ব্যয় বাড়িয়ে লোডশেডিং সামলানোর চেষ্টা
আজ রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হবে রোজা। এরই মধ্যে গরমকাল শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি চলছে সেচ মৌসুম। সাধারণত এ সময়ে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। দিন যত যাবে ততই বাড়বে চাহিদা। এ অবস্থায় রোজার মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ঠিক রাখতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু রাখার পরিকল্পনা করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে ব্যয় ও লোকসান অনেকটা বাড়লেও লোডশেডিং সামাল দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, রমজানে ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে হলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানোর বিকল্প নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির তথ্যমতে, এবারের রমজানে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গতকাল রোববার ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল প্রায় একশ মেগাওয়াট কম। এজন্য ঢাকা ও ময়মনসিংহে লোডশেডিং করতে হয়েছে। মূলত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে গত বছরের মতো এবারও রমজানে লোডশেডিং থাকছে।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন কালবেলাকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের স্বল্পতা তো রয়েছেই। তার পরও লোডশেডিং যাতে না হয়, বিশেষ করে ইফতার, তারাবি ও সেহরির সময় যাতে বিদ্যুৎ থাকে, সেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ট্রান্সমিশন সীমাবদ্ধতার কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। এবার সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ফার্নেস অয়েলনির্ভর কেন্দ্রগুলো চালানো হবে।’
পিডিবির সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পল্লবী জামান কালবেলাকে বলেন, ‘ফুয়েল ম্যানেজমেন্ট করে রোজার মাসে গ্রাহকদের কমফোর্ট রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য আমাদের তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ চাহিদার সময় চালাতে হবে। এতে করে খরচ বাড়বে, লোকসান বাড়বে। তার পরও চালাতে হবে।’
এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘তারাবি ও সেহরিতে লোডশেডিং হবে না। তবুও যদি সংকট হয়, তবে দিনের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে লোডশেডিং করা হতে পারে।’
এর পরই গত ৫ মার্চ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে ঢাকা ও ময়মনসিংহে লোডশেডিং হচ্ছে। গত শনিবার ময়মনসিংহে ৭৬ মেগাওয়াট ও ঢাকায় ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। এ সমস্যা আরও কয়েকমাস থাকবে। এখন কুমিল্লাতে বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে। ফেনীতে নির্মিত সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে। সেখান থেকে ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হলে কুমিল্লায়ও সমস্যা থাকবে না। এ ছাড়া মার্চ মাসের মাঝামাঝি দেশে এলএনজির কার্গো এলে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহও বাড়ানো হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, মার্চ-এপ্রিলে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের চাহিদা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা ন্যূনতম ১ হাজার ৫৪০ মিলিয়ন ঘনফুট হতে পারে। এ ছাড়াও ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টন এবং ডিজেলের চাহিদা ১৫ হাজার ৬০০ টন হতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে ন্যূনতম দুই মাসের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের মজুত নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুকেন্দ্রগুলোর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৩ পয়সা, কয়লায় ১১ টাকা ৫১ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ২৩ টাকা ৪২ পয়সা এবং ডিজেল ৩৯ টাকা ৭২ পয়সা। আর পিডিবির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসে ৫ টাকা ৮৩ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ৩৯ টাকা ৩ পয়সা এবং ডিজেল ৮৯ টাকা ২৩ পয়সা ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ হবে। মূলত দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।
বর্তমানে দেশের বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার ৪৮১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১০ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট গ্যাসনির্ভর, ফার্নেস অয়েল নির্ভর ৬ হাজার ১৯১ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক ৪ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট, ডিজেলে ৮২২ মেগাওয়াট, নবায়নযোগ্য ৬৮৯ মেগাওয়াট এবং আমদানি করা হয় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। শতাংশ হিসেবে মোট বিদ্যুতের ৪২ শতাংশ গ্যাস, ২৪ শতাংশ ফার্নেস অয়েল, ১৭ শতাংশ কয়লা, তিন শতাংশ ডিজেল, তিন শতাংশ নবায়নযোগ্য এবং আমদানি ১১ শতাংশ।
এদিকে, রমজানে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন দপ্তর, সংস্থা ও কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাসিক সমন্বয় সভায় রমজান মাসে বিশেষ করে সেহরি, ইফতার ও তারাবি নামাজের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় সেহরি, ইফতার ও তারাবি নামাজের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের জন্য বিতরণ সংস্থাগুলোকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মনিটরিংয়ের জন্য নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ব্যবহৃত ফোন ও মোবাইল ফোন নম্বর ও হটলাইন নম্বর ওয়েবসাইটে প্রকাশসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা।
বিতরণ সংস্থাগুলোর হটলাইন নম্বর হলো: পিডিবি-১৬২০০, পল্লী বিদ্যুৎ-১৬৮৯৯, ডিপিডিসি-১৬১১৬, ডেসকো-১৬১২০, ওজোপাডিকো-১৬১১৭ ও নেসকো-১৬৬০৩।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ ভবনে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে—যার টেলিফোন নম্বর: ০২-৪৭১২০৩০৯, মোবাইল নম্বর: ০১৭৩৯০০০২৯৩ ও হটলাইন নম্বর: ১৬৯৯৯। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে চলতি সেচ মৌসুম, রমজান মাস ও ঈদুল ফিতরের সময় সেচ পাম্পসহ সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি করা হবে।
১১ মার্চ, ২০২৪