

দুদিনের ভারত সফরে এসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তার দেশ ভারতকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে প্রস্তুত। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল না কিনতে যুক্তরাষ্ট্র যখন ক্রমাগত ভারতকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যেই গতকাল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলেনে এসে পুতিন এ কথা জানান।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ভারত সফরে আসা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। তবে মোদি-পুতিন বৈঠকে যুদ্ধবিমান সরবরাহসহ কয়েকটি সামরিক চুক্তি হবে বলে মনে করা হলেও, সে ধরনের বড় কোনো চুক্তির কথা দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষণা করেননি।
ওই বৈঠক শেষে দুই নেতার সামনেই সংবাদ সম্মেলনে একাধিক সমঝোতাপত্র বিনিময় করেন ভারত ও রাশিয়ার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা। সব সমঝোতাই বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ, মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে কাজ করার জন্য ভারতীয় নাবিকদের প্রশিক্ষণ, নতুন জাহাজপথ গড়ে তুলতে বিনিয়োগ, বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাত ইত্যাদি ক্ষেত্রের সমঝোতা।
দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষ করে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নরেন্দ্র মোদি ও ভ্লাদিমির পুতিন। তবে তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন নেননি। সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে বক্তব্য দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি জানান, ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্ব পেয়েছ অর্থনৈতিক সহযোগিতা। তিনি জানান, ভারত ও রাশিয়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে। রাশিয়ায় ভারতের দুটি নতুন দূতাবাস খোলার সিদ্ধান্ত এবং দুটি নতুন পর্যটক ভিসা প্রকল্পও চূড়ান্ত হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বলতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত প্রথম থেকেই শান্তির পক্ষে থেকেছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে।
তার ভাষায়, ‘ইউক্রেন সংকটের পর থেকে আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত কথা হয়। আপনিও (পুতিন) প্রকৃত বন্ধুর মতো প্রতিটি বিষয় আমাকে জানিয়েছেন। এই পারস্পরিক বিশ্বাসই আমাদের সম্পর্কের বড় শক্তি। আমাদের সবার মিলিতভাবে শান্তির পথ খোঁজা উচিত। সম্প্রতি সেই প্রচেষ্টা চলছে। আমার ভরসা আছে যে, বিশ্ব আবারও শান্তির পথে ফিরে আসবে। আমি বারবার বলেছি যে, ভারত নিরপেক্ষ নয়। ভারতেরও পক্ষপাতিত্ব আছে এবং সেটা শান্তির পক্ষে। আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করব।’
তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে ভারত ও রাশিয়া দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে যাতায়াত বৃদ্ধি করা তাদের কাছে অতি গুরুত্ব পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন মোদি। পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে জ্বালানি নিরাপত্তা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
নরেন্দ্র মোদির পর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি প্রথমেই বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তার বেশ কয়েকবার টেলিফোনে আলোচনা হয়েছে। তার ভাষায়, ‘টেলিফোনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়। রাশিয়া আর ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত। আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিষয়সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আরও মজবুত হচ্ছে। আমাদের মধ্যে বাণিজ্য এখন রুবল আর ভারতীয় রুপিতে চলছে। আমরা মেড ইন ইন্ডিয়া পরিকল্পনাকে সহযোগিতা করব। লজিস্টিক রুট গড়ে তোলার জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। আমরা ভারত মহাসাগরের রুট নিয়ে কথা চালাচ্ছি।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জ্বালানি প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে পুতিন বলেন, তার দেশ ভারতকে জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে প্রস্তুত। এ ছাড়া ভারত যে বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে, তাতেও রাশিয়া সহযোগিতা করছে বলে জানান তিনি। তামিলনাডুর কুদানকুলামে ভারতের এই বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গড়া হচ্ছে।
পুতিন জানান, ছয়টির মধ্যে দুটি ইউনিট এরই মধ্যে বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, বাকি চারটি নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে। পুরোপুরি কাজ শুরু করলে এটি ভারতের স্বচ্ছ ও সাধ্যের মধ্যে মূল্যে বিদ্যুতের যে চাহিদা আছে, তাতে একটা বড় অবদান রাখবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট মডিউলার রিঅ্যাক্টর, ভাসমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ওষুধ ও কৃষিশিল্পের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করব।’ ভারতের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং যেসব সমঝোতা সই হয়েছে, তাতে রাশিয়া থেকে তার সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট বলে জানান রুশ প্রেসিডেন্ট।
দিল্লিতে পুতিনের কর্মব্যস্ত দিন: বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লির পালাম বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রথা ভেঙে তাকে বিমানবন্দরে একেবারে বিমানের দোরগোড়ায় গিয়ে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সময় পুতিনের সঙ্গে আলিঙ্গনও করেন তিনি। পরে বিমানবন্দর থেকে একই গাড়িতে বের হন মোদি ও পুতিন। পরে রাতে পুতিনকে রুশ ভাষায় অনূদিত একটি গীতা উপহার দেন মোদি।
গতকাল শুক্রবার সকালে প্রথমেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। সেখানে তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন ভারতের সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। এরপরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সমাধিস্থল রাজঘাটে গিয়ে তার স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পুতিন। তার পরই ছিল সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ—মোদি ও পুতিনের বৈঠক। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে এই বৈঠক শুরু হয় দুপুর ১২টার দিকে। এরপরে সেখানেই সাংবাদিকদের সামনে প্রথমে সমঝোতাপত্র বিনিময় করা হয় এবং পরে সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন দুই শীর্ষ নেতা। বিকেলে ভারত-রাশিয়া বিজনেস ফোরামের বৈঠকে যোগ দেন দুই শীর্ষ নেতা। এরপরে রাশিয়ার সরকারি টিভি চ্যানেল রাশিয়া টুডের দিল্লি সংবাদ ব্যুরো উদ্বোধন করেন পুতিন। সেখান থেকে তিনি আবারও ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান এবং সেখানে তার সম্মানে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রীয় ভোজে যোগ দেন। পরে রাতে দিল্লি থেকে নিজ দেশে রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন ভ্লাদিমির পুতিন।
মন্তব্য করুন