার প্রথমটিই ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার। ১৬, ১৭ ও ১৮ নং দফা ও ভা আন্দোলন সংক্রান্ত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি এক পলিটিশিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন। জনগণ গ্রহণ করছে পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে মেনে নিতে পারেনি। তারা ১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২/ক ধারা বলে ফজলুল হক এর সরকার মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় বাতিল করে পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে তারা পরিকল্পিতভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রী হিসেবে শপথের দিে আদমজীতে দাঙ্গা বাধিয়ে মানুষ হত্যা করে কেন্দ্রীয় শাসন জারির প্রস্তুত করে। তাঁর শপথের দুই সপ্তাহের মধ্যেই মন্ত্রিসভা বাতিল হয় এ শেখ মুজিবুর রহমানকে ওইদিনই গ্রেফতার করেন ।  পাকিস্তানিরা শুধু ভাষার উপর আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা পূর্ব বাংল নামও পরিবর্তন করে ফেলে। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট গণপরিষে অধিবশনে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু প্রবল আগ তোলেন। ২১ সেপ্টেম্বরের আলোচনায় স্বায়ত্বশাসনের বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়া পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানে তিনি গণপরিষদে বাংলায় বক্তব্য প্রদানের সুযোগ করে দেয়ার জন্য স্পিকা সি ই গিবনের নিকট জোর দাবি জানান। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে ভাষা শহীদদের প্রদি শ্রদ্ধা জানাতে ৫ মিনিট সংসদ অধিবেশন মূলতবি করার প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু এবং তা গৃহীত হয়, ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অধিবেশনে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৫ মিনি যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শ করে। ৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে তিনি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাংলায় ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করার দাবি করেন। অনেক লড়াই সংগ্রামের পর অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এই জয় বাংলা ও বাঙালি সত্তাকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সরকার ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস, ভাষা শহিদদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দান, শহিদ মিনার নির্মাণে অর্থ সাহায্য করে। শুধু তাই নয় বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে ১লা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের পদক্ষেপগুলো তখন গৃহিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ও ১লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের দিন হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একুশের প্রথম কবিতা 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখিত শহিদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত অমর সৃষ্টি 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি সমগ্র জাতিসত্তাকে নাড়া দেয়। ভাষার সংগ্রাম চলার মাঝেই ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানিরা। তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় রবীন্দ্র চর্চায়। এর বিরুদ্ধেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনে লড়াই হয়। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীকে ধরে সংস্কৃতির লড়াই গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলগুলোর মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়। সে সময়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে- বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। আইয়ুবের সামরিক শাসনসহ বাংলা ও বাঙালির গণসংগ্রামে সংস্কৃতি কর্মীরাও বঙ্গবন্ধুকে আস্থায় নিয়ে এগুতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন শিল্পী সংগ্রামীদেরও নেতা। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তীতে ৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির ৬ দফা ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত নেতা। শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে ওঠে শেখ মুজিবকে রুখতে। মামলায় মামলায় জর্জরিত করে তোলা হয় তাঁকে। সর্বশেষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর অপচেষ্টা করে। কোনো কিছুই তাঁকে রুখতে পারেনি। শত অত্যাচারে বঙ্গবন্ধু নুয়ে পড়েননি। তিনি দৃঢ়তার সাথে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে নিয়েছেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনী ম্যান্ডেট তাঁকে সর্বব্যাপি তোলে। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহী না হয়ে বাঙালির মুক্তি, ও স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবায়নে বিভোর ছিলেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের পর রাষ্ট্রের ও আদালতের ভাষা কী হবে সে নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। আদালত পাড়ার দুর্ভেদ্য ভাষা নিয়েও কথা বলেছেন। বিচার আচারে যাতে বাংলা ভাষা ব্যবহার হয় সে কথা তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি ঘোষণা করছি, আমাদের ১৯৭১ বইমেলার অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষ চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে- সে হবে না।১০ এই আলোচনা থেকে পরিষ্কার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু বলতে তিনি বাংলাদেশ ভূখণ্ড এবং তার ভাষাকেই বুঝিয়েছেন। যার নিয়ামকই ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তিনি কথা রেখেছিলেন, মুক্ত স্বদেশে ফিরেই তিনি বাংলায় দাপ্তরিক কাজ শুরু করেছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে গৃহিত সংবিধান বাংলায় প্রণয়ন করেছেন। যেখানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের ক্ষেত্রে বাংলা প্রাধান্য পাবে। এখানেই শেষ ছিল না। জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর বাংলায় ভাষণ, ভাষা ও নবীণ রাষ্ট্রের মর্যাদাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ শহিদের স্বপ্ন বীজ আমাদের স্বাধীনতা। যা একজন উর্দি পরা আধা বাঙালির একদিনের এক বেতার ঘোষণা পাঠে আসেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কায়েমে বাঙালি জাতিকে নানা পর্বে নানা লড়াই করতে হয়েছে। যে লড়াইয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ভূমিকাই বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে প্রধান হয়ে উঠেছিল । তথ্যসুত্র: ১. ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- হারুন-অর-রশিদ, অন্যপ্রকাশ ২০২০ পৃষ্ঠা-২০ ২. অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান, পঞ্চম মুদ্রণ পৃ ৭৩ ৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান, পঞ্চম মুদ্রণ পৃ ৭৪ ৪. ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- হারুন অর রশীদ, অন্যপ্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০ পৃষ্ঠা ১১৭ ৫. ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- হারুন অর রশীদ, অন্যপ্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০ পৃষ্ঠা ১১৭ ৬. অসমাপ্ত আত্মজীবনী- শেখ মুজিবুর রহমান, পঞ্চম মুদ্রণ পৃ ৮৯ ৭. ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- হারুন অর রশীদ, অন্যপ্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০ পৃষ্ঠা ৭৮ ৮. ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- হারুন অর রশীদ, অন্যপ্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০ পৃষ্ঠা ১২৭ a. Secret Documents, Vol. 3 Page 359 ১০. বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন: ১৯৪০-১৯৮২, অধ্যাপক সাঈদ- উর-রহমান (ঢাকা: অনন্যা, ২০০১) পৃ. ১৪ ১১. মাতৃভাষায় বিচাকার্য, এস.এম. আব্রাহাম লিংকন, দৈনিক সমকাল ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পাতা-৯ ১২. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩. পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক- অমলেন্দু দে, পারুল প্রকাশনী, ৮/৩ চিন্তামণি দাস লেন, কলকাতা ১৪. পথরেখা স্বাধীনতার ৪০ বছর- সম্পাদনা নূহ-উল-আলম লেনিন এস. এম. আব্রাহাম লিংকন: গবেষক, সমাজকর্মী [একুশে পদক প্রাপ্ত] 
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিশ্বের মধুরতম ভাষা বাংলা, কী বলছে ফ্যাক্টচেক
বিশ্বের মধুরতম ভাষা বাংলা—বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন তথ্য বাংলাদেশি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারির আগে আগে এমন তথ্য ছড়ানোর যেন হিড়িক পড়ে। বিষয়টি শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমন তথ্য সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। এমনকি এটি নিয়ে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে আসছে। তবে বিষয়টি কী আসলেই তাই? এমন প্রশ্ন সামনে রেখেই একটি তথ্য-অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্টচেক। বার্তা সংস্থাটি জানিয়েছে, ‘ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে’—এই দাবি করে অনলাইনে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে তা ভুয়া। এমন কোনো র‌্যাংকিং কোনো দিন প্রকাশ করেনি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থাটি। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে এক পোস্টে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার লিখেছেন, ‘বাঙালিদের অনেকেই বাংলা যে পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে সেটি নিয়েও সন্দেহ করে। ওরা কি ধরনের বাংলা ভাষাভাষী।’ এই পোস্টের সঙ্গে তিনি একটি গণমাধ্যমের সংবাদের লিংক শেয়ার করেন। সংবাদটির শিরোনাম নাম হলো ‘বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বাংলা’। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ‘২০১০ সালে ইউনেস্কোর একদল ভাষাবিজ্ঞানীর দীর্ঘ গবেষণার পর পৃথিবীর সবথেকে শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সেই তালিকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষা। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষা ধরে রেখেছে তার পূর্বের অবস্থান।’ এএফপি বলছে, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এমন তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ইউনেস্কোর একজন মুখপাত্র বলেছেন, সংস্থাটি কখনোই কোনো ভাষাকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি’ হিসেবে ঘোষণা করেনি। ইউনেস্কোর প্রেস প্রধান পোলিনা হুয়ার্ড এএফপিকে বলেছেন, আমাদের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যাচাই-বাছাইয়ের পর ইউনেস্কো কখনোই এই বিষয়ে জরিপ বা গবেষণা করেনি। এ ছাড়া ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট, ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা লিংকডইন অ্যাকাউন্টে এমন কোনো র‌্যাংকিং খুঁজে পায়নি এএফপি।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
X