মাশরুম চাষ বাড়ালে বাড়বে পুষ্টি, কমবে দারিদ্র্য
মাশরুম খেতে সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এটি শরীরের জন্যও বেশ উপকারী। কম ক্যালোরি ছাড়াও এটি অনেক পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। সালাদ, স্যুপ, সবজি এমনকি স্ন্যাকস হিসেবে এটি খাওয়া যায়। মাশরুম টিউমার নিরাময় করে, উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে। তবে মাশরুমের এসব গুণাগুণের তেমন প্রচার নেই। ফলে এতদিনেও মানুষের কাছে তেমন কোনো চাহিদা তৈরি হয়নি মাশরুমের।
পুষ্টিগুণ বিবেচনায় খাদ্যাভাসে মাশরুম যুক্ত করে প্রত্যেকে গড়ে প্রতিদিন ২৫ গ্রাম করে মাশরুম খেলেও বছরে ১৫ লাখ ৫১ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। আর ১০ শতাংশ মানুষও যদি মাশরুম খায়, তাহলে প্রতিদিন ৪৫০ মেট্রিক টন মাশরুম প্রয়োজন হবে। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু টিউমার, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিক রোগী যদি নিয়মিত ৫০ গ্রাম করে মাশরুম খান, তাহলেও বিপুল পরিমাণ মাশরুম প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে মাশরুম উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
ঢাকার সাভারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও ৩৪টি মাশরুম উপকেন্দ্র বা হর্টিকালচার সেন্টার এবং দেশের ৬৪টি জেলার ১৬০টি উপজেলা ও ১৫টি মেট্রোপলিটন থানায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৭ সাল পর্যন্ত ‘মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে মাশরুম উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া মাশরুম উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের জনপ্রিয় বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা এবং এসব জার্মপ্লাজমের বাংলাদেশে চাষ ও সংরক্ষণ উপযোগী লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা; মান নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টিপূর্বক উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন মাশরুম ও মাশরুমজাত পণ্য উৎপাদন প্রযুক্তি বা কৌশল সম্প্রসারণ করা; দারিদ্র্য হ্রাসকরণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে মাশরুম শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের মডেল ‘মাশরুম পল্লি’ কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারণ করা; মাশরুম ও মাশরুমজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীসহ সব স্তরের মানুষের খাদ্য, পুষ্টি ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করা এবং মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তা তৈরি; মাশরুম পল্লি স্থাপন; গবেষণা কার্যক্রম যেমন জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন; স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী স্থাপন; ছাদ প্রদর্শনী স্থাপন প্রভৃতি। এ ছাড়া সাধারণের খাবার টেবিলে মাশরুম পৌঁছে দিতে প্রকল্পের প্রচার কার্যক্রম।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাশরুম উৎপাদন বৃদ্ধির নিমিত্তে বিশ্বের জনপ্রিয় বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের (যেমন বাটন, ইরিনজি, ব্ল্যাক, চেজনাট, বিপিও ইত্যাদি) ইতোমধ্যে ৮টি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব জার্মপ্লাজমের বাংলাদেশে চাষ উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ইতোমধ্যে অনেকে চাষ শুরু করেছে, যেমন গাজীপুরে ভূঁইয়া মাশরুম ও রাঙামাটিতে সুমেধ চাকমা। দেশে মাশরুমের ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি, ভোক্তা তৈরির লক্ষ্যে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাশরুম যুক্ত করতে আঞ্চলিক কর্মশালা, মাঠ দিবস, উঠান বৈঠক, টিভি প্রোগ্রাম, বিলবোর্ড স্থাপন ইত্যাদি করা হয়েছে।
প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মাশরুমের প্রচার এবং বিপণন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে অনেক উদ্যোক্তা মাশরুমের উৎপাদন এবং মাশরুমজাত পণ্য তৈরি করতে শুরু করেছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পভুক্ত এলাকা, ১৪টি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, ৬৪টি জেলার উপপরিচালকের কার্যালয়, বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টার এবং ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান যথা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, হর্টিকালচার সেন্টার ফলবীথি আসাদগেট, মেট্রোপলিটন কৃষি অফিস সংলগ্ন স্থানে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত মাশরুম এবং মাশরুমজাত পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিমার্ট, স্বপ্ন, আগোরা, ফার্স্ট চয়েস ইত্যাদি সুপারশপের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সংযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বিপণন ও প্রচার কার্যক্রম জোরদার করতে মাঠ দিবস ও আঞ্চলিক কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ছাড়াও বিভিন্ন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি,
স্কুল-কলেজের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ বেতার, রেস্টুরেন্টের প্রতিনিধিকে যুক্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় জনগণের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে এবং মাশরুমের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে স্পন ও মাশরুম উৎপাদন প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ১৮০ জন উদ্যোক্তা ও তার আওতায় ৩০ জন করে দলভুক্ত চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তার ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে, যাতে উদ্যোক্তাকে প্রতিনিয়ত সমর্থন দিতে পারেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, মাশরুমের গুণাগুণ, সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ফলে দেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মাশরুম রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি, নতুন মাশরুম উপকেন্দ্র স্থাপন, পুরোনো উপকেন্দ্র ও মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশে ভূমির ভার্টিক্যাল এক্সপানশন বৃদ্ধি পাবে। এতে মাশরুম চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
০৪ মে, ২০২৪