কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৩৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে বিপ্লবের এক বছর পর হতাশায় পরিণত হলো আশা

সংগৃহীত ছবি।
সংগৃহীত ছবি।

এক বছর আগে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ছাত্রদের ওপর নির্মম দমন-নিপীড়ন চালানোর সময় রংপুর শহরে আবু সাঈদ সশস্ত্র পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে হাত প্রসারিত অবস্থায় সাহসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে আহত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এই অভ্যুত্থানেই শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। মূলত আবু সাঈদের মৃত্যুই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশকে অরাজকতার শেষসীমায় রেখে ভারতে পালিয়ে যান, তবে আশার আলোও ছিল।

ছাত্ররা বাংলাদেশ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন। তারা একটি বৈষম্যহীন এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক দেশ চেয়েছিলেন। এ আশায় তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ আসনে বসান। তিনি বাংলাদেশকে অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটি গ্রহণ করেছিলেন।

তবে অনেক বাংলাদেশি পরিবর্তনের ধীরগতি নিয়ে হতাশ। তারা ভাবছেন, আবু সাঈদের মতো প্রতিবাদকারীরা কি তাদের জীবন বৃথাই ত্যাগ করেছেন?

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলা দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংকট এবং প্রশাসনসহ বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত এসব সমস্যাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।

ছাত্ররা চাইছেন, গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়িত হোক। তারা চাইছেন, গত বছরের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় যেসব রাজনৈতিক দলের সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তারা জড়িত তাদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর হোক।

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, আমরা ভেবেছিলাম দেশ নৈতিকভাবে উন্নত হবে, বৈষম্য দূর হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে, আর সেই শাস্তি অপরাধীদের ভয় দেখাবে। কিন্তু এমন কিছুই ঘটেনি। যেটা আমাকে কষ্ট দেয়। তবে তার মতে, মুহম্মদ ইউনূস না থাকলে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপ হতো।

বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের সংস্কার করার ভার এখন ড. ইউনূসের কাঁধে এসে পড়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশে যেখানে এখনো বিভাজন রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল সক্রিয়।

ড. ইউনূসের প্রথম কাজ ছিল আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। বিপ্লবের পর লুটপাট, দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছিল। যদিও এখন বাংলাদেশ কিছুটা স্থিতিশীল। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, সরকার হিন্দু সংখ্যালঘু এবং শেখ হাসিনার সমর্থকদের ওপর সহিংসতার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কাজ করেনি। আর ইসলামি উগ্রবাদীরাও এখানে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছে।

ইউনূসের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল, একটি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা। যার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশ সংস্কারসহ ১১টি কমিশন নিয়োগ করেন। এর সামগ্রিক লক্ষ্য ছিল, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে যেসব প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এনেছিলেন সেগুলোর সংস্কার করা। কিন্তু এই সংস্কারের কমই বাস্তবায়িত হয়েছে।

আন্দোলনের সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন। তিনি বলেন, এখন সবকিছু যেন বিশৃঙ্খল মনে হচ্ছে। আমাদের স্বপ্নগুলো এখনো পূরণ হয়নি। এই শিক্ষার্থী জানান, ছাত্রনেতারা তাড়াহুড়োর মধ্যে পরিকল্পনা শুরু করেছিল, তা এখন ফিকে হয়ে আসছে।

গত সপ্তাহে ড. ইউনূস ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের পুনর্গঠিত ভোটিং সিস্টেমের অধীনে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধের কারণে এখনো অনেক বিষয়ে সমাধান করা বাকি রয়েছে।

শেখ হাসিনার পতনের বার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে ইউনূস বলেছেন, তার সরকার সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত একটি দেশ পেয়েছিল। তবে এটি ধীরে ধীরে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। তিনি জানান, তার সরকার নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইউনূসের ক্ষমতার অর্ধেক সময়ই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনা কেটে গেছে।

বিএনপি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ শক্তি হারানোর পর বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

দলটি জোর দিয়ে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে শুধু মুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত এবং অন্যান্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে রাখা উচিত।

তবে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামিক দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আরও সংস্কারের পর নির্বাচন চাইছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে রাজনৈতিক দিশা প্রধানত দুটি রাজনৈতিক বংশপরম্পরার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। দেশটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা। অপরদিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকা ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়া সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন লন্ডন থেকে তার ছেলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

এক সময় দুই প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়মিতভাবে ক্ষমতার দায়িত্ব একে অপরকে হস্তান্তর করত। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেষ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তারা সেটিকে নির্বাচনী জালিয়াতি বলে অভিহিত করেছিল। তবে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগই অনুপস্থিত থাকতে পারে, যেহেতু দেশের মধ্যে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলো গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বেরিয়ে গিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেন। গত জুলাই মাসে জনগণের সমর্থন জোগাতে তারা দেশজুড়ে পদযাত্রা করেন।

সব দলেই তরুণ ভোটাররা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর গড় বয়স প্রায় ২৬ এবং দেশের অনেক তরুণই এমন সময় বড় হয়েছে যখন তারা শুধু হাসিনার শাসনই দেখেছে।

ঢাকায় কাজ করা বাংলাদেশি-আমেরিকান থাহিতুন মারিয়ামের আশঙ্কা, আরেকটি সাধারণ সমস্যা ঠিকমতো সমাধান হবে না। সেটি হলো প্রথাগত সমাজে নারীদের অবমূল্যায়ন। তিনি বলেন, নির্বাচন এবং সংস্কার কেবল পুরুষকেন্দ্রিক, পুরুষ-প্রাধান্যশীল রাজনৈতিক বাস্তবতা পুনরায় তৈরি করবে।

যেসব নারী শিক্ষার্থী ২০২৪ সালের প্রতিবাদে দৃশ্যমান ভূমিকা নিয়েছিল তাদের এখন জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মারিয়ামের আশা, বাংলাদেশের নতুন গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রমাণিত হবে।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের বছর পূর্তির দিন ইউনূস ভাষণে বলেন, গত বছরের গণআন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের জাতীয় নায়ক হিসেবে গণ্য করা হবে এবং বাংলাদেশ শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা ও ছাত্র আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দেবে। এটি শুনে অনেক শ্রোতাই উল্লাস প্রকাশ করেন।

তবে এই উদযাপন ঢাকা পড়ে যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভে। কারণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের হত্যার দোষীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি এখনো পূর্ণ হয়নি।

আবু সাঈদ এই আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য শহীদ। যদি তার মামলা ঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশ কখনো ন্যায়বিচার পাবে কি? বললেন রমজান।

ট্রাইব্যুনাল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে হাসিনার বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে বিচার চালাচ্ছেন। গত সপ্তাহে তিনি ভারতে থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, যেখানে তিনি ছাত্র বিপ্লবকে কঠিনভাবে অর্জিত গণতন্ত্রের একটি সহিংস ব্যাঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে মানবাধিকার কর্মীদের কাছে। তারা বলছেন, নতুন বাংলাদেশে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, অস্থায়ী সরকার যেন আটকে আছে। বাংলাদেশের অপরিবর্তিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কখনো কখনো সহিংস ধর্মীয় চরমপন্থা এবং রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করার পরিবর্তে হাসিনার সমর্থকদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাংলাদেশে অর্থনীতি ধীর গতিতে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় অধিকাংশ দেশটির মানুষজনের দৈনন্দিন জীবনেও উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশ থেকে কমে ৪.২ শতাংশে নেমেছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফুটবল খেলা নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষ, নিহত ২

পাকিস্তানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত, পাইলটসহ সব আরোহী নিহত

রাবিতে কনসার্ট বাতিল করল আর্টসেল, নেপথ্যে ছাত্রলীগের হুমকি?

পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি

নেইমারের ভিলায় বাজল বাংলা গান

ইউক্রেনের হয়ে চুক্তি করতে আসিনি : ট্রাম্প

যারা বিলম্বে নির্বাচন চায়, তারা দেশের মঙ্গল চায় না : সালাম আজাদ 

কবুতরও ‘দুধ’ দেয় কিন্তু কীভাবে

ধোনিকে নিয়ে গুরুতর অভিযোগ শেবাগের

ওয়ার্ল্ড ভিশনে চাকরির সুযোগ, সপ্তাহে দুদিন ছুটি

১০

সৈকতে নেমেছিলেন চার বন্ধু, ঢেউয়ে ভেসে একজনের মৃত্যু

১১

সরকারি গাড়ি নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে প্রধান নির্বাহী

১২

দিল্লিতে মুঘল সম্রাটের সমাধিস্থলে ভবন ধস, নিহত ৫

১৩

জানুন মাথাব্যথার যত ধরন

১৪

লোহাগড়ায় এনপিপির উদ্যোগে খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকী পালন

১৫

জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন ৩ বাহিনী প্রধান

১৬

পানিবন্দি পুরো এলাকা, মরদেহ দাফনে চরম সংকট

১৭

খালেদা জিয়ার জন্মদিনে পথশিশুদের মাঝে ছাত্রদল নেতার খাবার বিতরণ

১৮

১৫ আগস্টের গণভোজ খেতে গিয়ে আটক ৩

১৯

সীমান্তে ভারতীয় মদসহ বিপুল চোরাই পণ্য জব্দ

২০
X