নারী কৃষকের ঋণে বাধা জমির মালিকানা
পাবনার ঈশ্বরদীর বক্তারপুর গ্রামের ঝর্ণা খাতুনের স্বামী পেশাগত কারণে ভিন্ন শহরে থাকেন। পারিবারিক জমিজমায় চাষাবাদের কাজটা তাই ঝর্ণাকেই করতে হয়। দীর্ঘদিন একটি এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। নিজের আয়ে পরিবারের জন্য কয়েক বিঘা জমিও কিনেছেন। কিন্তু সব জমির কাগজপত্র স্বামীর নামে থাকায় ব্যাংক থেকে কৃষিঋণ পাচ্ছেন না তিনি।
ঝর্ণা খাতুন জানান, ঋণের জন্য বারবার যোগাযোগ করলেও ব্যাংক থেকে সাড়া পাইনি। পুরুষ কৃষকরা ব্যাংকের ঋণ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি নানা সহায়তা পান। অনেক সময় সেসব সহায়তার জন্য লটারির মাধ্যমে নাম ঠিক করা হয়। কিন্তু সেখানে নারীদের বাদ রাখা হয়।
শুধু ঝর্ণা খাতুন নন, সারা দেশে বেশিরভাগ নারী কৃষকের অবস্থাই এমন। কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়লেও ব্যাংকে ঋণ পেতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০১৭ সালের জরিপে তা বেড়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।
কৃষিতে নারীর অবদান: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘কৃষি ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা ২০২৩’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষিতে ২০০৫ সালে নারীর ভূমিকা ছিল ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৯ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়ায়। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বিশ্বে এটিই সর্বোচ্চ। পুরুষরা চাকরি ও ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়ায় কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, চাষের জন্য জমি উপযোগী করে গড়ে তোলা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা এবং বাজারজাতকরণের আগ পর্যন্ত কৃষি খাতে ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭টিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। বলা হয়, দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এতে দেশের গ্রামীণ নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শস্য উৎপাদন থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের প্রায় কাছাকাছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের অবদান ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। পারিবারিক গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ এবং শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদনে মূল ভূমিকা তাদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপেই কৃষিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে চালু হওয়া সরকারের বাণিজ্যিক কৃষি কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক। প্রশিক্ষণ পেয়ে নারীরা কৃষিতে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বসতবাড়ির আঙিনায় ও আশপাশে ফল উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালনে উৎসাহিত করার কারণেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।’
কৃষিঋণে নারী কৃষকের বঞ্চনা:
কৃষি অর্থনীতিতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও কোনো ক্ষেত্রেই এর স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন নেই। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে কৃষক কার্ড বিতরণ করা হলেও সেই তালিকায় নারী কৃষকের জায়গা হয় না। একইভাবে কৃষিঋণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন নারী কৃষকরা। ফলে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে কৃষি উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত জমির মালিকানা না থাকার কারণেই ব্যাংকগুলো নারী কৃষককে ঋণ দিতে চায় না। কৃষি কার্ড, ভর্তুকিসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে একই প্রতিবন্ধকতা। ব্যক্তি উদ্যোগে ফসলের জন্য জমি লিজ ও বর্গা নেওয়ার ক্ষেত্রে চুক্তি হয় পুরুষের সঙ্গে। ফলে এক পরিবারের দুজনে মিলে কাজ করলেও পুরুষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই কৃষি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন নারী।
মূল বাধা জমির মালিকানা:
জানা গেছে, দেশে কৃষকদের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কাগজপত্রের চাহিদা না থাকলেও জমির দলিল ও খাজনা পরিশোধ বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেশের যে কটি খাতে চরম বিশৃঙ্খলা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জমি-জমার রেকর্ড। নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও বিশৃঙ্খল। এ ছাড়া সমাজেও নারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রবণতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীকে জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনীহা আছে। ফলে অনেক নারী জমির প্রকৃত ও বৈধ দখলদার হওয়া সত্ত্বেও শুধু দলিলের অভাবে ঋণ নিতে পারেন না।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট শাখার ম্যানেজার মো. হাতেম আলী বলেন, ‘ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক সব সময় নারীদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু তারা অনেক সময় জমিজমার কাগজপত্র দেখাতে না পারায় ঋণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।’
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রান্তিক নারী কৃষকরা কৃষিঋণ পাচ্ছেন না। কৃষিঋণ ছাড়াও কৃষকদের দেওয়া সরকারি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত।
এই পরিস্থিতি অবহিত করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সমুন্নয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. আতিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, কৃষি এ দেশের অর্থনীতির রক্ষাকবচ। কৃষি ভালো করলে পুরো অর্থনীতি ভালো চলে। এই খাতে নারীর অবদান যত বাড়বে, অর্থনীতিও তত চাঙ্গা হবে। কৃষি উৎপাদনে নারীরা যাতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের সহায়ক পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী কৃষক তার প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছেন কিনা—সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জোরালোভাবে মনিটরিং করতে হবে।
নারী কৃষকদের নামে জমির দলিল না থাকায় তারা ঋণ পাচ্ছেন না—এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সহজ করে দিতে পারে। এজন্য বিশেষ নীতিমালা জারি করতে পারে। যেমন, নারীদের নামে জমির দলিল না থাকলেও তাদের আয়-রোজগার আছে কি না, তারা নিয়মিত লেনদেন করেন কি না, মোবাইল ব্যাংকে তাদের নিয়মিত লেনদেন হয় কি না, তারা ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবেন কি না—সেটা যদি বোঝাতে পারেন, তাহলে তো তাকে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছু গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। সেইসঙ্গে কৃষকদেরও সচেতন করতে হবে যে, এভাবে ঋণের আবেদন করলে সেটা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে হয়তো খুব বড় ঋণ দেওয়া যাবে না, তবে ছোট অঙ্কের ঋণ দিতেই পারে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্যারান্টি চায়। শুধু জমির দলিলকেই গ্যারান্টি হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে গ্রামীণ নারীরাও শিক্ষিত হচ্ছেন। তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। জমির দলিলের পরিবর্তে এসব প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেটকেও কো-লেটারেল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘শুরুতেই কেউ বড় অঙ্কের ঋণ নেন না। প্রথমে ছোট ছোট ঋণ নেন। এসব লেনদেন দেখেও ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ বিষয়ে সরকারকেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে বেসরকারি খাত এবং ব্যাংকগুলোকে যুক্ত করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় নেই বিশেষ ব্যবস্থা:
প্রতিবছরই কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কৃষি নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে কৃষি খাত সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারে। সেই লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গত (২০২২-২৩) অর্থবছরে ৩৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ জন কৃষককে মোট ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
কৃষিঋণ নীতিমালায় এ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষিপণ্যে বৈচিত্র্যকরণসহ নানা বিষয়ে বলা হলেও নারী কৃষকদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি নারী কৃষকদের ব্যাংক ঋণ দিতেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এই বিষয়ে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘নীতিমালায় নারীদের কৃষিঋণ দেওয়ার বিষয়ে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত। আগে তো সেটা ছিল। বিশেষ করে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের অন্তত ১৫ শতাংশ ঋণ নারী কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা বাধ্যতামূলক ছিল।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. নুরুল আমীন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে সবসময় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। তবে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে আলাদা করে দেখা হয় না। প্রকৃত কৃষক যেন ঋণ পায়, সে বিষয়ে জোরালোভাবে কাজ করা হচ্ছে।’
নারী কৃষকদের ব্যাংক ঋণের সুযোগ সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব কৃষককের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের ঋণের চাহিদা নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনেই নারী কৃষকসহ পুরুষ কৃষকদেরও তালিকা করে ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। সব ফসলে কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রণোদনার আওতায় প্রধানমন্ত্রী ৪ শতাংশ সুদে যে বরাদ্দ রেখেছেন, সেখানেও গত দুই বছরে বিভিন্ন জায়গায় মেলা করে নারী-পুরুষ উভয় কৃষকের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে ৮-১০টি ব্যাংককে একসঙ্গে করে একশ-দেড়শ কোটি টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছে।’
দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে নারী কৃষকসহ প্রকৃত কৃষক ও খামারিদের হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী প্রণোদনা, বিনা সুদে হয়রানিমুক্ত ঋণ, সরকারি সহায়তা প্রদানসহ বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে তাদের উন্নয়ন ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরও আগ্রহী হবেন এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরও বাড়বে। এজন্য কৃষিঋণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ৩০ শতাংশ ঋণ নারী কৃষককে দেওয়ার দাবি জানান তারা।
১০ আগস্ট, ২০২৩