ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশকে (আরপিও) স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য এর গুরুত্ব তুলে ধরেছে তারা। আরপিও সংশোধনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন হারানো মেরুদণ্ড ফিরে পেয়েছে বলেও মত তাদের। পাশাপাশি, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ইসির এ পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করছেন। তারা বলছেন, আরপিওর এসব বিধিমালা অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সহায়ক হবে। তবে শুধু বিধিমালা প্রণয়ন নয়, কমিশনকে ক্ষমতা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গত কয়েকদিনে নির্বাচন বিধিমালা বা আরপিওতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে কমিশন। সর্বশেষ সোমবার ইসির কমিশন সভায় এসব সংশোধনী চূড়ান্ত হয়। যার মধ্যে অন্যতম হলো— ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচন-সংক্রান্ত আচরণবিধির কঠোর প্রয়োগ, প্রার্থীদের আর্থিক শুদ্ধতা যাচাই, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাড়ানো, জোটের প্রার্থীর নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন ঠেকাতে ‘না’ ভোটের প্রচলন। এসব পরিবর্তন দলগুলোকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা আনার আশা জোগাচ্ছে।
আরপিওতে কীভাবে একটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তা উল্লেখ থাকলেও আওয়ামী লীগ আমলের সবশেষ তিনটি নির্বাচনে তার কোনো প্রয়োগ বা প্রভাব দেখা যায়নি। আরপিওর বিধানকে তোয়াক্কা না করে দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে; হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের একতরফা নির্বাচনের রেকর্ড এবং ‘আমি ও ডামি’ নির্বাচন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ যখন একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে, তখন আওয়ামী আমলের দলীয়করণের কালিমা থেকে ইসিকে মুক্ত করে জনগণের আস্থায় ফেরাতে উদ্যোগী বর্তমান নাসির কমিশন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনা, ইভিএম সম্পর্কিত সব বিধান বাতিল, হলফনামার তথ্য গোপনের শাস্তি, রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে সেই দলের নিবন্ধন বাতিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এনেছে বর্তমান কমিশন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিনের মধ্যে এই আরপিও আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। সেখান থেকে উপদেষ্টা পরিষদে পাস হয়ে তা চূড়ান্ত হবে। আর সংশোধিত আরপিও বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সেমিনারের আয়োজন করা হবে। যাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবে নতুন নিয়মগুলো অনুসরণ করতে সক্ষম হন। আগামী নির্বাচনকালীন নতুন বিধিমালা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ বাড়ানো হবে।
ইসির এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টির মতো দলগুলো। দলগুলোর নেতারা এ পরিবর্তনগুলোকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা বাড়াবে।
নির্বাচনে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনায় যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছে বিএনপি। আর জামায়াত বলছে, হারানো মেরুদণ্ড ফিরে পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে তপশিলের আগেই সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের পক্ষে এবি পার্টি। আর আরপিও সংশোধনকে স্বাগত জানালেও সংস্কারবিহীন নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মত, কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই নির্বাচনী মাঠ নিরপেক্ষ থাকবে।
আরপিও সংশোধন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তি—সেটা আমাদের প্রস্তাব ছিল। কোথাও কারচুপি হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের যে ক্ষমতাটা আগে ছিল, সেটা পুনর্বহাল হয়েছে, সেটা ভালো। তবে এর অপব্যবহার যাতে না হয়, সে দিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান, সেটা প্রথমবারের মতো করা হচ্ছে, এটা ভালো। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং সারা জাতির দাবি ছিল, ইভিএম বাতিল করতে হবে। ইভিএম থাকছে না, এটাও ভালো। এ ছাড়া আমাদের দাবি ছিল, ভোটে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞার মধ্যে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। এটা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এটাও ইতিবাচক। আমরা মনে করি, এগুলো সব পজিটিভ রিফর্ম। আমরা এটাকে স্বাগত জানাই।
জামায়াত নেতা ও দলটির আইনজীবী শিশির মনির কালবেলাকে বলেন, আরপিও সংশোধনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন যে মেরুদণ্ড নিয়ে বেঁচে আছে—এটাই তার প্রমাণ। কারণ, পৃথিবীতে নির্বাচন কমিশনগুলো এত শক্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যেখানে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ভয়ে অতিষ্ঠ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে তা সচরাচর দেখা যায়নি। এবার এসব বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ হলে ভোটে দলীয়করণ বা কারচুপির অতীত ইতিহাস বদলে যাবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ আরপিও সংশোধনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, শুধু নির্বাচনকালীন নয়, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আয়োজনে এখনই ৮০ হাজার ফোর্স মাঠে নামাতে হবে। তাহলে নির্বাচনের প্রচারণার মধ্যে যে ভায়োলেন্সটা হবে, তা ডিল করা যাবে। সেজন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলছি, এটা তপশিল ঘোষণার পরে না, এখন থেকেই মাঠে নামানো প্রয়োজন। আমি বোধ করি এটাকে দ্বিগুণ করা দরকার।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন কালবেলাকে বলেন, আরপিওতে সংশোধনে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাই; কিন্তু সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যদি নির্বাচন করা হয়, সেখানে অবশ্যই আমরা আপত্তি করব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরপিও সংশোধনে ইসির এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এ সংশোধনীগুলোর সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়, তবে দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানের হবে। তবে, এসব বিধিমালা কার্যকর করতে প্রশাসনিকভাবে আরও সুসংগঠিত পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে বলে মত তাদের।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, আরপিও সংশোধনে সংস্কার কমিশনের করা বেশিরভাগ সুপারিশই স্থান পেয়েছে। সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জায়গায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করা বিশাল অর্জন। কারণ, সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আমাদের দেশের জনগণের অগাধ আস্থা রয়েছে। তারা মাঠে থাকলে জনগণ সাহস পায়। তবে ‘না’ ভোটের বিষয়টি শুধু বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে না দিয়ে সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করার সুযোগ রাখা যেত। কারণ, জনগণকে যে কাউকে ‘না’ ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন