ইআরএফের মতবিনিময় সংস্কারে শৈথিল্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঝুঁকি বাড়াবে
সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশ যত শৈথিল্য দেখাবে, মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তত বাড়বে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থেই বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কৌশল ব্যবহার করে। যদি এমন নিষেধাজ্ঞা আসেও, তা বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, দেওয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উদ্ধারের জন্য। তাই শ্রম পরিস্থিতিসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সুযোগগুলো বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বর্তমানে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তিনটি ক্ষেত্রে বড় সংস্কার করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কষ্টদায়ক হলেও এসব সংস্কার করতে হবে। তাতে অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য আসবে।
অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে ‘দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
অধ্যাপক মোস্তাফিজ রহমান বলেন, বাণিজ্যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে কি-না, এলে কোন পদ্ধতিতে আসবে, সেটি অনুমান করা কঠিন। আমরা দেখেছি, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো যেন আমরা যথাযথভাবে করতে পারি। সরকার, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকদের সমন্বয়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই সেগুলো আমরা করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের মূল দাবি ট্রেড ইউনিয়ন। তবে তারা এক দিনে সবকিছু চাইছেন না। তাদের পাশ কাটিয়ে কিংবা সঠিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সমস্যা বাড়ে। ফলে তাদের কথা শুনে সমস্যা সমাধানে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে-না করবে, তারা জানে। নিষেধাজ্ঞা দিতেও পারে। তবে আমরা যত শৈথিল্য দেখাব, ততই দেশটির আকাঙ্ক্ষা বাড়বে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন আয়কর আইন পাস করেছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে, তাই আইন পাস বা সংশোধন করা হয়েছে। এভাবে না দেখে বরং ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে একে দেখতে হবে। আইনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছু কিছু মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদের সদিচ্ছা লাগবে।
তিনি আরও বলেন, ডলারের দাম খোলাবাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ডলারের দামের ক্ষেত্রে শক থেরাপি দিতে হবে। হয়তো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ডলারের দামে বড় ধরনের সমন্বয় করলে পণ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোর মতো আর্থিক উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিতে হবে না। অন্যদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা বাড়বে। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার বিষয়ে মত দেন তিনি।
সরকারদলীয় প্রার্থীদের অর্থসম্পদ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদের পরিমাণ দেখে বিস্মিত, চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। এত কম সময়ে তারা এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদিও এক কোটি টাকার জমির দাম এক লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে হলফনামার থেকেও প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের প্রার্থীদের সম্পদের বিশ্লেষণ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার যে প্রার্থীদের এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যৌক্তিক, অযৌক্তিক, নাকি অনৈতিক।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট-সংক্রান্ত সিপিডি যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। এটা সিপিডির নিজস্ব কোনো গবেষণা নয়। তিনি বলেন, যারা সিপিডি ব্যাংক খাতের লোপাট হওয়া বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলেছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন, ব্যাংক খাত থেকে লোপাট হওয়া ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা কেবল আইসবার্গ বা একটি ছোট্ট অংশ। আসলে এটা আরও বেশি হবে। তিনি বলেন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি বলব সমস্যা যখন হয়, এটাকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা হিসাবে না দেখে সমস্যাটার আদৌ যৌক্তিকতা আছে কি না এবং কীভাবে এটা সমাধান করা যায়, সেটা করা উচিত।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা অনিয়ম চলছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়েছে। এখন আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা মার্জার করার বিষয় আগেই অনেকবার বলা হয়েছে। এজন্য আইনি দুর্বলতা ও নিয়মনীতিগুলো ঠিক করতে হবে। কারণ ব্যাংক খাত হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। এ খাতের সমস্যা পুরো অর্থনীতির ওপরে পড়ে।
তিনি বলেন, ঋণ অবলোপনসহ নানা কায়দায় মওকুফ করার পরও এই সরকারের ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে একটি বড় অংকের অর্থ ব্যাংকের প্রভিশনিং করতে হচ্ছে। এর মানে টাকাটা অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, ব্যাংকে পড়ে থাকছে। এতে করে একদিকে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আয় কমে যাচ্ছে। এটা আবার বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে।
ব্যাংকিং সেক্টরের এ অবস্থা একটি ‘দুষ্টুচক্র’ সৃষ্টি করছে জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ খাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সবকিছুই এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। এটা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এখানে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আগামীতে এ খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে এ উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পকে এ পর্যায়ে এনেছে। পোশাকের বিশ্বের বাজার ৭০০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এত বড় খাত অন্য একটাও নেই। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে, নতুন বাজারে যেতে হবে। তবে এ খাত বাদ দিয়ে নয়। কারণ এখনও এই বাজারের অনেক বড় অংশ দখল করার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য আমাদের আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের চামড়া খাত ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। বিশ্বে ফার্মাসিউটিক্যালে অনেক বড় বাজার আছে বলেও জানান সিপিডির এ সম্মানীয় ফেলো।
সম্পাদনা: রাসেল
২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩