সুপারিশসর্বস্ব ইউজিসি
দেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে একের পর এক সুপারিশ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সুপারিশগুলো আমলে নেয় না সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর একই সুপারিশের পুনরাবৃত্তি করা হয়। আইনি ক্ষমতা না থাকায় এ ক্ষেত্রে শক্ত কোনো পদক্ষেপও নিতে পারে না সংবিধিবদ্ধ সংস্থাটি। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইউজিসি অনেকটা সুপারিশসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ইউজিসির সর্বশেষ চার বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, উন্নত গবেষণার জন্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও গবেষণার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার জন্য তিন বছর ধরে সরকারের কাছে সুপারিশ করে যাচ্ছে ইউজিসি। তবে এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনোরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সম্প্রতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে ২০২২ সালে ইউজিসির নিজস্ব কর্মকাণ্ড ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম এবং উচ্চশিক্ষার সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ১৪টি সুপারিশ করেছে কমিশন। এর অধিকাংশই কয়েক বছর ধরে বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ কম থাকায় ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা থাকলেও আমলাদের কারণে অনেক সুপারিশই বাস্তবায়ন হয় না। ইউজিসি সুপারিশ করে; কিন্তু মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সেই ফাইল অন্য ফাইলগুলোর মতোই ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। আমলারা চান ইউজিসি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকুক।’
তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, কাজের পরিধিও বেড়েছে; কিন্তু ইউজিসির ক্ষমতা বাড়েনি। সে কারণে ১৯৭৩ সালের আইন সংশোধন করে ইউজিসিকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া এখন অতি জরুরি।’
গত কয়েক বছরে ইউজিসির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য খ্যাতনামা শিক্ষকদের ‘পুল’ গঠন, আন্তর্জাতিক আদলে দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং চালু করা এবং ‘স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন: ২০১৮-২০৩০’ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত চারটি ছাড়া দেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের নীতিমালা নেই। ইউজিসির সুপারিশে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতামত গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উঠে আসে। একই প্রতিবেদনে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রবর্তন; ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা; গবেষকদের প্রণোদনাসহ উৎসাহ দেওয়া; বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাডেমি-ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
এর আগে ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনের সুপারিশেও এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো ও গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়। আর ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি রোধে নীতিমালা এবং উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে ইউজিসির মতামত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া আগের তিনটি বার্ষিক প্রতিবেদনে সান্ধ্য কোর্স বন্ধের সুপারিশ থাকলেও এবারের (৪৯তম) প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করা হয়নি।
এর বাইরে ইউজিসির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে কমিশনের জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, তরুণ গবেষকদের জন্য বিশেষ পুরস্কারের (ইয়াং রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড) ব্যবস্থা করা, পিএইচডি বৃত্তির আর্থিক পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ইউজিসি তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ইউজিসির সিদ্ধান্ত মানতে চাচ্ছে না। এর ফলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা ভোগ করার কথা থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের শিক্ষায় ঘাটতি থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এ ধারণা দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবার জাতীয় উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘ইউজিসি যেসব সুপারিশ করেছে, তার সবই যৌক্তিক। সংস্থাটি তাদের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার আলোকে সুপারিশগুলো করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে। বিগত সময়েও ইউজিসি সময়োপযোগী কিছু সুপারিশ করেছিল; কিন্তু আমলাতন্ত্রের চাপের কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো তাই হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করা প্রয়োজন, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত থাকবে। অর্থাৎ ইউজিসির ক্ষমতায়ন করতে হবে। তার মানে এই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর অযাচিত নিয়ন্ত্রণ করবে ইউজিসি। এর মানে হলো ইউজিসিকে ক্ষমতা দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে।’
সাবেক এ উপাচার্য বলেন, ‘জাতীয় বাজেটে উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো, গবেষণায় প্রণোদনা দেওয়া ও বরাদ্দ বাড়ানো এগুলোর তো অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। সামান্য গবেষণা দিয়ে সৃজনশীল কোনো কিছু করা যায় না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা লাগবেই। এ খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা যে কোনো বিষয়ে পূর্ণ প্রশিক্ষণ পাবে না। এর ফলে ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা বাইরের দেশ থেকে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে আসছে। এসব কারণে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবোরেশন ঠিকমতো হচ্ছে না। যার ফলে দেশের বিপুল পরিমাণ জনশক্তি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও শিক্ষিত বেকার হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চৌর্যবৃত্তি করেও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ও পদোন্নতি পাচ্ছে। এটি রোধ করতে হবে। সেজন্য ইউজিসির সুপারিশ অনুযায়ী নীতিমালা করতে হবে। কেউই চায় না বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালী হোক, গুণগত মানসম্পন্ন হোক। আমলারা চান না, রাজনীতিকরাও চান না। এখানে নিশ্চয়ই তাদের কোনো স্বার্থ রয়েছে।’
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের সব স্তরে প্রস্তাব বা সুপারিশ বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি আছে। যেমন চৌর্যবৃত্তি রোধে নীতিমালার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল গঠনেও অগ্রগতি আছে। এগুলো আগামী ছয় মাসের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে। কিন্তু ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।’
ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান কালবেলাকে বলেন, ‘সুপারিশগুলোর মধ্যে কিছু হয়তো তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন সম্ভব। আবার কিছু সুপারিশের বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। সে ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে ‘আমলাতন্ত্রের চাপে’ সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না—এটা বলার সুযোগ নেই। তাদের কোন কোন সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪