ঢাকা দক্ষিণে ৫ হাজার কোটির ৫৮ একর জমি দখলমুক্ত
গত চার বছরে বেদখল হয়ে যাওয়া প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধার করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এসব জমি যুগের পর যুগ দখলদাররা ভোগ করে আসছিলেন। কিছু কিছু জমির ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে উচ্ছেদ নিষেধাজ্ঞা এনে প্রভাবশালীরা কবজায় রেখেছিলেন। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা এসব জমির পরিমাণ প্রায় ৫৮ একর।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মান্ডা, নন্দীপাড়া, লালবাগ, গোড়ান, মেরাদিয়া, হাজারীবাগ, মতিঝিল, রমনা, সূত্রাপুর, মাতুয়াইল, ধানমন্ডি, রাজারবাগ, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, হাজারীবাগ, ধলপুর, কামরাঙ্গীরচর, ওয়ারি, দনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা এবং দখলদারদের বিতাড়িত করে এসব জমি কবজায় নেয় করপোরেশন। সেখানে খাল, সড়ক ও মাঠ সম্প্রসারণ, কাঁচাবাজার, কমিউনিটি সেন্টার, এসটিএস, মার্কেট, নর্দমা, পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজও শুরু করেছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও শুধু হোল্ডিং ট্যাক্স বা গৃহকর আদায় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। কর বাড়ালে রাজধানীর ১ কোটি ৩০ লাখ নাগরিককে সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটিকে নগরবাসীর নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো। তাই কর না বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের নতুন খাত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। মোবাইল টাওয়ার, ফ্লাইওভার, বাজার নিবন্ধন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নিয়োগ থেকে আয়, ভাগাড় থেকে আয়, পশুর ওপর কর ধার্য করার মতো নতুন ১৪টি রাজস্ব খাত সৃষ্টি করা হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫২৪ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হলেও তিন বছর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ১ হাজার ৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। পরের অর্থবছরে ৮৭৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণ করে এই নগর সংস্থা।
স্থানীয় সরকারের অন্যান্য সংস্থাকেও নিজস্ব আয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আপনি একটি পরিকল্পনা করলেন; কিন্তু টাকার জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। টাকা আপনি পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। এতে কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। এখন দক্ষিণ সিটির নিজেদের কাজের জন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে পারবে।’ তিনি বলেন, উন্নয়নের ভাগ যাতে সব ওয়ার্ড সমানভাবে পায় সেটি খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে নাগরিকরা কর দিতে আরও আগ্রহী হবে। এতে সিটির আয় আরও বাড়বে।’
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে করপোরেশনে জনবলের সংকট দূর করতে ৮৭৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২১৭ জনের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান। গত চার বছরে ডিএসসিসি নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র, খাল-নর্দমা-বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ, সড়ক সংস্কার ও নির্মাণ, জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কারসহ অনেক কার্যক্রম নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
ঢাকার ঐতিহ্যকে পূর্ণরূপে ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরে ঐতিহাসিক ঢাকা ফটক অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। সংস্কার শেষে পুরোনো জৌলুশে ফিরিয়ে মোগল নিদর্শনটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী লালকুঠির সংস্কারকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলদারের কবলে থাকা নলগোলা ভাওয়াল রাজবাড়ী দখলমুক্ত করা হয়েছে। গেজেটভুক্ত ৬৬টি স্থাপনাসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে সাতটি ঐতিহ্য বলয় সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খেলাধুলায় ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ধুপখোলা আন্তর্জাতিক খেলার মাঠ ও গোলাপবাগ খেলার মাঠসহ ১১টি খেলার মাঠ সংস্কার ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৯টি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করে তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। তিনটি সামাজিক অনুষ্ঠানকেন্দ্রের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। ১৫টি ওয়ার্ডে নতুন সামাজিক অনুষ্ঠানকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ৩৩টি ওয়ার্ডে নতুন সামাজিক অনুষ্ঠানকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাঁচটি নতুন কাঁচাবাজার নির্মাণ কাজ চলমান এবং চারটি ওয়ার্ডে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মজীবী মানুষ বিশেষত নারীদের সুবিধার্থে গত চার বছরে ৩৬টি গণশৌচাগার নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে।
ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনী রূপরেখার মূল প্রতিপাদ্য সুশাসিত ঢাকা গড়তে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকে কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমন করেছি। গণতান্ত্রিক ধারায় স্থায়ী কমিটিগুলো গঠন ও প্যানেল মেয়র নিয়োগ দিয়েছি। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের নীতি অবলম্বন করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। পাশাপাশি করপোরেশনের জন্য নিবেদিত ও সততার সঙ্গে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের পুরস্কৃত করেছি। তিনি বলেন, প্রতি বছর আমাদের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর ঢাকাবাসীর আস্থা বেড়েছে। এই আস্থার ওপর ভিত্তি করে সুশাসন নিশ্চিত করে উন্নত ঢাকা গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
১৮ মে, ২০২৪