দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে দেশের ১০০ উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের আড়াই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক দশকেরও অধিক সময়ে কাজ শেষ হয়নি। বারবার সংশোধন ও চার দফায় সাড়ে ৯ বছর মেয়াদ বাড়ানোর পরও কাজ বাকি রয়েছে ৩০ শতাংশ। নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে এক দশকের বেশি সময়েও প্রকল্প শেষ না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য তো পূরণ হয়নি; বরং বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে অনুমোদনের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। নতুন করে আরও দেড় বছর মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
শুধু এই প্রকল্প নয়, দেশের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত অর্থবছরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২৯৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর গত পাঁচ বছরে প্রায় ১ হাজার ৯০০ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে বারবার সংশোধন আর মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে গোলকধাঁধায় আটকে থাকে উন্নয়ন প্রকল্প। এ কারণে একদিকে যেমন অর্থের অপচয় হচ্ছে, একই সঙ্গে প্রকল্পের উদ্দেশ্যও অর্জিত হচ্ছে না।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৯৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ-সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা। শুধু জুন মাসে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে ৩৯টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাস্তবায়নকারী সংস্থার কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পর সেগুলো অনুমোদনের আগে আইএমইডির কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। জানা গেছে, গত অর্থবছরের ২৯৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮৪টি প্রকল্প পরিদর্শন করে ২৬৩টির বিষয়ে মতামত দিয়েছে আইএমইডি। বাকি ৩০টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিদর্শন বাকি রয়েছে। আর প্রতিবেদন জারি বাকি রয়েছে ২১টির।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়াদ বৃদ্ধির এই ধারা দীর্ঘদিন ধরেই অব্যাহত রয়েছে। আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ৪২৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের কয়েকটি প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় ৩৫৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমইডি। আর একনেক সভায় ৬০টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটিই বাড়ানো হয়। এ ছাড়া ১৫টি প্রকল্প তিনবার মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ না হওয়া চতুর্থবার একনেকে উঠানো হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩২১টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমইডি। ৫৯টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে একনেক সভায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪০০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। এর মধ্যে ৩৩৭টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে আইএমইডি। একনেক সভায় ৬৩টি প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য যেমন ব্যাহত হচ্ছে, একই সঙ্গে বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে বাস্তবায়ন খরচ। প্রকল্প গ্রহণ ও পরিচালনায় দূরদর্শিতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির এই দুর্বলতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণও ব্যাহত হচ্ছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, কিছু প্রকল্পে সময় বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকে। অনেক দেশীয় প্রকল্প চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পায় না। তবে অনেক সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে বাস্তবায়নে দেরি হয়। বেশিরভাগ প্রকল্প পরিচালকেরই প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কম। জমি অধিগ্রহণের ঝামেলা না থাকলে আর বরাদ্দ ঠিকমতো দেওয়া হলে সময় বাড়ানো ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার বড় একটি কারণ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এবং ফিজিবিলিটি স্টাডি না করা। প্রয়োজনীয়তা এবং বাস্তবতা বিবেচনা করেই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এসব কারণে প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না, খরচ বেড়ে যায়।
এদিকে, বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পগুলো অর্থবছরের পর অর্থবছর টেনে নেওয়ায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণও ব্যাহত হচ্ছে। জানা গেছে, গত অর্থবছরে ইতিহাসে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ—সরকারি নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী অন্য যে কোনো অর্থবছরের থেকে সবচেয়ে কম। ওই অর্থবছরে এডিপির এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন হয়নি।
অন্যদিকে, প্রকল্পগুলো অর্থবছরের পর অর্থবছর টেনে নেওয়ায় নতুন এডিপি বাস্তবায়নে চাপ বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সদ্য শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ২৪৬টি, যার বেশিরভাগই পুরোনো প্রকল্প। চার শতাধিক মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প স্থান পেয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন এডিপিতে। এর মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৪টি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলো এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এ ছাড়া এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চললেও শেষ হয়নি ৩৬টি প্রকল্প।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৯৫ শতাংশ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এসব প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে শেষ করতে হয়। জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রায় ২৭ শতাংশ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। কাজের পরিধি পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে ৪৯ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ব্যয় বাড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ।
বারবার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরী কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিতে যেমন ব্যয় বাড়ে তেমনি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রিটার্ন পাওয়া যায় না। এতে একদিকে অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে না। তাৎক্ষণিক না হলেও দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কাজেই পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বাস্তবায়ন দক্ষতা উন্নত করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ কালবেলাকে বলেন, সঠিকভাবে ফিজিবিলিট স্টাডি না করা এবং প্রকল্প পরিচালক ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার অদক্ষতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ না নিলে এ সমস্যা চলতেই থাকবে।
মন্তব্য করুন