আগ্রাসী থাবায় বিপর্যস্ত দেশের নদনদী। সারা দেশে যে কোনো নদীর দিকে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট। দখল-দূষণে গত চার দশকে বিলুপ্তির মুখে দেশের ১৭৫টি নদী। এমন পরিস্থিতিতে দেশে নদনদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। বিশ্ব নদী দিবসে তা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেইসঙ্গে নদী দখল ও এর পেছনে থাকা প্রভাবশালীদের কথাও উল্লেখ করেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
গতকাল রোববার বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের নদনদী : সংজ্ঞা ও সংখ্যাবিষয়ক সেমিনারে’ দেশের নদনদীর সংখ্যা ও তালিকা প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। অনুষ্ঠানে ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, মেঘনায় এর আগে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছিল। যারা কাজটি করেছিলেন, উল্টো তাদের পানিশমেন্ট হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়। অনেককে স্ট্যান্ড রিলিজও করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আবার সেখানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। আর এখানে ভূমিকা রয়েছে এক নারী মন্ত্রীর। বালু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নদীকে বাঁচানো যাচ্ছে না। আর পেছনে আছে রাজনৈতিক শক্তি। চাঁদপুরের ওই নারী মন্ত্রী তাদের সহায়তা করেন। অথচ সেখানকার প্রান্তিক মানুষরা রাতে ঘুমাতে পারতেন না নদীভাঙনের ভয়ে। আবারও তাদের সে ভয়ের দিন আসছে।
মনজুর আহমেদ বলেন, গত বছর মেঘনা নদীতে বালু সন্ত্রাসীরা ছিলেন। তাদের ৩০০ ড্রেজারসহ উৎখাত করা হয়েছে। মেঘনায় যে বড় ইলিশ পাওয়া যায় তার একটা কারণ, এই বালু সন্ত্রাসী উৎখাত। সেখানে এডিসি ছিলেন দাউদ হায়দার চৌধুরী। একজন ইলিশ গবেষক ড. হারুন ছিলেন। তাদের সহযোগিতায় বালু সন্ত্রাসীদের উৎখাত করা হয়েছে; কিন্তু তাদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দাউদ হায়দারকে রাঙামাটিতে বদলি করা হয়, আর ইলিশ গবেষককে চিংড়ি গবেষণায় পানিশমেন্ট বদলি করা হয়।
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আবার সেই মেঘনায় বালু সন্ত্রাসী ফিরে এসেছে। গতবার এরা ৬৬৮ কোটি সিএফটি বালু চুরি করেছে। যার বাজারমূল্য সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ তাকে বলা হচ্ছে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার জেরে (চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে) ২৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে। এখন আবার ২০০ কোটি সিএফটি বালুর কথা বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নদীগুলো হায়েনারা দখল করে ফেলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ দখলদারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি, কিছু কিছু এনজিও কর্মী শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে আমাদের নদী রক্ষা কমিশনের পাশে কেউ নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহসী মেধাবী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা যখন কাজ করতে যায় রাষ্ট্রের সম্পত্তি জনগণের সম্পত্তি রক্ষায়—তাদের পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার করা হয়।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীদূষণমুক্ত করতে চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর গত জন্মদিনের মধ্যে। গত এক বছরের মধ্যে। আমার ধারণা ছিল—এটি প্রশাসনেরও দায়িত্ব, তারা এটি পালন করবে। ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছিলাম মন্ত্রণালয়ের কাছে, তারা তা দেয়নি। চিঠি লিখেছি, টাকা চেয়েছি প্রচারণার জন্য, তা হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার চারটি নদীকে রক্ষা করা। কিছুটা দখলমুক্ত করা গেছে; কিন্তু দূষণমুক্ত করা যায়নি। দূষণ আরও বেড়েছে, যার দায়িত্ব ছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের একটা রায় ছিল—শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা নদীকে ক্রিটিক্যাল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য, তারা তা করেনি। যার মানে হচ্ছে, পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। ঠিক পরিবেশগতভাবে আইসিইউতে যাওয়ার মতো অবস্থা। আজ দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বৃহত্তর এলাকায় যে ১৮টি নদীকে ইসিআই হিসেবে ঘোষণা করার কথা বলছি, এগুলো শীতকালে আর নদী থাকবে না। এসব বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে না।
পদ্মা নদীর বর্তমান অবস্থা জানাতে গিয়ে ড. মনজুর বলেন, মানিকগঞ্জ, হরিরামপুর গিয়ে দেখেছি তিনটি বালু সন্ত্রাসী গ্রুপ। তারা পদ্মা নদী কুরে কুরে খাচ্ছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। সেখানকার যারা সাহসী কর্মকর্তারা বাধা দিচ্ছে তাদের হাইজ্যাক করে নিয়ে যাচ্ছে। নৌ পুলিশের এক ওসিকে তারা বন্দি করে রাখছে।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, কর্ণফুলীকে টুকরো টুকরো করে লিজের নামে বিক্রি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ স্থানীয় জেলা প্রশাসক। যুক্ত আছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এ নদীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেজা চট্টগ্রামে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে। যেখানে সম্পূর্ণভাবে নদী এবং সিএস অনুযায়ী। তারা লিজও দিয়ে দিয়েছে। তারা নদীর ওপর অত্যাচার করছে, নদীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। তারা এখন বিভিন্ন কোম্পানিকে লিজ দিয়েছে। কর্ণফুলী নদী শুধু পরিবেশগতভাবেই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নদীর কাগজপত্র দিলেও মন্ত্রণালয় বলছে এটি নদীর অংশ নয়।
দেশে মোট নদনদী ১ হাজার ৮টি : দখল-দূষণে গত চার দশকে বিলুপ্তির মুখে দেশের ১৭৫টি নদী। এমন পরিস্থিতিতে দেশে নদনদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। বিশ্ব নদী দিবসে তা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। বর্তমানে সারা দেশে জীবন্ত নদনদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। তবে কমিশন বলছে, এ হিসাব চূড়ান্ত নয়। তাদের তথ্যমতে, দীর্ঘতম নদী পদ্মা। দেশের তিন বিভাগের ১২টি জেলায় প্রবাহিত নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার। আর সব মিলিয়ে দেশে ২২ হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ নদীপথ রয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক প্রধান হাইড্রোলজিস্ট আখতারুজ্জামান তালুকদার মূল প্রবন্ধে বলেন, দেশের প্রতিটি জেলার ওপর দিয়ে ২০টি নদী প্রবাহিত হয়। আর সর্বোচ্চ ৯৭টি নদী সুনামগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
নদীর সংখ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩০০ কিলোমিটারের ওপরে আছে দুটি নদী—পদ্মা ও ইছামতী। তৃতীয় বৃহত্তম নদী সাঙ্গু বা শঙ্খ। সবচেয়ে ছোট নদী গাঙ্গিনা যার দৈর্ঘ্য শূন্য দশমিক ০০৩২ কিলোমিটার। ২৮০ কিলোমিটারের ওপরে আছে পাঁচটি নদী। ২০০ থেকে ২৭৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আছে ৯টি, ১০০ থেকে ১৯৯ কিলোমিটারের মধ্যে আছে ৪২টি, পাঁচটি নদী আছে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। ১০ থেকে ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আছে ৪৮০টি নদী, ১ থেকে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আছে ৩৭৬টি, ১ কিলোমিটারের কম ৪১টি আর দৈর্ঘ্য সম্পর্কে তথ্য নেই ৫৫টির।
তবে গত ১০ আগস্ট নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত খসড়া তালিকায় নদনদী ছিল ৯০৭টি। তালিকার বিষয়ে কারও আপত্তি বা মতামত থাকলে তা কমিশনকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। কমিশনে জমা পড়া সব মতামত ও আপত্তি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে নদীর সংখ্যা বেড়েছে ১০১টি। কমিশন জানিয়েছে, এ তালিকায় নদীর সংখ্যা সংযোজন ও বিয়োজনের কাজ চলমান থাকবে।
তালিকা তৈরিতে তথ্যের প্রধান উৎস ছিল জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ছয় খণ্ডে প্রকাশিত নদনদীর তালিকা, সার্ভে অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত প্রশাসনিক ম্যাপ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) ম্যাপ মাধ্যমিক (সেকেন্ডারি) উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এ গবেষণায়। কমিশন জানিয়েছে, এ তালিকা তৈরির কাজে তাদের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। নিয়মিত দাপ্তরিক কাজের অংশ হিসেবেই এটি করা সম্ভব হয়েছে।
মন্তব্য করুন