বছরে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার মানুষের প্রাণ যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন তথ্যের বরাত দিয়ে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, দিনে মৃত্যু হচ্ছে ৬৪ জন মানুষের। দুর্ঘটনায় দিনে প্রতিবন্ধী হচ্ছে ২২০ জন মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ, আহত রোগীকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
সমিতির পক্ষে অন্য দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জানাতে এই তহবিলে আবেদনের বিষয়ে থানা, হাসপাতাল ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা; গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার ক্ষেত্রে স্পটে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া; হতাহতদের আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির আবেদন জমাদানের সময়সীমা দুর্ঘটনার তারিখ থেকে ১ মাসের পরিবর্তে ন্যূনতম ১ বছরের মধ্যে আবেদনের সুযোগ রাখা; তহবিলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, মালিক শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবমুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া; সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিলে বাস মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং সিসি ক্যামেরা পদ্ধতিতে ই-ট্রাফিকিং প্রসিকিউশন সিস্টেম চালু করা। চালক ও মালিকের ব্যাংক হিসাব থেকে অটো জরিমানা আদায়ের পদ্ধতি চালু করা। বর্তমানে নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ ও আহতদের ক্ষেত্রে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের সহসভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব এম. মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, কেন্দ্রীয় নেতা মো. মহসিন প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রোড সেইফটি ইউনিট গঠিত হলেও মূলত তারা টিভি মিডিয়ায় কথা বলা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে নানা ইউনিট ও প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষায় কোনো বাজেট নেই। এই মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক নেই, গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানির তথ্য মিলেছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ আহত হচ্ছেন।
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্যমতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫.৩ শতাংশ।
তিনি বলেন, দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে।
বুয়েটের এআরআইর হিসাব বলছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সেটিকে জনসংখ্যা বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে।
পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে নিহতদের ৫১ শতাংশ একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি।
মন্তব্য করুন