হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বপ্নের মেগা সিটিতে কেন বিষাদ-ছায়া

স্বপ্নের মেগা সিটিতে কেন বিষাদ-ছায়া

মেগা সিটি বা অতিমহানগরী কেবল ইট-পাথরের ঠিকানা নয়, এগুলো হলো আশা আর স্বপ্নের মহাসাগর, যেখানে প্রতিনিয়ত কোটি মানুষ জীবনের স্রোতে নিজেদের পাল তোলে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে শুরু হয় এক নিরন্তর ছুটে চলা—প্রথম ট্রেনে ওঠা শ্রমিকের ব্যস্ততা, যানজটে আটকে পড়া শহুরে জীবনের দীর্ঘশ্বাস, আকাশছোঁয়া দালানের কাচে প্রতিফলিত অসমতার অদৃশ্য খিলান, সব মিলেই মেগা সিটির জীবন যেন এক বিরামহীন কবিতা। এ অতিমহানগরী দেয় শুধু অফুরান সুযোগ, টানে স্বপ্ন, তবু চেপে ধরে ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তার ভার। কোথাও দিগন্তজোড়া আলো, কোথাও আবার বায়ুদূষণের ঘন অন্ধকার। বহুতল অট্টালিকার চূড়া যেখানে আকাশ ছুঁতে চায়, সেখানেই নিচু বস্তিতে জমে থাকে বঞ্চনার ধুলো। যান্ত্রিক জীবনের কোলাহলে ঢাকা পড়ে যায় নদীর কান্না, দূষণের ধোঁয়া ঢেকে দেয় ভোরের স্নিগ্ধতা। মেগা সিটি তাই কেবল উন্নয়নের ইঞ্জিন নয়; এটি সুযোগ ও সংকটের এক জটিল মহাকাব্য। তবুও নগরায়ণের ঢেউ থামে না; মানুষের বিশ্বাস—আবারও নতুন ভোর ফুটবে, আবারও উঠে দাঁড়াবে শহর। উন্নয়ন আর চ্যালেঞ্জের এ দ্বন্দ্বে মেগা সিটি হয়ে ওঠে একদিকে সম্ভাবনার দ্বার, তবুও এর বাঁকে বাঁকে ওতপেতে থাকে অন্ধকার। মেগা সিটি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের আলোকে লিখেছেন হুমায়ূন কবির

জীবন-জীবিকার সন্ধানে, শিক্ষার সুবিধাসহ অপেক্ষাকৃত উন্নত নাগরিক সুবিধা পাওয়ার আশা বা কখনো উদ্বাস্তু হিসেবে মানুষ দলে দলে নগরমুখী হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নগরে ভিড় বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেগা সিটির সংখ্যা।

গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগরের একটি তালিকায় প্রকাশ করেছে। ওই তালিকায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নগর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। আগের তালিকায় সবচেয়ে জনবহুল নগর ছিল জাপানের রাজধানী টোকিও। তবে এবারের তালিকায় সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফন হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনসংখ্যার দিক থেকে এখন বিশ্বে ৩৩টি মেগা সিটি রয়েছে। অথচ ১৯৭৫ সালে মেগা সিটি ছিল মাত্র আটটি।

এ মেগা সিটিগুলোর মধ্যে প্রথম ১০টির ৯টিই এশিয়া মহাদেশে।

জাতিসংঘ ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টস ২০২৫’ শিরোনামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে।

স্কাই নিউজের খবরে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাতিসংঘ তাদের ২০১৮ সালের জনসংখ্যাবিষয়ক তথ্য হালনাগাদ করেছে।

এ প্রতিবেদনে শহরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যার নাটকীয় বৃদ্ধি তুলে ধরা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে একে মানুষ্য বসতির নতুন প্রবণতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে মেগা সিটির গুরুত্ব বাড়লেও পরিকল্পনাহীন সম্প্রসারণ ভবিষ্যতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে মেগা সিটি

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেগা সিটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। শিল্প, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, নির্মাণ, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা—সব খাতেই এমন শহরগুলোয় তৈরি হয় ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থানের সুযোগ। বহুজাতিক কোম্পানির আঞ্চলিক সদর দপ্তর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক শহরগুলোকে দেশের অর্থনীতির ‘পাওয়ার হাউসে’ পরিণত করে।

অর্থনৈতিক শক্তির কারণেই মেগা সিটিতে যুক্ত হয় দক্ষ জনশক্তি ও বৈচিত্র্যময় কর্মসংস্থান। বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এসব শহরের শ্রমবাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

শিক্ষা-গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণাগার, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণে মেগা সিটি হয়ে ওঠে জ্ঞান উৎপাদনের কেন্দ্র। দেশের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে উন্নতমানের শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অবকাঠামো মেগা সিটিতে গড়ে ওঠার কারণেই এসব শহর উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রধান চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়।

চিকিৎসাসেবা সুবিধার পাশাপাশি ব্যয়ের চাপ

মেগা সিটিতে বিশেষায়িত হাসপাতাল, উন্নত ল্যাব, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসক-নার্সের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে বড় সুবিধা। জটিল রোগ নির্ণয় থেকে উচ্চমানের চিকিৎসা—সবকিছুই এখানে সহজলভ্য।

তবে এ সুবিধা সবার নাগালের মধ্যে থাকে না। উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে চাপে ফেলে বলে মন্তব্য করছেন স্বাস্থ্যনীতিবিদরা।

অবকাঠামো ও প্রযুক্তি, আধুনিক নগরের রূপ

মেট্রোরেল, উড়ালসেতু, ফ্লাইওভার, সিগন্যাল সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা, ডিজিটাল সেবা ও ই-গভর্নেন্স—এসবই আধুনিক মেগা সিটির বৈশিষ্ট্য। প্রশাসনিক সেবার ডিজিটাল রূপান্তর নগরবাসীর জন্য সুবিধা বাড়ায় এবং সময় সাশ্রয় করে।

এ ছাড়া বিনোদন, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের নানা সুযোগ মেগা সিটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। থিয়েটার, কনসার্ট, কনভেনশন সেন্টার, আর্ট এক্সিবিশন—সব মিলিয়ে শহরের সামাজিক বৈচিত্র্য হয় আরও সমৃদ্ধ।

চ্যালেঞ্জের তালিকাও কম নয়—

জনসংখ্যার চাপে নাজেহাল নগর যাপন

মেগা সিটির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ। প্রতিদিনই কাজের খোঁজে শহরমুখী মানুষের আগমন বাড়তে থাকায় বাসস্থান, খাদ্য, পরিবহন, রাস্তাঘাট, পানি ও স্যানিটেশন—সবই ক্রমশ চাপের মুখে পড়ে।

গবেষকরা বলছেন—যে পরিমাণ অবকাঠামো বাড়ছে, তার দ্বিগুণ হারে বাড়ছে জনসংখ্যা।

যানজটে নষ্ট হাজারো কর্মঘণ্টা

উৎপাদনশীলতার সবচেয়ে বড় শত্রু

মেগা সিটির অপরিহার্য বাস্তবতা হলো যানজট। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন, অপর্যাপ্ত গণপরিবহন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের কারণে শহরের সড়কে প্রতিদিন হারিয়ে যায় লাখো শ্রমঘণ্টা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক দেশের বার্ষিক বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমান।

দূষণে শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ

বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং নর্দমা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক মেগা সিটি আজ ‘হাই রিস্ক’ শহরের তালিকায়। যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানার নির্গমন ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ফেলাই দূষণের প্রধান উৎস।

পরিবেশবিদদের ভাষ্য—যদি বর্তমান দূষণের প্রবণতা চলতেই থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে মেগা সিটিতে বসবাস স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

অপরাধ ও নিরাপত্তাহীনতা

জনসংখ্যার ঘনত্ব, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে অনেক মেগা সিটিতে অপরাধের হার দ্রুত বাড়ছে। ছিনতাই, মাদক পাচার, সাইবার অপরাধ ও মানবপাচার বড় হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা শহরের আকারের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই কম।

মানসিক স্বাস্থ্য সংকটও বাড়ছে

দ্রুতগতির শহুরে জীবন, প্রতিযোগিতা, কর্মচাপ, যানজট ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—সব মিলিয়ে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা, একাকিত্ব ও অনিদ্রার মতো সমস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও কর্মজীবী মানুষের ওপর এর প্রভাব বেশি।

টেকসই সমাধান কী

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে—জনসংখ্যা বণ্টনে নীতি গ্রহণ করতে হবে। গণপরিবহন সম্প্রসারণ করতে হবে। সবুজ এলাকা ও জলাধার সংরক্ষণ অতি জরুরি, তা নিশ্চিত করতে হবে। স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রস্তুত করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ করতে হবে। উপশহর উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ দমন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো জরুরি—এসবই মেগা সিটিকে টেকসই পথে নিয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মেগা সিটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও শক্তিশালী বাস্তবায়নের ওপর।

মেগা সিটি উন্নয়নের প্রতীক হলেও এর জটিলতা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। সঠিক নীতি, পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে শহরগুলোর সমস্যা কমিয়ে সম্ভাবনা বাড়ানোই বর্তমান সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন—একটি সুষম, নিরাপদ ও টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিত করতে পারলে মেগা সিটি কেবল চ্যালেঞ্জ নয় বরং ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাও হয়ে উঠতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুখবর পেলেন যুবদলের এক নেতা

নিজ বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার

গলার ক্যানসার চেনার ৫ প্রাথমিক লক্ষণ

লিভারপুলকে নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ মোহাম্মদ সালাহর

এবার ২ নেতাকে সুখবর দিল বিএনপি

বেনিনে প্রেসিডেন্টকে অপসারণের দাবি সেনাদের, পাল্টা বার্তা সরকারের

আড়াই মাস পর কবর থেকে বৃদ্ধের লাশ উত্তোলন

টাঙ্গাইলে গির্জায় দুর্ধর্ষ চুরি

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করা হবে : সালাহউদ্দিন

শর্তসাপেক্ষে ঢাকায় আসছে ফিফা বিশ্বকাপের ট্রফি!

১০

মালয়েশিয়ায় অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে ৪৩ বাংলাদেশি নারীসহ গ্রেপ্তার ১৩৯

১১

সারের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ

১২

পদে থেকে উপদেষ্টারা ভোট করতে পারবেন কি না, জানালেন ইসি সানাউল্লাহ

১৩

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেন করা হবে : সালাহউদ্দিন আহমদ

১৪

নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি জানাতে যমুনায় সিইসিসহ কমিশনাররা

১৫

হাড়কে মজবুত রাখাবে যেসব খাবার

১৬

সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে তুলার গোডাউনের আগুন

১৭

গ্রিস উপকূলে অভিবাসী নৌকাডুবি, নিহত ১৮

১৮

জন্মদিনে ময়ূরীকন্যার পোস্ট ভাইরাল

১৯

সাংবাদিক শওকত মাহমুদ গ্রেপ্তার

২০
X