সমন্বিত পদক্ষেপে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব
মানুষের জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান বাতাস আজ দূষিত হয়ে মানুষের অকাল মৃত্যু ছাড়ায় নানারকম রোগব্যাধির সৃষ্টি করছে। বছরের বেশিরভাগ সময়ে ঢাকার বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) যা থাকে তা সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’। শীতকালের শুরু থেকেই রাজধানী ঢাকায় আরও বেড়ে চলে দূষণের মাত্রা। ঢাকার বাতাসে দূষিত কণাবস্তু উপস্থিতির মাত্রা কখনো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ২৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের চেয়ে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা সবসময়ে অনেক বেশি থাকে, যা কখনো সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে ছয়গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাংলাদেশে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২৫) দূষণের প্রধান উৎস। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’-এর মতে, মানবদেহের জন্য দূষণের অসহনীয় উপাদান মাত্রা পিএম-২.৫ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মতে, ঢাকার বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ দায়ী নির্মাণকাজ (৩০ শতাংশ)। মানুষের প্রয়োজনে রাজধানীতে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। আর এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালি, সিমেন্ট খোলা ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর এবং নির্মাণকাজ চলাকালে অসতর্কতার কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে সূক্ষ্ম বিষাক্ত কণাবস্তু। এরপর বায়ুদূষণের শতকরা হারে রয়েছে ইটভাটা, যা মোট দূষিত পদার্থের ২৯ শতাংশ। রাজধানীর অনতিদূরে আইনের পরিপন্থি ইটভাটা নির্মাণের কারণে ভাটা থেকে লোকালয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসে প্রতিনিয়ত বিষ ছড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়া ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া গৃহস্থালির কাজ ও অন্যান্য উৎস থেকে বায়ুদূষণের হার ৯ শতাংশ করে। বর্জ্য পোড়ানো থেকেও ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ হতে পারে। এসব ধুলোবালির দূষিত অংশ বাতাসের নিম্নস্তরে ২০০-৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করে। রাজধানী ঢাকার বাতাসে মিশ্রিত আছে নানা ধরনের সূক্ষ্ম রাসায়নিক বস্তুকণাসহ কার্বন-ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার, অ্যামোনিয়া ও ফটো-কেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। এসব ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপক হারে নিঃসরণ শহরে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতায় পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। ২০২০ সালে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনার মধ্যে ছিল— ঢাকা শহরের মধ্যে বালু বা মাটি বহনকারী ট্রাককে ঢেকে পরিবহন করা, নির্মাণ সাইট ঢেকে রাখা, ঢাকার সড়কে পানি ছিটানো, মেগা প্রজেক্টের নির্মাণকাজে পরিবেশ আইন মেনে চলা, কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী গাড়ি জব্দ করা ও পুরোনো গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে প্রতিবেদন দাখিল, অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধ করা, মার্কেট ও দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর। এসব নির্দেশনার অনেকটাই আজও বাস্তবায়িত হয়নি। নির্মাণাধীন নতুন ভবন ও রাস্তাঘাট থেকে উৎপন্ন ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পকারখানাকে শহর থেকে দূরে স্থাপন, কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ শিল্পবর্জ্যের নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাসহ যানবাহনে সিসামুক্ত জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। ইটভাটা স্থাপন এবং ভাটায় চিমনি ব্যবহারের মাধ্যমে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়ম মেনে চলার নিশ্চয়তা বিধান আবশ্যক। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বায়ুদূষণ হচ্ছে এক ধরনের ‘সাইলেন্ট কিলার’। বাইরের দূষণ ছাড়াও ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ রোধে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। ঘরের ভেতরে দূষণে জন্মের প্রথম মাসে বিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বায়ুদূষণের কারণে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার, শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮৮ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র এবং আইসিডিডিআর,বি এক গবেষণার ফলাফলে জানায়, বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটির অধিক শিশু শরীরে ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। সেজন্য শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে অকালমৃত্যুর অন্তত ২০ শতাংশের জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের ফলে শারীরিক ও মানবিক প্রভাব নিয়ে তাদের গবেষণা মতে, রাজধানীতে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো মতে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বায়ুদূষণকারী বাংলাদেশে বায়ুদূষণের ফলে গড়ে সাত বছর করে মানুষ আয়ু হারায়। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ। ঢাকার বাতাস দূষণমুক্ত রাখতে বেশ কিছু আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ কম। বায়ুদূষণ রোধে নানা ধরনের প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ৬ নম্বর ধারার উপধারা (১) মোতাবেক, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন পরীক্ষা ছাড়া চালানো যাবে না। বিধি লঙ্ঘনকারীকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। ইটভাটা দূষণরোধ আইন বলছে, জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স না নিয়ে ইট প্রস্তুত করলে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বায়ুদূষণ কমাতে দেশে ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’ থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন প্রয়োগে বায়ুদূষণ রোধে কম প্রভাব পড়ে। বৃক্ষনিধনের জন্যও রয়েছে আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা, যার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। দূষিত বাতাস গ্রহণ করে অলক্ষ্যে মানুষ এমনকি গোটা জীবজগৎ মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর ভূমিকা অত্যাবশ্যক। বায়ুদূষণকে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি, বেসরকারি সেবাদানকারী সংস্থাসমূহের সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
০৬ জানুয়ারি, ২০২৪